তিস্তা ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ (কুড়িগ্রাম সদর)
তিস্তা ব্রিজ প্রতিরোধযুদ্ধ (কুড়িগ্রাম সদর) সংঘটিত হয় ১লা এপ্রিল। এতে পাকিস্তানি মেজর এজাজ মোস্তফা ও কাউনিয়া থানার ওসি-সহ ১৫ জন পাকিস্তান সেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধাদের তিস্তা ব্রিজ নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি ছিল। তিস্তা ব্রিজের নিয়ন্ত্রণের ফলে লালমনিরহাট বিমানবন্দর এবং রেলওয়ে ডিভিশন যেমন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ছিল, তেমনি তিস্তা নদীর পূর্বদিকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা যথা পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, চিলমারী, উলিপুর, রৌমারী এবং কুড়িগ্রাম সদর থানার বিশাল ভূখণ্ড মুক্তাঞ্চল ছিল। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তা ব্রিজ নিজেদের দখলে রাখার সংকল্প করেন। ২৮শে মার্চ সন্ধ্যায় আহম্মদ আলী বকসীর ঘোষপাড়াস্থ গোডাউনে কুড়িগ্রামের সংগ্রাম কমিটির সভায় সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞদের নিয়ে কুড়িগ্রাম বেসামরিক হাইকমান্ড গঠন করা হয়। তিস্তা ব্রিজ নিয়ন্ত্রণে রাখাই প্রধান কর্তব্য বলে হাইকমান্ড স্থির করে। থানা ও আনসার ক্যাম্প থেকে প্রাপ্ত অস্ত্র এবং স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত রাইফেল ও বন্দুক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করে সেসব অস্ত্র দিয়ে তাঁরা তিস্তা ব্রিজে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২৮শে মার্চ ম্যাজিট্রেট জিয়াউদ্দিন আহমদের সহযোগিতায় সোনাহাট বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রসহ আবুল হোসেন এমপিএ-র সার্বিক তত্ত্বাবধানে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ, ইপিআর- এর সুবেদার আরব আলী, বোরহান উদ্দিন, আনসার-এর মহিউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আব্দুল ওহাব তালুকদার প্রমুখ তিস্তা ব্রিজ প্রতিরোধে অংশ নেন। তিস্তা ব্রিজ প্রতিরোধে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এমনকি দিনাজপুর থেকেও ইপিআর ও সেনাবাহিনীর অনেক বাঙালি সৈন্য যোগ দেন। ক্যাপ্টেন নওয়াজিস উদ্দিন কুড়িগ্রামে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর বাঙালি ইপিআর-এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য তিস্তা ডিফেন্সে সমবেত হন। আনসার, পুলিশ, ইপিআর, ছাত্র ও যুবকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ পাকিস্তানি সেনাদের দারুণভাবে বিচলিত করে। তারাও মরিয়া হয়ে ওঠে তিস্তায় অবস্থান নিতে। ৩১শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কাউনিয়া অভিমুখে অগ্রসর হলে বাঙালি সেনা ও ছাত্ররা কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেন। তারা পিছু হটে তিস্তা রেল সেতুর কুড়িগ্রাম প্রান্তে (উত্তরে) পজিশন নেন। ১লা এপ্রিল তিস্তা ব্রিজের প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরিতে গোকণ্ডা ও রাজপুর, ঘড়িয়ালডাঙ্গা প্রভৃতি এলাকার স্থানীয় জনসাধারণ অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। মহকুমা শহর এবং লালমনিরহাট থানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মাঝে-মধ্যে এলেও মূল ভূমিকা পালন করেন আনসার, ইপিআর ও স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা। ২রা এপ্রিল তিস্তা ব্রিজের উত্তর প্রান্তে আনসার, ইপিআর ও স্বাধীনতাকামী জনগণ রেলওয়ে ওয়াগন, গাছের গুঁড়ি দিয়ে রেলপথে অবরোধ সৃষ্টি করেন। তারা তিস্তা ব্রিজের কুড়িগ্রাম প্রান্তে কয়েক কিলোমিটার রেললাইনও তুলে ফেলেন। ঐদিন বিকেল তিনটার দিকে পাকিস্তান সেনা অফিসার মেজর এজাজ মোস্তফা ১৫ জন সৈন্যের একটি টিম নিয়ে কাউনিয়া থানার ওসি-সহ তিস্তা ব্রিজে রেকি করতে আসে। পূর্বে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নাগালের মধ্যে আসামাত্র ইপিআর-এর হাবিলদার ওহাব প্রথম গুলিবর্ষণ করেন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি পাল্টা গুলি চলে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে মেজর এজাজ মোস্তফা ও কাউনিয়া থানার ওসি-সহ ১৫ জন পাকিস্তান সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ঐদিনই পাকিস্তানি সেনারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব না দেয়ায় সহজেই পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট রেঞ্জে গুলিবর্ষণ করে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পিত আক্রমণ করলে বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা তিস্তা ব্রিজের ওপর নিহত হয়। সেদিনের যুদ্ধে আতাহার আলী মল্লিক, বীর বিক্রম (বরিশাল) এবং ইপিআর সদস্য এরশাদ আলী, বীর উত্তম (নোয়াখালী) শহীদ হন। আতাহার আলী মল্লিক প্রথমে শহীদ হন। কিছুক্ষণ পরেই পাকবাহিনীর একঝাঁক বুলেট বাংকার ভেদ করে এরশাদ আলীর শরীর বিদীর্ণ করে। তাঁদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও তিস্তা ব্রিজের প্রতিরোধযুদ্ধের বিজয় বাঙালিদের প্রবল আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এ-সময় পাকিস্তানিদের গুলিতে লালমনিরহাট থানার ওসি মীর মোশারফ করিম গুরুত্বর আহত হয়ে লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালিদের প্রতিরোধ ভাঙতে প্রচুর গোলাগুলি খরচ করেও সেদিন তিস্তা ব্রিজ দখলে নিতে পারেনি। তিস্তার যুদ্ধে পালিয়ে সেদিন অনেক পাকিস্তানি সৈন্য প্রাণ রক্ষা করে। যুদ্ধে প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি মেজর এজাজ মোস্তফার মৃত্যুতে এ অঞ্চলে পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের হিংস্রতা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কৌশল বদল করে ৪ঠা এপ্রিল হারাগাছ দিয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করে লালমনিরহাট শহর ও বিমান বন্দর দখলে নেয়। ঐদিন তারা লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। তারা হাসপাতাল থেকে আহত ওসি মীর মোশারফ করিমকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। প্রতিরোধকারীরা বুঝতে পারেন তিস্তা ব্রিজ বেশি সময় তাঁদের পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব নয়। লালমনিরহাটে পাকিস্তানিদের অনুপ্রবেশের পর মুক্তিযোদ্ধারা তিস্তার ডিফেন্স প্রত্যাহার করে সীমান্তের দিকে চলে যান। সেখানে তাঁরা বিভিন্ন যুবশিবির ও টেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে ট্রেনিং কার্যক্রম শুরু করেন। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড