You dont have javascript enabled! Please enable it!

তালতলা ক্যাম্প যুদ্ধ (সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ)

তালতলা ক্যাম্প যুদ্ধ (সিরাজদিখান, মুন্সীগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১০ই অক্টোবর। স্থানীয় মানুষের ওপর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের পরিচালিত অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর তালতলা ক্যাম্প আক্রমণ করলে এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ৮ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে তালতলা বাজারের উত্তর দিকে খালের অপর পাড়ে তালতলা ডাকবাংলোয় ইপিআর হাবিলদার জৈনউদ্দিনের নেতৃত্বে ইপিআর ও রাজাকাররা। অবস্থান করত। জুলাই মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রধানত স্থানীয় রাজাকাররা থাকলেও মাঝে-মাঝে পাকসেনারাও এ ক্যাম্পে থাকত। ক্যাম্পটির দক্ষিণ দিকে বাজারের দোকান-পাট থাকায় হানাদার বাহিনী ঐদিকে খুব বেশি দূর দেখতে পেত না। তাই একদিন তারা দোকানগুলো লুটপাট শেষে পুড়িয়ে দেয়। এতে ৭০-৮০টি দোকান পুড়ে ভস্মীভূত হয়। আগুনে ফেগুনাসার গ্রামের কানাই বালা, জয়দেব কুণ্ডু ও অমূল্য বণিকের মুদি-মনোহারী দোকান, চৈতন্য দাসের মাছের আড়ৎ, যোগেশ দাসের চালের দোকান, কালিদাস নাগের স্বর্ণের দোকান, দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়ার ওষুধের দোকান; রায়েরবাগ গ্রামের সুরেশ দাস, শচীন্দ্র দাস, হরিপদ দাস ও হাতেম খার চালের দোকান, ভুবন পালের মুদি দোকান; ফুরশাইল গ্রামের গণেশ দাসের চালের দোকান, বলাই ঘোষ ও মহেন্দ্র ঘোষের মিষ্টির দোকান, মধুসূদন পালের ওষুধের দোকান, মঙ্গল দেওয়ানের ওষুধ ও জুতার দোকান; কান্দারপাড়া গ্রামের রাজেশ বণিক, ইন্দ্ৰ বণিক, যোগেশ বণিক ও কানাই বণিকের মুদি-মনোহারী দোকান ও সুরেশ মণ্ডলের মুড়ি-বিস্কুটের দোকান; গোড়াপীপাড়া গ্রামের আফজাল হক মিয়ার রেশন দোকান, আ. হাশেম মিয়ার জুতার দোকান, আ. কাশেম মিয়ার কাপড়ের দোকান, হাফাজদ্দিন মিয়া ও হায়াত বেপারীর লেপ-তোষকের দোকানসহ পার্শ্ববর্তী পাউলদিয়া, কান্দারপাড়া, শিয়ালদি, কানাইনগর, বয়রাগাদি, মালখানগর, গোবরদি, নাইশিং এবং লালমিয়া চরের বহু ব্যবসায়ীর দোকান পুড়ে যায়।
ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদাররা ফুরশাইল ও ফেগুনাসার এলাকার নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। কেবল ফুরশাইলেই ৫টি পরিবারের অনেকের ওপর এ নির্যাতন চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় তারা গোড়াপীপাড়ার দেওয়ান বাড়ির ১৪টি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এতে ১০- ১৫টি গবাদি পশু পুড়ে মারা যায়। আগুনের লেলিহান শিখায় দেওয়ানবাড়ির মনতাজ উদ্দিন মিয়া, সামছুল দেওয়ান, বারেক দেওয়ান, নাছির ও মফি হেকিম গুরুতরভাবে আহত হন। গোড়াপীপাড়া গ্রামের মোতালেব মাঝিকে পাকবাহিনী ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া রথ বাড়ির লালু পাগলা নামে এক ব্যক্তিকে মালখানগর স্কুলের পাশে গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তালতলা ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১০ই অক্টোবর সিরাজদিখান ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা তালতলা ক্যাম্পে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করলে তারা পাল্টা আক্রমণ করে। এতে দুপক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। ৫ ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্দিক অবরোধ করে আছে বুঝতে পেরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কমান্ডার মফিজের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।। তালতলা মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক আনসার কমান্ডার আ. সামাদ মিয়া, কমান্ডার এম এ করিম, বিদ্যুৎ চৌধুরী, টঙ্গিবাড়ি থানার আউটশাহীর কমান্ডার গোলাম কবীর লাভলু, আলী ইমাম, আখতার, বেতকার কমান্ডার রতন এবং মালখানগরের মহিউদ্দিন আহমেদ এ-যুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেন। এম এ করিম বিদ্যুৎ গ্রুপ বয়রাগাদি গ্রামের বিখ্যাত ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ ও লালমোহন ঘোষের পরিত্যক্ত পাকা দোতলা বাড়ি থেকে তাদের মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ-যুদ্ধে ৮ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের মধ্যে ফুরশাইলের তোফাজ্জল নিহত হয়। রাজাকারদের মধ্যে কাজীরবাগের সরবত আলী এবং বাহেরকুচির রাজ্জাকও ছিল। [মো. শাহজাহান মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!