You dont have javascript enabled! Please enable it!

তাহেরপুর গণহত্যা (বাগমারা, রাজশাহী)

তাহেরপুর গণহত্যা (বাগমারা, রাজশাহী) সংঘটিত হয় ১৪ই মে। এতে ২০ জন সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী লীগ- নেতা-কর্মী শহীদ হন।
রাজশাহী জেলার উত্তরে বাগমারা, দক্ষিণে পুঠিয়া ও পশ্চিমে দুর্গাপুর থানার কিছু অংশ নিয়ে তাহেরপুরের বিখ্যাত হাট অবস্থিত। এ স্থানটি ছিল রাজা কংসনারায়ণ চৌধুরী (১৮৮১- ১৯৪৭)-র জমিদারির অংশ। ১৯৩৭ সালে তিনি ভারতে চলে যাওয়ার পর তাঁর ভাগ্নে শৈলেশ্বর ও শিবেশ্বর জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা জনসাধারণের সুবিধার জন্য তাহেরপুর হাটটি প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানেও সারাদেশের ব্যবসায়ীরা এখানে ব্যবসা করতে আসেন।
১৯৭১ সালের ১৪ই মে দুপুর ১:৩০টার দিকে মুসলিম লীগ নেতা পুঠিয়ার চেয়ারম্যান আউব আলীর প্ররোচনায় পাকবাহিনী তাহেরপুর হাট ঘেরাও করে। সেদিন ছিল হাটবার। বিভিন্ন স্থানের মানুষের আগমনে স্থানটি ছিল জনাকীর্ণ। হঠাৎ পাকবাহিনীর আগমনে হাটুরেরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে ২০ জন হাটুরে ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে ধরে হাটের পাশে ভাবনপুর তেলিপাড়ায় নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। এখানে শহীদদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- মানিক (তাহেরপুর মাস্টার পাড়া), গৌড় চন্দ্ৰ (পিতা পরেশচন্দ্র, ভাবনপুর ১নং ওয়ার্ড), সেকেন্দার আলী (পিতা খন্দকার গিয়াসউদ্দিন, তাহেরপুর), তুলসী দাস (তাহেরপুর), শম্ভু পাল (কামারখালি), পুড়িয়া দাম (দুর্গাপুর), মজিবুর রহমান (পিতা উজির মোল্লা, ভাবনপুর), সেকেন্দার খন্দকার (পিতা গিয়াস খন্দকার, তাহেরপুর), আনছার আলী সর্দার (পিতা কাচু সর্দার, ধনিয়াপড়া), শিবু সাহা (তাহেরপুর), মো. চয়েন শাহ্ (পিতা বাহার শাহ্, মথুরাপুর; স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) ও মজিবুর শাহ্ (পিতা চয়েন শাহ্, মথুরাপুর)।
এ ঘটনার পর স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েনউদ্দিন, সদস্য হাজি মুনির উদ্দীন এবং ভাবনপুর গ্রামের স্বর্ণকার আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে রতনপুর বালিকা বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি গণহত্যার একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার উদ্দেশ্যে একবার ১৫ জন গেরিলাযোদ্ধা নিয়ে এফএফ আবদুল ছালাম, ইউনুস আলী (বুলবুল), রণজিৎ কুমার দাশ ও বৃন্দাবন ক্যাম্পটি ঘেরাও করেন। কিন্তু তাঁরা সফল হতে পারেননি। ৭নং সেক্টরের শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আব্দুর রশীদের নির্দেশে ৩রা আগস্ট ইপিআর হাবিলদার শফিকুর রহমান তাহেরপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালান। কিন্তু সে অভিযানও ব্যর্থ হয়।
স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা তাহেরপুর স্কুলে ঘাঁটি স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ ঘাঁটিটি মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রবল বাঁধাস্বরূপ ছিল। এ কারণে ৪ঠা আগস্ট কমান্ডার শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ক্যাম্পটি পুনরায় আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। তাঁরা যখন ঘাঁটিতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন সংবাদ আসে যে, পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহল দল তাহেরপুর দিয়ে নদীপথে অগ্রসর হচ্ছে। রাত তখন সাড়ে ১০টা। হাবিলদার শফিকুর রহমান তাঁর দল নিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে খুব কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের নৌকা লক্ষ করে পরপর কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন এবং অবিরাম রাইফেল ও এলএমজি-র গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। এতে ১৮ জন পাকসেনা ও ৩ জন মাঝি নিহত হয়।
আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাহেরপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষ লেগেই ছিল। অবশেষে ১০ই ডিসেম্বর শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা তাহেরপুর এলাকা শত্রুমুক্ত করেন। এ-যুদ্ধে আবেদ আলী মৃধা (পিতা সমরেশ আলী মৃধা, তাহেরপুর), আবুল কাশেম (পিতা গোপাল উদ্দীন, বাঙ্গালপাড়া), ময়েজ উদ্দীন (পিতা সদর উদ্দীন, দাউদপুর), ওয়াজেদ আলী (পিতা প্রামেজমং, রামপুর), দীনবন্ধু প্রামাণিক (পিতা দশরথ চন্দ্ৰ প্ৰামাণিক, বড়বাড়িয়া), সুনীল কুমার (পিতা জগবন্ধু, তাহেরপুর) প্রমুখ শহীদ হন। [আকতারুজ্জাহান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!