তারানগর গণহত্যা (কেরানীগঞ্জ, ঢাকা)
তারানগর গণহত্যা (কেরানীগঞ্জ, ঢাকা) সংঘটিত হয় ২৫শে নভেম্বর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস এ গণহত্যায় তারানগর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন।
ঢাকা মহানগরের অতি সন্নিকটে কেরানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়ন তারানগর। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পরই এখানকার ছাত্র-যুবকরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে তারা স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু, আমানুল্লাহ খান, আকবর আলী খান, আজিজুর খান, মহিউদ্দিন খান চেয়ারম্যান প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নদী বিচ্ছিন্ন কেরানীগঞ্জের তারানগরের ভাওয়াল খানবাড়ী, ঘাটারচর, বড় মনোহরিয়ায় ক্যাম্প স্থাপন করেন। এসকল ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাঁরা আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের এসকল কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করে এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে এখানে নিয়ে আসে।
২৫শে নভেম্বর ফজরের নামাজের পরপরই হানাদাররা তারানগরের ঘাটারচর, ভাওয়াল খানবাড়ী, বড় মনোহরিয়া, ছোট মনোহরিয়া, জাওলা পাড়া, চণ্ডিপুর, ভাওয়াল ঋষিপাড়া, বড় ভাওয়াল, ছোট ভাওয়াল, কাঁঠালতলী, গুইটা, বাড়িলগাঁও, শিয়াইল গ্রামে একযোগে গণহত্যা চালায়। তারা ভাওয়াল এলাকার অর্ধশতাধিক পুরুষ সদস্যকে একত্রে ধরে নিয়ে তারানগর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন লিচু বাগানে গুলি করে হত্যা করে। এ দিনের গণহত্যায় দুই শতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন। হত্যার পাশাপাশি তারা ভাওয়াল খানবাড়ী এলাকায় শহীদ মনসুর আলী খান, আকবর আলী খান, আজিজুর রহমান খান, চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান সহ মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। গণহত্যার পাশাপাশি তারা লুণ্ঠন এবং বেশ কয়েকজন নারীকে নির্যাতন করে। গণহত্যার পরে স্থানীয়রা শহীদদের কয়েকটি গণকবরের সমাহিত করে। ঢাকা শহর থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া এবং দূর-দূরান্তের হওয়ায় সকল শহীদদের নাম জানা যায়নি। এ গণহত্যায় ঘাটারচরের ৫২ জন এবং ভাওয়াল মনোহরিয়ার ১৯ জনের পরিচয় পাওয়া যায়, তারা হলেন— ঘাটারচরের মো. মোজাম্মেল হক, মো. নবী হোসেন (বুলু), মো. নাসির উদ্দীন, অশ্বিনী মণ্ডল, বৃন্দাবন মণ্ডল, হরিপদ মণ্ডল (হরিনন্দ), মো. রিয়াজ উদ্দিন, মো.হাবিবুর রহমান, মো. গোলাম মোস্তফা, মো. আ. রশিদ, মো. মিয়াজ উদ্দীন, মো. বনী মাতবর সরকার, বৃন্দাবন মৃধা, সন্তুষ মণ্ডল, বিতাম্ভর মণ্ডল, নিলাম্ভর, পশ্যেনাথ মণ্ডল, লক্ষ্মণ মিস্ত্রি, সূর্য কামার, গুরু দাস, অমর চান, জতিন্দ্র মণ্ডল, পঞ্চানন্দ, গীরিবালা, মরণদাসী, চুরমনী, অমূল্য, মীর জহিরউদ্দীন আহমেদ, মীর সালাহউদ্দিন, মো. সোলায়মান-১, মো. লোকমান মিয়া, মো. আব্দুল কাশেম, মো. রাজ্জাক মাঝি, মো. বরকত আলী, মো. হিকমত আলী, মো. আ সামাদ মিয়া, মো. সুনদর মিয়া, মো. সামশুদ্দীন মিয়া, মো. সোলায়মান (সোলে), মো. রাজা মিয়া, মো. মাল কাদের মিয়া, মো. আ. রহমান মিয়া, মো. আ. রউফ মিয়া, মো. দরবেশ আলী, মো. আরজ আলী, মো. সাজ্জাদ হোসেন, মো. ইসমাইল হোসেন, মো. শাহজাহান (শাজু), মো. সুলতান আহমেদ, মো. শামসুল ইসলাম, মো. আ. রহমান ও মো. আ. রহিম, ভাওয়াল মনোহরিয়ার মোহাম্মদ রওশন আলী (পিতা আলহাজ্ব জহুর আলী বেপারী), মো. সামছু মিয়া (পিতা রজ্জব আলী মাতবর), মো. আফসার উদ্দিন (পিতা সাইজ উদ্দিন মিয়া), নূর মোহাম্মদ (পিতা আনসার আলী), হাজী আব্দুল ওহাব (পিতা সরাফতউল্লাহ), হাজী মধু মিয়া (পিতা হাজী আ. ওহাব), মো আব্দুল আওয়াল মিয়া (পিতা তমিজউদ্দিন মোল্লা), মোহাম্মদ সাইজউদ্দীন মোল্লা (পিতা খেজমত আলী মোল্লা), মো. হানিফ মোল্লা (পিতা আ. মজিদ মোল্লা), মো. আয়নাল হক (পিতা সাইজউদ্দিন মোল্লা), জিয়াউল হক ভূঁইয়া (কালামিয়া) (পিতা এটিএম মাজহারুল হক), হাজী আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আলহাজ্ব জোহর আলী বেপারী), আ. রহমান (পিতা মনসুর আলী), মো. চারু মাদবর (পিতা মো. আলীমুদ্দিন), মো. আফাজ উদ্দীন (পিতা খোদা বক্স), মো. হোসেন (পিতা আ. মন্নাফ মাতবর), মো. রমিজ উদ্দীন (পিতা গিনু মিয়া), মো. ফজলুল করিম (পিতা হাজী সওদাগর বেপারী) ও মো. আ. ওহাব (পিতা হাজী শেনদ্দীন কাজী মুন্সী)। তারানগর গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে ঘাটারচরে ৫২ জন শহীদদের নামসহ একটি এবং ভাওয়াল মনোহরিয়ায় ১৯ জন শহীদদের নামসহ অপর একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও ফারহানা আফরিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড