You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে তালতলী উপজেলা (বরগুনা) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে তালতলী উপজেলা (বরগুনা)

তালতলী উপজেলা (বরগুনা) ১৯৭১ সালে বরগুনা জেলার সর্ববৃহৎ থানা আমতলীর অন্তর্গত ছিল। এটি ছিল আমতলীর বড়বগী ইউনিয়নের একটি বন্দর। সুতরাং এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি আমতলী উপজেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তখন আমতলীর জনগণ ছিল রাজনীতি ও সংস্কৃতি সচেতন। তাই তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মার্চের গণ- আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এর প্রভাব পড়ে তালতলীতেও (বর্তমানে উপজেলা)। এখানকার জনগণও আন্দোলনে শরিক হয়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে তালতলীর ছাত্র- জনতা আমতলী থানা সদরে গিয়ে মিটিং-মিছিলে অংশ নেয়। সেখানে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি গঠনে অত্র অঞ্চল থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য আসমত আলী সিকদার, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সৈয়দ আবুল হাশেম, আসমত আলী আকন (সভাপতি, আমতলী থানা আওয়ামী লীগ), আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস (সাধারণ সম্পাদক, আমতলী থানা আওয়ামী লীগ), মইন তালুকদার, ছাত্রলীগ নেতা নিজাম উদ্দিন তালুকদার, জি এম দেলোয়ার হোসেন উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে আমতলীতে সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এতে তালতলীর ছাত্র-যুবকরাও অংশ নেয়। পরে তালতলীর মোতালেব মাস্টারের বাড়ি (ছকিনা) এবং থমরাউ বাবুর বাড়িতে (আগাঠাকুরপাড়া) মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয় এবং সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নেন। পরে তাদের অনেকেই এ অঞ্চলের হেডকোয়ার্টার্স ও ট্রেনিং সেন্টার বুকাবুনিয়ায় (বামনা উপজেলা) চলে যান। এ সময় আমতলী-কলাপাড়া অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মেজর হাতেম আলী (অব.)। তালতলী উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আনসারুল আলম, মোতালেব মাস্টার, হযরত আলী জোমাদ্দার, অংথা মাস্টার, অংকুজা মাস্টার ও নিতাই পোদ্দার।
তালতলী উপজেলায় পাকবাহিনীর কোনো ক্যাম্প ছিল না, কিন্তু শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী সক্রিয় ছিল। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমতলী বন্দরের আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন তালুকদারকে চেয়ারম্যান এবং আবদুল আজিজকে সেক্রেটারি করে আমতলী-তালতলীর শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তালতলীতে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আবদুল হক (বর্তমানে মৃত)। রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল জালাল মাওলানা (আমখোলা), ছোমেদ জোমাদ্দার (বতিপাড়া), আজাদ জোমাদ্দার (তালতলী বন্দর), জব্বার গাজী (চরপাড়া) এবং জাফর মাতুব্বর (চরপাড়া)। এছাড়া পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে আমতলীর কুকুয়া ইউনিয়নের ইসমাইল হোসেন, নশা তালুকদার, চাওড়া ইউনিয়নের নুর মোহাম্মদ আকন, আমতলী সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম আমতলী গ্রামের রাজাকার মুছাই প্যাদা, আমতলী বন্দরের আবদুল খালেক, চাঁন মিয়া প্যাদা, আমতলী থানার সিআই সিকান্দার আলী, ওসি রইস উদ্দিন ভূঁইয়া, এস আই তাহের প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পাকবাহিনীর সহায়তায় এরা তালতলীতে নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে। যুদ্ধকালীন পুরোটা সময় আমতলী বন্দর ব্যতীত সমগ্র গ্রামাঞ্চল ছিল মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ১০ই নভেম্বর তালতলীর আগাঠাকুরপাড়ায় পাকবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদিন পাকসেনারা কলাপাড়া থেকে নীলগঞ্জ নদী হয়ে স্পীড বোটে এসে মুক্তিসেনাদের আগাঠাকুরপাড়া ক্যাম্পে আতর্কিতে হামলা চালায়। মুক্তিসেনারা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ বাঁধে। দুঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে হাবিবুর রহমান (ছাত্র) ও মোকলেসুর রহমান (পুলিশ সদস্য) নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পাকসেনারা পিছু হটে। কিন্তু পাকসেনারা রুস্তম (ঝালকাঠী) ও কেতাব আলী সাজু নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে কলাপাড়া থানায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। পাকসেনারা এদিন আগাঠাকুরপাড়ার বিভিন্ন রাখাইন পরিবার, আসমত আলী চৌকিদার ও কেরামত চৌকিদারের বাড়ি লুট করে এবং বাড়ির লোকজনদের ওপর নির্যাতন চালায়। -আগাঠাকুরপাড়া যুদ্ধ-এ সুবেদার হাতেম আলীর নেতৃত্বে হাবিবুর রহমান, মোকলেসুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুর রাজ্জাক খান, আফাজ উদ্দিন বিশ্বাস, আলতাফ হোসেন চেয়ারম্যান, মোতালেব মাস্টার, শাহজাহান, সিরাজ উদ্দিন, বজলুর রশিদ দুলাল, মোসলেম হাওলাদার, থমরাউ বাবু, উসিড মং ও অংসিট মংসহ ৬০-৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭ই নভেম্বর।
আগাঠাকুরপাড়া যুদ্ধের পর পাকসেনারা তালতলীতে আর ফিরে আসেনি। তখন থেকেই তালতলী মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। তবে ১৪ই ডিসেম্বর তালতলী থানা সদর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে থানা মুক্ত হয় বলে এদিনকেই তালতলী মুক্তদিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আমতলী উপজেলার ২ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন— হাবিবুর রহমান (ছাত্র) এবং মোকলেসুর রহমান (পুলিশ সদস্য)। [মো. আবু সাইদ খোকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড