বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩১শে অক্টোবর, বুধবার, ১৪ই কার্তিক, ১৩৮০
ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর বাণী
পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রদান করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে প্রথমেই যে দিকটি ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম। তার মতে, উত্তরণ বা সমৃদ্ধির পথে কোন সংক্ষিপ্ত বা রাজকীয় পথ নেই। একমাত্র কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের দুঃখ-দুর্দশার দিনগুলি পাড়ি দিয়ে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও আকর্ষণীয় করে তুলতে আমাদের প্রত্যেকেরই কঠোর পরিশ্রম করা উচিত।
তিনি বলেন, কর্তব্য অবহেলা করে শুধুমাত্র বসে বসে হা-হুতাশ করলে বা রঙ্গিন স্বপ্ন দেখলে ভবিষ্যতকে কখনোই প্রকৃত স্বর্ণোজ্জ্বল করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন আকুল আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম ও বিপুল কর্তব্যনিষ্ঠা।
আমাদের বিগত দুর্বিষহ ইতিহাসকে ভুলে গেলে চলবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে স্নাত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সত্যিকারভাবে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই আমাদের দেশের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং একটি সদ্য স্বাধীন দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধনের যে মন-মানসিকতা প্রয়োজন তা আমাদের সকলকেই অকলুষ উদ্যমে অর্জন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাণীতে অবিকৃত শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন যে, একশ্রেণীর কুটিল চক্রান্তকারীরা দেশের নানাবিধ ধ্বংস সাধনে প্রতিনিয়তই নানান রকমের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদের কঠোরভাবে দমন করা এবং প্রবল পরাক্রমে প্রতিরোধ করা প্রতিটি জনসাধারণের নাগরিক কর্তব্য। একমাত্র কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ তার ঈঙ্গিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে বলে বঙ্গবন্ধুর ধারণা। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পরিশ্রমকে ফাঁকি দিয়ে অন্য কোন বিকল্প পন্থায় প্রকৃত সুখ ও সমৃদ্ধি খুঁজে পাবার কোনই উপায় নেই। তিনি জনসাধারণকে উদ্ধতভাবে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, ১৯৭১ সনে দেশ শত্রুমুক্ত করার সময়ে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের মনে যে অবাধ উদ্যম, আনন্দ ও নিবিড় মানসিকতা ছিল, আপনারা আজ ঠিক সেই উদ্যম, আনন্দ ও মানসিকতা নিয়ে আজকের সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে রক্ত শপথ নিন।
পবিত্র ঈদ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর যে বাণী প্রদান করেছেন তা আর বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। আমরা জানি আজকের সংগ্রাম হলো দেশ গড়ার সংগ্রাম। বাঙালি জাতিকে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এদেশে শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম। বঙ্গবন্ধু ঈদ উপলক্ষে প্রদত্ত পানিতে জাতিকে কঠোর পরিশ্রম ও কঠিন আত্মত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলার মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কে গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ করতে এতোটুকু পিছ-পা হবে না। একদিন সত্যিই আমাদের এদের সোনার দেশে পরিণত হবে, আমাদের মানুষ সোনার মানুষ হিসেবেই বিশ্ব পরিচিতি পাবে এবং আমরা সাড়ে সাত কোটি সন্তান এক সাথেই আবার গাইতে পারবোঃ “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
অচল বাস সচল করুন
অবস্থাটা দিনকে দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার আগে যেখানে রাজধানী ঢাকার নগরীর বিভিন্ন রাজপথে এবং ঢাকার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী বিভিন্ন রুটে তিন শ’য়ের এর বেশি প্রাইভেট বাস চলত, এখন তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চুয়ান্নতে। আগে যেখানে ঢাকা নগরীর উপকন্ঠে দৈনিক ৯৫টি বাস যাতায়াত করতো, এখন তার সংখ্যা নেমেছে ছয়তে। আর ঢাকা-ডেমরা, গুলশান-মহাখালী, ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-মহাখালী এসব রুটে আগে যেখানে দৈনিক দুইশত ১৫ খানা বাস চলাচল করতো তার সংখ্যা হয়েছে আটচল্লিশ। কিন্তু এ সংখ্যাটাও আর থাকছে না। দিনকে দিন প্রাইভেট বাছাইকৃত সংখ্যা আরো রাস পাবে উপক্রম হচ্ছে বাসের এই হ্রাসকৃত সংখ্যা আরো হ্রাস পাবার উপক্রম হচ্ছে। অন্যদিকে এই শূন্যস্থান পূরণে বি, আর, টি, সি’র পক্ষেও আশাপ্রদ কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে যানবাহন চলাচলের অবস্থাটা কতদূর ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তা সহজেই অনুমেয়।
প্রাইভেট বাস চলাচলে অচলাবস্থা তথা বন্ধ হবার উপক্রম হবার পেছনের কারণ বহুবিধ। যেমন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনীর লোকেরা তাদের যানবাহনের কাছে অধিকাংশ প্রাইভেট বাস রিকুইজিশন দিয়ে এনে ব্যবহার করতো। অনেক ক্ষেত্রে এসব বাস সার্বিকভাবে ধ্বংস হয়েছে। যেগুলো সার্বিকভাবে ধ্বংস হয়নি, সেগুলোরো অনেক বাসই অচল-বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রধানতঃ খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবেই সেইসব বিকল্প অচল বাস মেরামত করে আবার রাস্তায় নামানো সম্ভব হয়ইনি, পরন্ত লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা যেসব বাস রাস্তায় চলতে সেগুলোও এখন একমাত্র খুচরা যন্ত্রপাতির অভাবে বন্ধ হয়ে বসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
অন্যদিকে স্বাধীনতার পরে যে সীমিত সংখ্যক টায়ার-টিউব এবং সীমিত পরিমাণে খুচরা যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে বিদেশ থেকে তার সিংহভাগই খরচ হয়েছে বি, আর, টি, সি বাস চলাচলের জন্য। ছিটেফোঁটা দু’একটা অংশ যাও প্রাইভেট বাস মালিকদের ভাগ্যে পড়েছে, তাতে তাদের চাহিদা সমুদ্রের একাংশও পূর্ণ হয়নি। অবশ্য বি, আর, টি, সি সরকারি সংস্থা। রাজধানী শহরের বাস সার্ভিসের অর্ধেকেরও বেশি এটার উপর নির্ভরশীল। বি, আর, টি, সি-র চাহিদা অবশ্যই অগ্রগণ্য হবে। কিন্তু তার সাথে সাথে তো প্রাইভেট বাস সার্ভিসের কথাও ভাবা দরকার। পল্লী এলাকায় প্রাইভেট বাস সার্ভিসই একান্ত ভরসা। বি, আর, টি, সি সেখানে এখনো স্থান করে নিতে পারেনি। এমতাবস্থায়, প্রাইভেট বাস সার্ভিসের দিকেও একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিদান অবশ্যই কর্তব্য। কাজেই টায়ার টিউব সহ খুচরা যন্ত্রপাতির ব্যাপক আমদানি এবং তা সুষমভাবে বন্টন করে বাসের অচল চাকা সচল রাখার সার্বিক ব্যবস্থা নেয়া হোক।
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতেছেন বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্য এ ছাড়া অন্য কোন উপায়ে তার ছিল না। ওয়াটারগেট মামলায় ফেঁসে গিয়ে নিক্সন সাহেব বেসামাল হয়ে পড়েছেন। ভেবেছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট এগনিউর ওপর উপর দিয়ে ঝড়-ঝাপটা যাবে। তিনি অন্ততঃ তীরে উঠতে পারবেন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি মহাসমুদ্র থেকে।
এগনিউ সাহেব বিদায় নিলেন বটে কিন্তু আঠার মতো লেগে রইলো ওয়াটারগেট মামলা। উপায় না দেখে কক্স সাহেবকে কলমের খোঁচায় বরখাস্ত করলেন। মার্কিন সিনেটর প্রস্তাবের ওপর দিলেন ভেটো। এ নিয়ে কমপক্ষে উনিশবার তিনি ভেটো প্রয়োগ করেছেন। তবুও যখন কোন কিছু হচ্ছেনা তখন তামাম বিশ্বকে হতচকিত করে দিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ জারি করলেন।
জসি সাহেবের আকস্মিক সিদ্ধান্তে তামাম দেশের শান্তিকামী এমনকি খোদ আমেরিকার মানুষরা পর্যন্ত চমকে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত কি তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল নাকি? নিক্সন সাহেবের রণ পাঁয়তার কষবার আকস্মিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করছেন যে, নিক্সন সাহেব মধ্যপ্রাচ্যের পানি ঘোলা করে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কালিমা মুছে ফেলতে চাচ্ছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সামরিক উন্মাদনা সৃষ্টি করে বিশ্ব পরিস্থিতিকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টি ফেরাতে চেষ্টা করছেন। নিক্সন সাহেব যাই করুন না কেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় যে সমস্যার সমাধান হবে না এটা জ্বলন্ত সূর্যের মতো সত্য। নিক্সন সাহেবের স্মরণ রাখা উচিত যে, পরের ঘরে আগুন দেয়ার জন্য তে যে আগুন দিলে সে আগুনে নিজেকেই পুড়ে মরতে হয়। সুতরাং ওয়াটারগেট মামলা থেকে পরিত্রান পাবার জন্য যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটা বন্ধ করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে অন্ততঃ আর তুলেমূলে ডুবতে হবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক