মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশাল উপজেলা (ময়মনসিংহ)
ত্রিশাল উপজেলা (ময়মনসিংহ) ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ত্রিশালেও এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। ৪ঠা মার্চ নজরুল একাডেমি মাঠে থানা ছাত্রলীগ-এর উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বস্তরের জনগণ রামদা, বল্লম, সুপারি গাছের ফালা, ডামি বন্দুক ও বাঁশের লাঠিসহ উপস্থিত হয়। সভার বক্তারা সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। ঢাকায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ – ত্রিশালের মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পাকবাহিনী কর্তৃক ২৫শে মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে পরের দিন ২৬শে মার্চ তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৬শে মার্চের পর ঢাকা থেকে দলে-দলে গ্রামের দিকে আগত লোকদের সাহায্যের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী এপ্রিল মাস পর্যন্ত কাজ করে।
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তৈরি হন। তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য নজরুল একাডেমি, ধানীখোলা মিলন সমাজ, বৈলর রহমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয়, কাজীর শিমলা উচ্চ বিদ্যালয়, ধলা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় এবং কালীর বাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এসব কেন্দ্রে আবুল কাশেম, জিল্লুর রহমান, আবুল কাশেম নামে অপর একজন, তোতা মিয়া প্রমুখ অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও ইপিআর সদস্য তাঁদের বাঁশখেলা, লাঠিখেলা ও শরীরচর্চা এবং ডামি বন্দুক ও ৩০৩ রাইফেল দিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। অনেকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান এবং প্রশিক্ষণশেষে ফিরে এসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ করেন।
ত্রিশালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- জৈমত আলী মাস্টার (থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি), হাসেন আলী ফকির (ধানীখোলা), আব্দুল মতিন মাস্টার (ধানীখোলা), এম এ জলীল ফরাজী (ধানীখোলা), ফারুখ নেওয়াজ হোসেন (ধানীখোলা), আব্দুর রশীদ মাস্টার মোফাজ্জল (ধানীখোলা),
হোসেন (চরকুমাড়ীয়া), হাতেম আলী পোস্ট মাস্টার (কাঁটাখালী) প্রমুখ। আর কামন্ডাররা হলেন— মেজর আফসার, আব্দুল বারী মাস্টার, আব্দুল বারেক মাস্টার এবং শাহ আনছার উদ্দিন মাস্টার।
২৮শে এপ্রিল পাকবাহিনী প্রথম ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রবেশ করে। এখানে তারা একদল মুক্তিযোদ্ধাকে এলাকা অতিক্রম করতে দেখে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছুড়ে তার জবাব দেন। কিন্তু অবস্থা প্রতিকূল দেখে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন এবং
পাকবাহিনী প্রথমে নজরুল একাডেমি মাঠে এবং পরে ধানীখোলা হাইস্কুল মাঠ, কাজীর শিমলা হাইস্কুল মাঠ, কালীর বাজার হাইস্কুল মাঠ, পোড়াবাড়ি হাইস্কুল মাঠ ও সাখুয়া ফকিরবাড়ি মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করে। স্থানীয় রাজাকাররা এ ক্যাম্পগুলো পাহারা দিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় উপজেলার রাজাকার, আলবদর- ও শান্তি কমিটির লোকজন স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। রাজাকার বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিল— মোহাম্মদ ফজলুল হক খান (ত্রিশাল), ওয়াজেদ আলী (ত্রিশাল চরপাড়া), ভোলা মিয়া (কুমারিয়া), আব্দুল মোতালেব (ত্রিশাল), হুরমত আলী (চিকনা), চাঁন মিয়া (ত্রিশাল বাজার), ওসমান আলী (ত্রিশাল বাজার), মো. আদিল সরকার চেয়ারম্যান (ত্রিশাল), আব্দুল লতিফ, মোহাম্মদ আনিছুর রহমান মানিক (মান্দাটিয়া), আব্দুর রাজ্জাক (কোনাবাড়ি), আলতাফ আলী (ত্রিশাল নামাপাড়া), হাজী আব্দুল হাই (উজানপাড়া), আব্দুল মোতালেব (ত্রিশাল নামাপাড়া), আব্দুল ওয়াহাব (ত্রিশাল), হাসমত আলী (ত্রিশাল চরপাড়া), ইয়াকুব আলী (ত্রিশাল চরপাড়া), আব্দুর রশিদ (ত্রিশাল চরপাড়া), নওয়াব আলী সরকার (দুর্গাপুর), মোহাম্মদ আনসার আলী (পোড়াবাড়ি), শফিকুল হক ভোলা (ধানীখোলা), ইয়াকুব আলী (ধানীখোলা), পঁচা বেপারী (ধানীখোলা), জিলানী (ধানীখোলা), মাওলানা মোফাজ্জল হোসেন (তালতলা), মোকলেছুর রহমান মুকুল (দেওপাড়া), মোতালেব ফকির (বিয়ার্তা) প্রমুখ। আলবদর বাহিনীর নেতা ছিল মঞ্জু, মতিন ও নূর হোসেন ক্বারী। আর শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয়রা হলো— আব্দুর রশীদ চেয়ারম্যান (ত্রিশাল), মৌলভী মোহাম্মদ আলী (উজানপাড়া), মাহতাব উদ্দিন সরকার গেদু (চেয়ারম্যান, বৈলর ইউনিয়ন), হালিম উদ্দিন (চেয়ারম্যান, কাঁঠাল ইউনিয়ন), আ. খালেক সরকার (চেয়ারম্যান, কানিহারী ইউনিয়ন), হাসমত মাওলানা (বালিপাড়া ইউনিয়ন), আব্দুর রাজ্জাক (চেয়ারম্যান, রামপুর ইউনিয়ন), লাল মিয়া (চেয়ারম্যান, সাখুয়া ইউনিয়ন), আক্কাছ আলী (চেয়ারম্যান, হরিরামপুর ইউনিয়ন), আবুল মহসিন তরফদার ওরফে মুসা তরফদার (চেয়ারম্যান, ধানীখোলা ইউনিয়ন), ইয়াকুব আলী মণ্ডল (ধানীখোলা) প্রমুখ। এরা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।
পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা ধানীখোলা ইউনিয়নের মাইছপাড়া গ্রামের আক্তার ও রিয়াজ উদ্দিনের বাড়ি, বৈলর ইউনিয়নের শহিদ মেম্বারের বাড়ি, জেলেবাড়ি, ধীরেন্দ্র ঠাকুরের বাড়ি, কর্মকার বাড়ি, সূর্যকুমারের বাড়ি, পরেশ ডাক্তারের বাড়ি, মঠবাড়ির কাঠের ব্রিজসহ ৩-৪ কিমি এলাকার ঘরবাড়ি, কানিহারী ইউনিয়নের রেয়ার্তা গ্রামের আজিজ মেম্বারের বাড়ি, শহর লেংড়ার বাড়ি, রামপুর ইউনিয়নের কাঁকচর গ্রামের আফতাব উদ্দিন মাস্টারের বাড়ি, ধলাবাজারের হারুণ-উর-রশীদের বাড়ি, মোক্ষপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ি, আমিরাবাড়ি ইউনিয়নের কমান্ডার আব্দুল বারেক মাস্টারের বাড়িসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতন করে।
আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী বীররামপুর কায়স্থপাড়ায় লুটতরাজ ও এক হিন্দু মেয়েকে গণধর্ষণ করে। ত্রিশাল ইউনিয়নের এক হিন্দু নারীকে রাজাকার মোতালেব, হুররত আলী, চাঁন মিয়া ও ওসমান আলী গণধর্ষণ করে। পরে এই নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবার দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। এক মুসলিম নারীও গণধর্ষণের শিকার হন। এক হিন্দু মেয়েকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আলবদর নেতা মঞ্জু, মতিন ও নূর হোসেন ক্বারীর নেতৃত্বে হরিরামপুর ইউনিয়নের রাসবিহারীর বাড়ি ও রাজ্যেশ্বরের বাড়ি লুটপাটের পর দুই নারীকে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। মঠবাড়ি ইউনিয়নে রাজাকার ইনচার্জ নবাব আলী ওরফে নবে সরকারের সহযোগিতায় রাণী সাহাকে ধর্ষণ করা হয়। সোহাগী বালাকে গণধর্ষণ করে হাত-পা ভেঙ্গে ট্রাংকে ভরে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। এছাড়া ধর্মান্তরসহ হেন পৈশাচিক কর্মকাণ্ড ছিল না, যা হানাদার ও তাদের দোসররা এ উপজেলায় করেনি।
ত্রিশাল উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের উচ্চ বিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও শান্তি কমিটির ক্যাম্প ছিল। ত্রিশাল নজরুল একাডেমির মাঠেও তাদের ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পগুলো তারা নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত।
ত্রিশাল উপজেলায় ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একটি গণকবর রয়েছে, যা রায়েরগ্রাম গণকবর নামে পরিচিত। ত্রিশাল উপজেলায় ওয়াজেদ আলী কোম্পানি এবং আফসার বাহিনী নামে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি স্থানীয় বাহিনী ছিল।
ত্রিশাল উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের প্রায় প্রত্যেকটিতেই ছোট-বড় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছে, যেমন- ধানীখোলার যুদ্ধ, নাগেশ্বরী ব্রিজ ধ্বংস, কানিহারী যুদ্ধ, কালির বাজার রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, বালিপাড়ার যুদ্ধ, ধলা বাজারের যুদ্ধ, বীররামপুর কায়স্থপাড়ার যুদ্ধ, চেলের ঘাটের যুদ্ধ, রায়গ্রাম যুদ্ধ -, মঠবাড়ির যুদ্ধ, কাশিগঞ্জ বাজারের যুদ্ধ, মোক্ষপুর যুদ্ধ, আছিম পোড়াবাড়ির যুদ্ধ, ত্রিশাল থানা যুদ্ধ ইত্যাদি। তবে সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত রায়গ্রাম যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ডা. ওয়াজেদ আলীর নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। এর আগে তাদের অতর্কিত আক্রমণে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। রায়গ্রামের এ-যুদ্ধই ত্রিশালের সবচেয়ে বড় ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ৮ই ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে মেজর আফসার বাহিনীর কমান্ডার শাহ আনছার উদ্দিন মাস্টারের নির্দেশে কোম্পানি কমান্ডার আব্দুল বারী মাস্টার কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে ত্রিশাল থানার পাশ দিয়ে প্রবাহিত সূতীয়া নদীর তীরে থানার চারশ গজ দূরে ওঁৎ পেতে থাকেন। রাত ১টার দিকে তাঁরা দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করলে থানায় অবস্থানরত পাকসেনারা ভীত হয়ে পড়ে এবং ভোর হবার আগেই তারা জেলা সদরের দিকে পালিয়ে যায়। তখন (৯ই ডিসেম্বর) মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার সাধারণ মানুষ এসে থানা দখল করে। সকাল সাতটার দিকে কমান্ডার আব্দুল বারী মাস্টার থানা প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জৈমত আলী মাস্টার মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম গ্রহণ করেন। থানা দখলের এ-যুদ্ধে গিয়াস উদ্দিন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
ত্রিশাল উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবদুর রহমান (পিতা ওসমান মণ্ডল), মোশাররফ হোসেন (পিতা জয়নাল আবেদীন তরফদার), আমান উল্লাহ (পিতা হোসেন আলী), হাশিম উদ্দিন (পিতা নবাব আলী শেখ), আলতাফ আলী বাজারী (পিতা আহমেদ আলী মুন্সি), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা হামেদ আলী), জয়নাল আবেদীন (পিতা মো. ছফির উদ্দিন), আব্দুল কাদের (পিতা আব্দুর রহমান), আব্দুল কাদের (পিতা আব্দুস সোবহান), লে. নায়েক জাকেদ আলী (পিতা সফির উদ্দিন আহমেদ), সিপাহি আবদুল মতিন (পিতা হাতেম উদ্দিন মণ্ডল), সিপাহি সামছুল হক (পিতা মৌলভী আবুল বাশার), নজরুল ইসলাম (পিতা জাবেদ আলী), মোরশেদ আলী (পিতা মনির উদ্দিন) এবং গিয়াস উদ্দিন (৯ই ডিসেম্বর থানা দখল যুদ্ধে শহীদ)।
ত্রিশাল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি স্মৃতিসৌধ এবং রায়েরগ্রামে ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [মাসুম বিল্লাহ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড