তাইন্দং গণহত্যা (মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি)
তাইন্দং গণহত্যা (মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি) সংঘটিত হয় জুন-জুলাই মাসে। তখন তাইন্দং ছিল তবলছড়ি ইউনিয়নের অন্তর্গত। বর্তমানে এটি একটি ইউনিয়ন। তাইন্দং ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর পাবর্ত্য নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি রাজাকারদের দ্বারা এ-সময় সংঘটিত গণহত্যায় বহুলোক প্রাণ হারান। এছাড়া ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং অনেক নারী গণধর্ষণের শিকার হন। এ গণহত্যার ভয়াবহতা এমনি ছিল যে, একই পরিবারের সকল সদস্য এর শিকার হন। অত্যন্ত নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে হত্যার পর লাশের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রাখা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে অংশগ্রহণের জন্য মে-জুন মাসের দিকে তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আমান উল্লাহর আহ্বানে তাইন্দং, তবলছড়ি, সিংহপাড়া ও নোয়াপাড়াসহ আশপাশের প্রায় আড়াইশর মতো ছাত্র, যুবক, ব্যবসায়ী ও কৃষক যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য থানার পাশে তারেন্দ্র খামার এলাকায় একত্রিত হয়ে ট্রেনিং শুরুর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে যায়। ফলে ট্রেনিং শুরুর আগের দিন ডাকবাংলো, নতুন বাজার ও গৌরাঙ্গপাড়া তিনদিক থেকে পাকিস্তানি, মিজো ও রাজাকার বাহিনী ঐ স্থানে আক্রমণ চালায়। এর পরপর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী প্রায় সকলে ভারতে চলে যান। এ ঘটনার পর স্থানীয় রাজাকাররা তালিকা তৈরি করে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় এবং যারা তাদের সহযোগিতা করে, তাদের টার্গেট করে গণহত্যা চালায়। ঐদিন তবলছড়ি বাজারে পাকিস্তানি হানাদাররা আগুন লাগিয়ে দেয়।
এর কিছুদিন পর স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় তবলছড়ির তাইন্দং-এ পাকিস্তানি হানাদাররা এসে গণহত্যা চালায়। তাদের সঙ্গে মিজো, রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজন ছিল। প্রফুল্ল চাকমা ও কৈলাশ চন্দ্র চাকমার নেতৃত্বে প্রায় ৩০-৪০ জনের মতো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত রাজাকার ও হিলরাজের সদস্যরা ছিল। বাঙালি মুসলিম রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের নেতৃত্ব দেয় আলী মহাজন নামে এক ব্যক্তি।
২০শে জুন রাত আনুমানিক ১২টার পর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য মো. আবদুর রহমানের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনা, মিজো ও রাজাকাররা আসে। স্থানীয় রাজাকাররা ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে দরজা খুলতে বলে। পুলিশ সদস্য আবদুর রহমান দরজা খুলে দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের কেউ-কেউ ঘরে ঢুকে পড়ে। রাজাকারদের মধ্যে অংচিলা মং মারমা, জীবন মোহন, চন্দ্ৰা মাস্টার, আলী মহাজন, প্রফুল্ল চাকমা ওরফে লম্বু, কৈলাশ চাকমাসহ আরো ৩০-৪০ জনের মতো অস্ত্রধারী ছিল। বাকিদের হাতে ছিল দেশীয় অস্ত্র দা ও কুড়াল। এ-সময় বাড়িতে ছিলেন আবদুর রহমান, তার স্ত্রী চন্দ্রামন বিবি, হাবিবুর রহমান, হারুনুর রশিদ, মো. আলমগীর ও পুত্রবধূ মরিয়ম। পাকিস্তানি বাহিনী এসেছে শুনেই পেছন দিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায় আবদুর রহমানের পুত্ররা। ঘরে ঢুকেই হানাদাররা সবাইকে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। আবদুর রহমানকে ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। প্রথমে তাকে মারধর করা হয়। এরপর তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। পরে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। লাশ ফেলা হয় নোয়াপাড়া বাড়ি থেকে দেড়শ গজ দূরে। ঐ রাতে হায়েনারা আবদুর রহমানের পুত্রবধূর ওপর নির্যাতন চালায়। রাজাকাররা আবদুর রহমানের ঘরের মালামাল ও টাকা-পয়সা লুট করে নেয়। আবদুর রহমানের স্ত্রী চন্দ্রামন বিবির গলায় ও কানে যেসব অলংকার ছিল, তাও তারা ছিনিয়ে নেয়।
একই রাতে পাকিস্তানিরা মৃত কলিম উদ্দিনের বাড়িতে হামলা করে তার ছেলে রহমত আলীকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে বেদম প্রহার করে পরে জবাই করে হত্যা করা হয়। হায়েনারা তাইন্দংয়ের আড়াই মিয়ার বাড়িতে হানা দেয়। সেখানেও তারা ব্যাপক লুটপাট চালায়। আড়াই মিয়ার ছেলে আলী আকবর ও মেয়ে মোছাম্মৎ সাবুরা খাতুন, মা তাহুরা বেগমসহ একই পরিবারের চারজনকে তারা নৃসংশভাবে হত্যা করে। ঐ বাড়ির এক শিশু কন্যাই শুধু জীবিত ছিল। এছাড়াও রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদাররা একই রাতে আরো অনেককে গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ যত্রতত্র ফেলে রেখে যায়। এরপর তারা সিংহপাড়ায় রমিজ আলীর ছেলে আলী আহমদের বাড়িতে আক্রমণ করে। ঘরে ঢুকে আলী আহমদকে তারা প্রথমে গুলি করে। এরপর রাজাকাররা তার দেহ কেটে টুকরো-টুকরো করে বাড়ির পাশে একটা ডোবায় ফেলে দেয়। একই ঘরে আলী আহমদের ছেলে আবদুর রহমান ও হোছন আলীকে ধরে প্রথমে মারধর করে। পরে ঘর থেকে বাইরে এনে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। তাদের খণ্ড-খণ্ড করে কাটা হয়। তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে- ছিটিয়ে ফেলে – এক জায়গায় মাথা, এক জায়গায় পা, এক জায়গা হাত, আরেক জায়গায় পেটের অংশ। আধা থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গায় তারা বিচ্ছিন্নভাবে লাশগুলো ফেলে দেয়। সিংহপাড়া, কাটাবাড়ির আশেপাশে, ভারত- বাংলাদেশের সীমান্ত ফেনী নদী ও ডোবাতেও কিছু লাশ টুকরো-টুকরো করে ফেলা হয়। আশেপাশে আরো কয়েকটি পরিবার ছিল। গুলির শব্দ শুনে তারা জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়। মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী ও তাঁর পিতা হাজী কোরবান আলী সরদারও গুলির শব্দ শুনে জঙ্গলে পালিয়ে যান। পরে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা চলে গেলে তারা জঙ্গল থেকে বের হয়ে এলাকার লোকজনসহ লাশগুলো খুঁজে-খুঁজে বের করেন। ঐ রাতে ফাতেমা নামের এক নারীকে পাকিস্তানি হায়েনারা গণধর্ষণ করে। এছাড়া কার্বারীপাড়া সাহেরা খাতুনকেও তারা গণধর্ষণ করে।
তবলছড়ি ইউনয়নের ৫-৭ জন নারীকে গণধর্ষণ করে। অনেককে তারা ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে এবং তাদের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে নোয়াখালীর জয়নাল মিস্ত্রী ও আলীর নাম জানা যায়। অনেককে তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে। তাদের মধ্যে দুজন হলেন আবদুল মালেক ও রহমত আলী।
এ গণহত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। হায়েনারা তাইন্দং, শুকনাছড়ি, নোয়াপাড়া ও সিংহপাড়ায় একযোগে গণহত্যা চালায়। ডাক্তার মো. আবদুল মালেককে নোয়াপাড়ার স্থানীয় এক রাজাকার অন্তুলিয়া পোমাংয়ের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। রোগী দেখার নাম করে তাঁকে ডেকে নিয়ে নোয়াপাড়াতেই কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। অন্যদের তাইন্দং হাইস্কুলের পাশে বাজার টিলায় নিয়ে হত্যা করা হয়। বেশির ভাগ মানুষকে একদিনেই ঘাতকরা হত্যা করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এসে তারা মানুষের ওপর নির্যাতন করে। মাসাধিককাল জুড়ে চলে তাদের হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট। শুকনাছড়িতে হামলা চালিয়ে আনছার আলীর ছেলে চারু মিয়া ও আছির উদ্দিনের ছেলে লাল মিয়াকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে তারা গুলি করে হত্যা করে। তবলছড়িতে পাকিস্তানিদের কোনো ঘাঁটি ছিল না। তাদের ঘাঁটি ছিল পানছড়িতে। তাইন্দং ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে হামলা চালিয়ে তারা ঐ ঘাঁটিতে ফিরে যেত।
৩০শে জুলাই পাকিস্তানি হানাদার ও স্থানীয় রাজাকাররা তবলছড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের গোয়েন্দা হাছি রঞ্জন ত্রিপুরাকে ধরে গাছের সঙ্গে লোহার রড দিয়ে পেট ও দু হাত বেঁধে এবং দু চোখে পেরেক দিয়ে ছিদ্র করে তিলে-তিলে কষ্ট দিয়ে হত্যা করে।
তাইন্দং ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে গণহত্যার শিকার শহীদগণ হলেন- নোয়াপড়ার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য আবদুর রহমান (পিতা কমর উদ্দিন), ডা. আবদুল মালেক (পিতা আবদুর রহমান), সুলতান আহমদ ভূঁইয়া (পিতা আলী আহমদ ভূঁইয়া), রহমত আলী (পিতা কলম উদ্দিন), আলী মিয়া (পিতা আফজল আলী), ছিদ্দিক মিয়া (পিতা বাদশা মিয়া); সিংহপাড়ার আলী আহাম্মদ (পিতা রমিজ আলী), আরব আলী (পিতা আলী আহাম্মদ), আবদুর রহমান (পিতা আলী আহাম্মদ); শুকনাছড়ির চারু মিয়া (পিতা আনছার আলী), লাল মিয়া (পিতা আছির আলী); তাইন্দংয়ের হোছন আলী (পিতা আহসান উল্লাহ), সৈয়দ আলী (পিতা সেকান্দর আলী), আলী আকবর (পিতা আড়াই মিয়া), আলী আহাম্মদ (পিতা আবজর আলী), সহিদ মিয়া (পিতা নাছির মিয়া), ইজ্জত আলী (পিতা আইন উদ্দিন), দুদ মিয়া (পিতা জুনাব আলী), জয়নাল আবদীন (পিতা জহির উদ্দিন), মোসা. সবুরা খাতুন (পিতা আড়াই মিয়া) প্রমুখ।
২০শে জুনের গণহত্যায় যারা শহীদ তাদের স্বজন ও আশেপাশের লোকজন পরের দিন এসে খোঁজাখুঁজি করে লাশগুলো উদ্ধারের পর একত্র করে এরপর সবগুলো লাশ বাজারের পাশে কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর কিছুদিন পর তাইন্দং বাজারের দুদ মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীকে হানাদাররা হত্যা করে। তাকেও একই কবরস্থানে দাফন করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গণহত্যার শিকার পরিবারসমূহের পক্ষ থেকে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে শহীদ পুলিশ সদস্য মো. আবদুর রহমানের পুত্র মো. হারুনুর রশিদ বাদি হয়ে ৬ই জুলাই ১৯৭২ একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বিবাদীরা হলো- ক্ষেত্র চরণ হেডম্যান (পিতা মহেশ্বর ত্রিপুরা), অন্তুলিয়া পোমাং (পিতা রমণী পোমাং ত্রিপুরা), বংশীদাশ পোমাং, চন্দ্র কিশোর মাস্টার (পিতা কছংছো ত্রিপুরা), মনমোহন চাকমা ও মতিলাল মগ। গণহত্যার শিকার শহীদ মো. সিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রী রেজিয়া বেগম বাদী হয়ে একই সময়ে অপর একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বিবাদীরা হলো- নিরীক্ষয় চাকমা (কড়বিল মৌজা), সোনাচরা চাকমা (তাইন্দং মৌজা) ও ভাগ্যমহাজনের ছেলে (বড়বিল মৌজা)।
গণহত্যার শিকার তাইন্দং মৌজার শহীদ ডাক্তার মো. আবদুল মালেকের স্ত্রী মোছাম্মৎ ফজরের নেছা বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বিবাদীরা হলো- অন্তুলিয়া পোমাং (পিতা রমণী পোমাং ত্রিপুরা), ক্ষেত্রচরণ রোয়াজা হেডম্যান (পিতা মহেশ্বর ত্রিপুরা), বংশীদাশ ত্রিপুরা ও চন্দ্র কিশোর রোয়াজা (পিতা কছংছোং ত্রিপুরা; তাইন্দং মৌজা, রামগড়)।
তাইন্দং গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে কবরের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড