দেশের ৩ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম তারামন বিবি
তারামন বিবি (১৯৫৬-২০১৮) কৃষক পরিবারের সন্তান, কিশোরী বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান, দেশের ৩ জন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম, সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত।
১৯৫৬ সালে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাঠী ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তারামন বিবির জন্ম। তাঁর পিতার নাম আবদুস সোবহান ও মাতার নাম কুলছুম বিবি। শৈশবে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল তারামন বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘তারামন বিবি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তেমন কোনো লেখাপড়া ছিল না তাঁর।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল জনযুদ্ধ। এ-যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা কোনো অংশে কম ছিল না। কয়েক লক্ষ মা-বোন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, কেউ-কেউ ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি শত্রুর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। এমনি একজন বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি।
তারামন বিবি লড়াই করেন ১১ নম্বর সেক্টরে। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে কর্নেল) আবু তাহের। প্রথমে মুহিত হাবিলদার নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে উৎসাহিত করেন। মুহিত হাবিলদার
তারামন বিবিদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে তাঁর কাজ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা, ক্যাম্প পরিষ্কার-পরিছন্ন করা, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা এবং নানা ছদ্মবেশে পাকিস্তানি বাহিনীর খবরাখবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তা দেয়া।
তাঁর সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখে মুহিত হাবিলদার তাঁকে অস্ত্র চালনা শেখান। তিনি ৩০৩ রাইফেল ও সাব-মেশিনগান পরিচালনায় পারদর্শী হন।
তারামন বিবি পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একদিন দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে খেতে বসছেন। তারামন বিবিকে দায়িত্ব দেয়া হয় শত্রুপক্ষের গতিবিধির প্রতি লক্ষ রাখতে। উঁচুতে ওঠে দূরবীন দিয়ে তিনি দেখতে পান একটি পাকিস্তানি গানবোট তাঁদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া বন্ধ করে পজিশন নেন। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত তা চলে। তারামন বিবিও বীরদর্পে যুদ্ধ চালিয়ে যান। শত্রুপক্ষকে সেদিন তাঁরা পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরূপ আরো অনেক সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। একাধিকবার শত্রুর আক্রমণের মুখে ঘটনাক্রমে বেঁচে যান। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও সাহসিকতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার তারামন বিবি-কে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। কিন্তু দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে তিনি দেশবাসীর নিকট অজ্ঞাত ছিলেন। তিনিও তাঁর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কথা জানতেন না। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে সর্বপ্রথম তাঁর সন্ধান পান। এরপর ঢাকায় নিয়ে এসে তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেয়।
দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগে ২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর ৬২ বছর বয়সে চিরবিদায় নেন মুক্তিযুদ্ধের বীরকন্যা তারামন বিবি, বীর প্রতীক। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে চর রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়ার তালতলা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এ দম্পতির এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ধরলা নদী সংলগ্ন কুড়িগ্রামের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে তারামন বিবি, বীর প্রতীক সড়ক। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড