You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্যে | সিমেন্ট : স্থানীয় টালবাহানা ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১২ই নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৩, ২৬শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্যে

বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা খাদ্য সমস্যা। খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে না পারলে সামগ্রিক উন্নয়নই ভেস্তে যাবে। কেননা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে খাদ্যশস্য আমদানী করতে হলে উন্নয়ন খাতে খরচ করার মতো অর্থের অভাব ঘটবে স্বতঃসিদ্ধভাবে। সুতরাং বাংলাদেশকে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এগিয়ে যেতে হবে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে।
বঙ্গব্ন্ধু ও তাঁর সরকার এ সম্পর্কে যে সম্পূর্ণ সচেতন তা আর বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে কৃষি সাহায্য ও পুনর্বাসন এবং তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে দেশকে অতি স্বল্প সময়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার জন্য একটি কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। এই কর্মসূচীকে কার্যকরী করে তুলতে সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সক্রিয় সহযোগিতা করবেন। কৃষকদের সঙ্গে সরকারের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করাই এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য।
কৃষি উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করার জন্য বাংলাদেশ বেতারে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিট থেকে ৭টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত দেড় ঘন্টার একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা এই অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে শুনবেন ও নির্দেশাদি পালন করবেন। তারা কৃষকদের এই অনুষ্ঠান শুনবার জন্য উৎসাহিত করবেন এবং স্থানীয় বেতার যন্ত্রের পূর্ণ সদ্ব্যবহার যাতে করা হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন। স্থানীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীগণও এই কর্মসূচীতে পূর্ণ সহযোগিতা দান করবেন। কৃষি উন্নয়নে এই অভিযান যাতে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয় সেজন্যে দ্বিমুখী পন্থায় সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। মহকুমা কৃষি অফিসারের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের মহকুমায় অবস্থিত বিভিন্ন সংস্থা, মহকুমা জনসংযোগ অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা যৌথভাবে উপরোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকার যে কর্মসূচী নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। আমরা আশা করবো উপরিউক্ত দু’টো বিভাগের কর্মচারীরা তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। শুধু তাই নয়, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে আত্মসম্মান বজায় রাখা যাবে না। অতীতে আমরা দেখেছি, খাদ্য সংকটের সুযোগ নিয়ে বিদেশী শক্তি বিভিন্ন দেশে আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে। তারপর সেই দেশকে টেনে নিয়ে গেছে বিশেষ সামরিক জোটে। খাদ্য সংকটের সুযোগ নিয়ে আবার কেউ আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাক এটা আমরা চাই না। চাই না বলেই মান সম্মান, সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যতে উন্নয়নের প্রতি লক্ষ্য রেখে স্বল্প সময়ে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতেই হবে।

সিমেন্ট : স্থানীয় টালবাহানা ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত

গতকাল দৈনিক বাংলার বাণী সহ আর একটি স্থানীয় দৈনিকে সিমেন্টের মতো একটি অপরিহার্য ইমারত ও নির্মাণ উপকরণ নিয়ে যে স্থানীয় টালবাহানা ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেশের সুবুদ্ধিমহল স্বভাবতঃই অন্ততঃ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেন।
খবরে প্রকাশ, বাহাত্তরের জানুয়ারী থেকে তিয়াত্তরের জুন পর্যন্ত তিনটি শিপিং পিরিয়ডে টিসিবি তার চুক্তি অনুসারে দেশে সিমেন্ট আমদানী করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশী রপ্তানীকারকদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে ইতিমধ্যেই টিসিবি’র ৬ লাখ ৮৯ হাজার টন সিমেন্ট আমদানী করার কথা ছিল কিন্তু সিমেন্ট আমদানী হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৯৯ হাজার টন। অর্থাৎ, প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার টন সিমেন্ট এখনো টিসিবি আমদানী করতে সক্ষম হননি।
অথচ, দেশে সিমেন্টের প্রয়োজন কিন্তু আরো বেশী। অভিজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদা প্রায় ৭ থেকে আট লাখ টন।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, দেশে প্রয়োজন মতো সিমেন্ট আমদানীর ব্যবস্থা টিসিবি তো করেইনি, উপরন্তু যেটুকুও বা করেছে তা’ থেকেও এক বিরাট অংশ এখনো আমদানী করতে সক্ষম হয়নি।
ফলে, দেশে প্রকটভাবে সিমেন্ট সংকট দেখা দিয়েছে। এবং সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের প্রায় সব রকমের নির্মাণ কাজ একেবারে বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। কোন উন্নয়নমূলক কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে একদিকে দেশের অর্থনীতির উপর যেমন এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকারত্বের অভিশাপের কোলে ঢলে পড়ছে।
অপর একটি খবরে প্রকাশ যে, প্রায় দশ হাজার টন সিমেন্ট নিয়ে মার্কিন জাহাজ ক্যারণ সমু্দ্রপথে হারিয়ে গেছে। এটি মাল বোঝাই করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশে আসছিলো এবং গত ২৮শে অক্টোবরের চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিলো। কিন্তু আজো পর্যন্ত এর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
এ সিমেন্ট আসছিলো টিসিবি’র উদ্যোগে এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সমুদ্র পথে মাল আসতে প্রায় দশ-পনেরো দিন লাগে। অথচ, এ পর্যন্ত জাহাজের কোনো খবর তো নেই, উপরন্তু কনসাইনরের কাছ থেকেও এর হদিস সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
সম্ভবতঃ একেই জোড়াতালি দিতে টিসিবি ভারত থেকে ৮ হাজার ২শ’ টন সিমেন্ট আমদানীর ব্যবস্থা করেছে। সিমেন্ট নিয়ে ভারতীয় জাহাজ রামজয়ন্তি গত পরশু চট্টগ্রামে পৌঁছেছে এবং ৮ নম্বর জেটিতে মাল খালাসও শুরু হয়েছে।
আরো প্রকাশ, ৪০ হাজার টন সিমেন্ট সরবরাহের ব্যাপারে টিসিবি সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছে। কিন্তু এ সিমেন্ট কবে নাগাদ সরবরাহ হবে তা এখনো স্থির জানা যাচ্ছে না।
এর আগে মার্কিন সরকারের সাহায্য প্রতীক রূপে বাংলাদেশকে এক লাখ বিশ হাজার টন মার্কিন সিমেন্ট সরবরাহের প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং সে সিমেন্ট নিয়ে মার্কিন জাহাজ ‘ম্যানহাটান’ এর বাংলাদেশে আসার কথা ছিলো। অথচ কোন এক অজ্ঞাত কারণে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত সে সিমেন্ট সরবরাহ করেনি।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক কাজ ব্যাহত করার জন্যে একটা বিরাট আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বিশেষ সক্রিয় আছে। এবং এ চক্রান্তের মোকাবেলা করতে না পারলে আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নানান উন্নয়নমূলক কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্যে ব্যাহত হতে বাধ্য।
সিমেন্টের এ সংকট বেশ কিছুদিন ধরে দেশে বজায় আছে এবং দিন দিনই এ সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করছে। অথচ এ অবস্থার মোকাবেলা করতে এখনো উপযুক্ত সরকারী উদ্যোগ নিষ্ক্রিয় আছে বলে অনেকের অভিযোগ।
কেউ কেউ বলেন, টিসিবি যে পদ্ধতিতে সিমেন্ট আমদানী করে তা মোটামুটিভাবে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। কিন্তু সিমেন্ট সম্পর্কে বর্তমান আন্তর্জাতিক অবস্থাই এই অব্যবস্থার জন্যে দায়ী। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের দামের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা’ ছাড়া, বিশ্বের বহু দেশে এখন সিমেন্টের সংকট রয়েছে এবং আগে যারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রধান সিমেন্ট রপ্তানীকারক ছিলো তাদের অনেকেই এখন সিমেন্ট রপ্তানী বন্ধ করে দিয়েছে।
ফলে, চুক্তিবদ্ধ হয়েও রপ্তানীকারক কয়েকটি দেশ পূর্বনির্ধারিত মূল্যে বাংলাদেশকে সিমেন্ট সরবরাহ করছে না। কারণ, তারা অন্য বাজারে এর চেয়েও বেশী দামে সিমেন্ট বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে।
অবশ্য, আমরা এ অজুহাতকে খুব একটা সহজভাবে নিতে পারি না। কারণ, বিদেশী চরিত্র সম্পর্কে আমরা যতটুকু অবহিত তাতে মনে হয় ‘কনট্রাক্ট ইজ কন্ট্রাক্ট’ অন্ততঃ এ নৈতিক বলিষ্ঠতায় তারা নিশ্চয়ই দেউলিয়া নয়। এবং তা’ হলেও আন্তর্জাতিক আদালতে ‘কন্ট্রাক্ট’ অনুযায়ী কাজ করার জন্যে পরিচাপও সৃষ্টি করা কঠিন কিছু নয়। আবার, সিমেন্ট সরবরাহ না করার পেছনে এ অজুহাত দেখানোর অভ্যন্তরে আমাদের স্থানীয় স্বার্থ বা টালবাহানা থাকাও বিচিত্র কিছু নয়।
যা হোক, কারণ যাই হোক না কেন, জরুরী ভিত্তিতে দেশে সিমেন্ট আমদানী করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নতুন উদ্যোগে চিন্তা করা উচিত বলে আমরা মনে করি। ‘স্পট পারচেজ’ ছাড়া সিমেন্ট সংগ্রহের ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা নেই এটা খুবই দুর্ভাবনার কথা।
সরকারের উচিত সৎ ও অভিজ্ঞ প্রতিনিধি প্রেরণ করে অচিরেই সিমেন্ট ক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজেরও সুব্যবস্থা করা।
অনেকে মনে করছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা শীঘ্রই সিমেন্টের আরো দাম বৃদ্ধি করতে পারে। সুতরাং, অবিলম্বে দেশে সিমেন্ট আমদানীর ব্যবস্থা না করলে দেশের উন্নয়ন কাজসমূহ ব্যাহত হওয়া সহ দেশে প্রকট সিমেন্ট সংকট তো দেখা দেবেই, উপরন্তু চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সিমেন্ট সম্পর্কে যে ১ লাখ ৯৬ হাজার টন সিমেন্টের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং প্রথমেই আমাদের স্থানীয় দুষ্কৃতিকারী ও অসৎ ব্যক্তিদের টালবাহানা সম্পর্কে হুঁশিয়ার হয়ে সিমেন্ট সম্পর্কে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে মোকাবেলা করতে হবে।
কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে হৃদয়ের যোগাযোগ না রেখে কোনো আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সম্পূর্ণ সফল হতে পারে না।
এ সব টালবাহানা ও চক্রান্তকে কঠোর হাতে দমন করতে বা মোকাবেলা করতে হবে। তা না হলে সিমেন্ট সম্পর্কে যে যৎকিঞ্চিৎ ‘শিপমেন্ট এডভাইস’ পাওয়া গেছে তাও ব্যর্থ হয়ে যাবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন