You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে তেরখাদা উপজেলা (খুলনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে তেরখাদা উপজেলা (খুলনা)

তেরখাদা উপজেলা (খুলনা) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরও আওয়ামী লীগ-র কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দেশের অন্যান্য স্থানের মতো তেরখাদার সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এ উদ্বুদ্ধ হয়ে ডা. মুনসুর আলী এমপিএ, ফোহাম উদ্দিন, বোরহান উদ্দিন, থানার ওসি নিরঞ্জন সেন, দাউদ আলী রতন, সুকুমার সাহা, শেখ উকিল উদ্দিন, হোসেন আলী প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করার জন্য এলাকাবাসীকে নিয়ে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হন। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী ডা. মুনসুর আলী এমপিএ-র নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তিনি ফোহাম উদ্দিন এবং বোরহান উদ্দীন মাস্টারের নেতৃত্বে স্থানীয় জনসাধারণকে সুসংগঠিত করে নর্থ খুলনা মুক্তিবাহিনী – নামে স্থানীয়ভাবে একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন, যার সামরিক শাখার দায়িত্ব পালন করেন ফোহাম উদ্দিন (পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন নামে পরিচিত)।
নর্থ খুলনা মুক্তিবাহিনী-র প্রশিক্ষণের জন্য খুলনার এসপি আব্দুর রকিব খান ডা. মুনসুর আলী এমপিএ-কে ৭০টি রাইফেল ও ৪০ হাজার গুলি প্রদান করেন। এসব অস্ত্র দিয়ে ফোহাম উদ্দিন, বোরহান উদ্দীন এবং ওসি নিরঞ্জন সেনের নেতৃত্বে তেরখাদা কাটেংগা হাইস্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এঁরা প্রশিক্ষণ শেষে এসব অস্ত্র থানার অস্ত্রাগারে জমা রাখতেন। প্রশিক্ষণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং অনেকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে শুরু করেন। মোল্লা নূরুল হক (তেরখাদা), নূরুল হক (গোপালগঞ্জ), সোহরাব, আ. জলিল, মোহাম্মাদ আলী প্ৰমুখ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে তেরখাদায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। প্রশিক্ষিত সৈনিকবৃন্দের যোগদান, এলাকার সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং প্রশিক্ষণের ফলে তেরখাদায় একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণায় তেরখাদাবাসীর মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা দেয়। ২৮শে মার্চ কাটেংগা স্কুল মাঠে ডা. মুনসুর আলী এমপিএ-র নেতৃত্বে এক প্ৰতিবাদী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় এলাকার গণ্যমান্য ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের শতশত মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাল, সড়কি, বল্লম, রামদা, তীরধনুক প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অংশগ্রহণ করে। জনসভায় পুলিশের বাধা এবং মুসলিম লীগ নেতাদের নির্দেশে ওসি নিরঞ্জন সেনকে ক্ষমতাহীন করে রাখায় জনতা ও মুক্তিসংগ্রামীদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ- সময় পুলিশ ১৩৮ জন স্থানীয় নেতাকর্মীর নামে হুলিয়া জারি করে এবং প্রশিক্ষণের অস্ত্র থানায় আটকে দেয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন করেন এবং ২৯শে মার্চ গোপনে মিলিত হয়ে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ করার পক্ষে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করেন। কয়েকদিন পরেই ডা. মুনসুর আলী এমপিএ এবং বোরহান উদ্দীন মাস্টার অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যান।
২৮শে জুন ডা. মুনসুর আলী এমপিএ ও ওসি নিরঞ্জন সেনের আহ্বানে তেরখাদা থানায় এক সভা হয়। সভায় ফোহাম উদ্দিন, মোকাদ্দেস মোল্লা, বোরহান উদ্দিন, ফোহাম উদ্দিনের ভাই আ. ওহাব ও আ. জলিলসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এখানে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি কমিটি করা হয় এবং বিমান বাহিনীর সদস্য আ. জলিলকে এ কমিটির কমান্ডার করা হয়। পরবর্তীতে ছাগলাদাহ ইউনিয়নের কুশলা গ্রামের ডাক্তার মুনসুর আলীর চাচা ঈমানী লস্করের দোতলা ঘরে, মোল্লাহাটের দাড়িয়ালা গ্রামে আলহাজ্ব আমিন উদ্দিন সিকদারের বাড়িতে এবং জুলাই মাসে পাতলায় দর্পণারায়ণ বসুর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ- সকল ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন, কমান্ডার এসএম আবদুল্লাহ ও নূরুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দান করেন।
তেরখাদায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডা. মুনসুর আলী এমপিএ। অন্যরা হলেন আওয়ামী লীগের জেলা সদস্য বোরহান উদ্দীন মাস্টার (ইখড়ি কাটেংগা হাইস্কুলের শিক্ষক), ফোহাম উদ্দিন (তহশীলদার, তেরখাদা সদর), শেখ আবুল হোসেন (খুলনা জেলা পরিষদের হিসার রক্ষক), কমান্ডার এস এম আব্দুল্লাহ, এম এ দাউদ রতন, মাস্টার জহুরুল হক (প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), কমান্ডার আব্দুল জলিল, সাবেক এমপি মোল্লা জালাল উদ্দিন, মোস্তফা প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তেরখাদায় নর্থ খুলনা মুক্তিবাহিনী নামে স্থানীয়ভাবে একটি বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনী এখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।
দেশের অন্যান্য স্থানের মতো তেরখাদায়ও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করে। ২৮শে মার্চ পাকবাহিনী খুলনা নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা চিত্রা নদী পার হয়ে তেরখাদায় আসবে এ খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন, সরদার আমীর হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে এলাকার জনগণ তেরখাদা বাজারের কাছে চিত্রা নদীর তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বড়বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দেয়।
বিভিন্ন সময়ে পাকবাহিনী তেরখাদায় প্রবেশ করলেও উপজেলা সদরে প্রবেশ করে ১৫ই মে। তবে তারা এখানে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। তারা খুলনা থেকে রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তেরখাদায় এসে নির্যাতন চালাত। তেরখাদার কাটেংগা হাইস্কুলে রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প ছিল।
তেরখাদায় আদিল উদ্দিন (পিতা মোজাম মোল্লা, ইখড়ি)-কে চেয়ারম্যান এবং মহসীন মৌলীভকে সেক্রেটারি করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দানের লক্ষ্যে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির সদস্য ছিল ১৫-২০জন। তারা পরবর্তীতে আদিল উদ্দিনের ভাই আ. রশীদ মোল্লার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। এ বাহিনীর সদস্য ছিল শতাধিক। এলাকায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি হলো- আদিল উদ্দিন, মহসীন মৌলভী, মুসলিম লীগ নেতা মতিউর রহমান, ডা. হাবিবুল্লাহ বাহার, ইয়াকুব আলী প্রমুখ। শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা এলাকায় হামলা, লুটতরাজ, অংগ্নিসংযোগ করে এবং পাকবাহিনীকে দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করায়।
২৭শে এপ্রিল স্থানীয় রাজাকার জুম্মান পাকসেনাদের নিয়ে অজোগড়া গ্রামে প্রবেশ করে এবং গণহত্যা চালায়।
অজোগড়া গণহত্যায় ৪০ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ২৫শে মে তেরখাদার কিছু দালাল খুলনা থেকে পাকবাহিনীর কিছু সৈনিক নিয়ে তেরখাদায় আসে এবং কাঞ্চনগাতি গ্রামে গণহত্যা চালায়। কাঞ্চনগাতি গণহত্যায় ৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। এ সময় তারা ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন, আব্দুল ওহাব মোল্লা, এম এ দাউদ রতন, সুনীল কুমারের বাড়িসহ সাহাপাড়া গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। একই দিন তারা কাঞ্চনগাতি গ্রামের নলিনী রঞ্জন সাহা ও প্রফুল্ল কুমার সাহার বাড়িসহ শতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। খুলনা ফেরার পথে পাকবাহিনী ছাচিয়াদহ গ্রামের অনেক ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ১লা জুন রাজাকাররা তেরখাদার ব্যবসায়ী নায়েব আতিকুর রহমানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সরফরাজকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে।
তেরখাদায় রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। চিত্রা নদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সংঘর্ষে শান্তি কমিটির সেক্রেটারি মহসিন মৌলভি নিহত হয়। ৫ই আগস্ট পাতলা ক্যাম্প থেকে কাটেংগা স্কুল রাজাকার ক্যাম্পে হামলা করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি লায়েক হোসেন শহীদ হন এবং ২৬ জন রাজাকার নিহত হয়। ২৮শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয়বার রাজাকারদের এ ক্যাম্পে হামলা করেন। এতে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। এ দুটি ঘটনা কাটেংগা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ-দখল নামে পরিচিত। সেপ্টেম্বর মাসে লেবুদিয়ার রাজাকারদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষের পর দুজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ২রা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কাটেংগা রাজাকার ক্যাম্পে সর্বশেষ অভিযান চালান। এতে শতাধিক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এ-সকল আক্রমণের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দিন, কমান্ডার আবদুল জলিল, নূরুল হক মোল্লা, সোহরাব হোসেন, হাবিলদার সিরাজুল ইসলাম, পুলিশ সদস্য জোনাব আলী, আনসার সদস্য আক্কাস আলী, এম এ দাউদ রতন, মোস্তফা প্রমুখ। ২রা ডিসেম্বর তেরোখাদা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে তেরখাদায় একমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন মুন্সি লায়েক হোসেন (পিতা কালামিয়া মুন্সি, বাবুপুর, কালিয়া, নড়াইল)। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে তেরখাদা সদরে একটি বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। [মো.আলতাফ হোসেন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড