তিতাস গ্যাসলাইন অপারেশন (নরসিংদী সদর)
তিতাস গ্যাসলাইন অপারেশন (নরসিংদী সদর) পরিচালিত হয় ২০শে আগস্ট। এটি সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ওরফে ন্যাভাল সিরাজ ও মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন বাহিনীর একটি কৃতিত্বপূর্ণ অপারেশন। এটি শুধু তাঁদের সফল অপারেশনই নয়, গোটা নরসিংদী জেলারই একটি বহুল আলোচিত অপারেশন। এ অপারেশনটি একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে জনগণের আস্থা অর্জনে সহায়তা করে, অন্যদিকে তেমনি হানাদার বাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।
থানা কমান্ডার ইমাম উদ্দিন ও তাঁর দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ফিরে আসার পর তখন পর্যন্ত এক্সপ্লোসিভ দিয়ে কোনো অপারেশন পরিচালিত হয়নি। তাঁদের কাছে এক্সপ্লোসিভের পরিমাণও খুব বেশি ছিল না। যা ছিল তা শেষ হলে আর পাবারও আশা ছিল না। তাই যা আছে তা- ই অল্প-অল্প ব্যবহার করে কীভাবে অধিক কাজ করা যায়, সে ব্যাপারে তাঁরা চিন্তা-ভাবনা করতেন। অবশেষে ন্যাভাল সিরাজের সঙ্গে আলোচনাক্রমে কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে ইমাম উদ্দিন চিনিশপুরে অবস্থিত তিতাস গ্যাসের পাইপ লাইনটি উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বিষয়গুলো হলো- প্রশিক্ষণের সফলতা যাচাই করা; গ্যাসের পাইপ লাইন কেটে দিলে সিদ্ধিরগঞ্জ-ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে গ্যাসের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যাওয়া; নরসিংদী-ঘোড়াশাল শিল্পাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও শিল্প উৎপাদন বন্ধ করা; হানাদার বাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র পুনরায় চালাবার চেষ্টা করলে তেলের সংকট দেখা দেয়া; মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি-সামর্থ্য প্রদর্শন এবং তাঁদের সম্পর্কে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিতাস গ্যাস পাইপ লাইনের নকশা যোগাড় করা এবং অপারেশনের স্থান নির্ধারণ করা হয়। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০শে আগস্ট রাত ১টার দিকে চিনিশপুরে অপারেশনটি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য ডিমোলিশন পার্টির ইব্রাহিম (নেহাব)-কে প্রধান দায়িত্ব দিয়ে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। রাত ১১টার দিকে ইব্রাহিমকে ডেকে প্রয়োজনীয় পিকে দিয়ে এক্সপ্লোসিভ তৈরি করা হয়। তারপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইব্রাহিম, শিবপুরের খান মোহাম্মদ (খানু) ও চাকশালের মান্নানকে অপারেশনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ কোথায় কিভাবে অপারেশনটি করতে হবে কমান্ডার ইমাম তা বুঝিয়ে দেন। অপারেশনের স্থান চিনিশপুরের পশ্চিম পাশেই জিনারদী রেল স্টেশনে ছিল হানাদারদের ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের আশপাশের এলাকাগুলোতে তারা পাহারারও ব্যবস্থা করেছিল। জিনারদী স্টেশনের পূর্বপাশ দিয়ে চরনগরদি হয়ে চিনিশপুর যাওয়ার রাস্তা। তাই অতি সন্তর্পণে পাহারাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অপারেশন স্থলে যাওয়ার জন্য তাদের পরামর্শ দিয়ে বিদায় জানিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন।
নেহাব গ্রাম থেকে চিনিশপুর প্রায় ১ ঘণ্টা দূরত্বের রাস্তা। ডিমোলিশন পার্টি যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে যথাযথভাবে সম্পূর্ণ কাজ সমাধা করে নির্দেশমতো রাত ১টায় সুইচ টিপে দিলে প্রচণ্ড শব্দে তিতাস গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে। গ্যাস পাইপটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা অনেক ওপরে উঠে যায় এবং বহুদূর পর্যন্ত সমস্ত এলাকা আলোকিত হয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে জনগণ প্রথমে যেমন ভয়ে বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তেমনি হানাদার বাহিনীও এত ভীত হয়ে পড়ে যে, অস্ত্রশস্ত্র ফেলে নরসিংদী, ঘোড়াশাল ও পাঁচদোনা ক্যাম্প ছেড়ে দৌড়ে পালাতে থাকে। পাকসেনারা ধারণা করেছিল, ভারতীয় বিমান বোমা ফেলেছে। এই গ্যাস পাইপ লাইন মেরামত করতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে। ততদিন এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানাগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড