You dont have javascript enabled! Please enable it!

ত্রিশডেবা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প যুদ্ধ (লামা, বান্দরবান)

ত্রিশডেবা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প যুদ্ধ (লামা, বান্দরবান) সংঘটিত হয় ২৫শে নভেম্বর। এতে ৬ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় ৪ জন। অপরদিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৫ জন আহত হন।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ক্যাম্প ছিল ত্রিশডেবাস্থ নতুন মুরুং পাড়ায়। রেংরো কারবারি পাড়া বর্তমান করাতলী। ক্যাম্পটি স্থাপিত হয়েছিল উঁচু গোল পাহাড়ে, যার চতুর্দিকে পরিখা খনন করা ছিল। আরাকান সড়কের ঈদগাঁও থেকে ক্যাম্পের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিমি এবং লামা সদর থেকে ইয়াংছা হয়ে এর দূরত্ব প্রায় ৩১ কিমি ঐ সময়ে গভীর বনে ক্যাম্পটি থাকায় বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা ছিল। আরাকান সড়ক থেকে ঐসব এলাকায় যাতায়াতের কোনো রাস্তা ছিল না। এছাড়া পাহাড়ি পথে যাতায়াত করতে পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা ভীষণ ভয় পেত। গাছের পাতা নড়লেও মুক্তিবাহিনীর শঙ্কায় তারা থরথর করে কাঁপত।
২০শে নভেম্বর ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর। নামাজ পড়ানোর জন্য একজন ইমাম প্রয়োজন। এজন্য ঈদগাঁও থেকে একজন মৌলানা এনে পালাক্রমে ঈদের নামাজ সম্পন্ন করা হয়। ঐ ইমামই পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বাসঘাতক মৌলানা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও সংখ্যা কক্সবাজারস্থ পাকসেনা হেডকোয়ার্টার্সে জানিয়ে দেয়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। রুটিন ওয়ার্ক অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ২৫শে নভেম্বর ভোরে অস্ত্র পরিষ্কার করছিলেন। এমন সময় তাঁদের পর্যবেক্ষক দল গ্রুপ কমান্ডারকে জানান যে, পশ্চিম দিক থেকে ট্রাকে করে শতাধিক শত্রুসেনা ক্যাম্পের দিকে এগুচ্ছে। তখন সময় সকাল ৭টা। সঙ্গে-সঙ্গে কমান্ডার সতর্কতা সংকেত বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশন নিতে নির্দেশ দেন। পাকহানাদার ও তাদের দোসর রাজাকাররা ক্যাম্পের তিন দিক ঘিরে এগিয়ে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোড়েন। শত্রুপক্ষও পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা বিরামহীনভাবে গুলি বিনিময় হয়। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের ফায়ার বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। শত্রুপক্ষ যেন মনে করে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি ফুরিয়ে গেছে। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ কৌশল। কিন্তু হানাদাররা উল্লসিত হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিত ধরার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে গিয়ে বলতে থাকে, “মুক্তি কো জিন্দা পাকড়াও, ইয়ে লোককো মাত মারো।’
শত্রুপক্ষ পরিখার কাছাকাছি পৌছার সঙ্গে-সঙ্গেই মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় ফায়ারের সংকেত দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে ৬ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় ৪ জন। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ-সময় লাপে ম্রো নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তিনি রেংরো কারবারির ছোট ভাই। গুরুতর আহত হন ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। আহতদের মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়। এ-যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার আবদুস ছোবহান। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক ছিলেন। হাবিলদার হিসেবে চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় শুরু হয় যুদ্ধ। চট্টগ্রাম শহরের বেশ কয়েকটি অপারেশনে তিনি অংশ নেন। শত্রুপক্ষের গুলিতে আহত হয়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি এক সময় মিয়ানমারে আশ্রয় নেন। সুস্থ হয়ে গঠন করেন মুক্তিবাহিনী। অতঃপর ৬ই জুন বাংলাদেশে প্রবেশ করে লামায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তিনি সৈনিক হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। তাঁর নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প-কাম ট্রেনিং সেন্টার ছিল ত্রিশডেবা নতুন মুরুং পাড়ায়। অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৯৯১ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পাকসেনাদের নেতৃত্বে ছিল কক্সবাজারে দায়িত্বরত সুবেদার বেনারস খা।
মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ কাঁধে বহন করতেন ছাদেক আলী নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। খেটে খাওয়া লোক বিধায় তাঁকে কেউ সন্দেহ করত না। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার, ওষুধ, কাপড়- চোপড় ইত্যাদি জোগাড় করে সরবরাহ করতেন বৃহত্তর চকরিয়া আওয়ামী লীগ-এর কোষাধ্যক্ষ মফজল আহমদ সওদাগর। তিনি ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিনি নিহত হন। [এস কে এইচ সাব্বির আহমদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!