You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের জনপ্রিয় ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবীদ তাকাশী হায়াকাওয়া - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের জনপ্রিয় ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবীদ তাকাশী হায়াকাওয়া

তাকাশী হায়াকাওয়া (১৯১৭-১৯৮২) জাপানের জনপ্রিয় ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবীদ, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থদানকারী, “মি. বাংলাদেশ’ নামে খ্যাত এবং জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী।
তাকাশী হায়াকাওয়া একটানা ৪০ বছর জাপানের পার্লামেন্ট ‘ডায়েট’-এর নির্বাচিত সদস্য ছিলেন এবং
‘ফাদার অব দ্য ডায়েট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি ৩ দফায় মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হায়াতো ইকেদা (১৮৯৯-১৯৬৫)-র মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী(১৯৬৩-১৯৬৪); প্রধানমন্ত্রী ইসাকু সাতো (১৯০১-১৯৭৫)-র মন্ত্রিসভায় শ্রমমন্ত্রী (১৯৬৬- ১৯৬৭) এবং প্রধানমন্ত্রী তাকেও মিকি (১৯০৭-১৯৮৮)-র মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও কল্যাণমন্ত্রী (১৯৭৬)।
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর পূর্ব বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণহানিসহ অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ সম্বন্ধে তাকাশী হায়াকাওয়ার মনে গভীর রেখাপাত করে। জাপানি ডায়েটের প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে হায়াকাওয়া বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সে-দেশের জনগণ ও সরকারের সমর্থন আদায়ে নেপথ্যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, হায়াকাওয়া তার প্রতি জাপান সরকারের উদ্বেগ প্রকাশ, বিশেষ করে জাপানি জনগণের এর প্রতিবাদ জানানোর প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাংগঠনিক উদ্যোগ নেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাপানি মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জাপানিদের সমর্থন আদায়ে জাপানের বুদ্ধিজীবী, শিল্পমালিক, শ্রমিক ও ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসার তিনি জোর আহ্বান জানান। সে-সময় জাপান প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন প্রচেষ্টার সঙ্গেও হায়াকাওয়া একাত্ম হয়েছিলেন।
হায়াকাওয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ Banguradesu to no Deai-Minzoku to Kokkyo wo Koette (টোকিও, ১৯৮২) রচনা করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে জাপানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও পরবর্তীতে কূটনীতিক শেখ আহমদ জালাল কর্তৃক ‘Encounter with Bangladesh-Transcending Racial and Territorial Boundary’ শিরোনামে এর ইংরেজি অনুবাদ হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে কাজুহিরো ওয়াতানাবের বঙ্গানুবাদে ‘আমার বাংলাদেশ’ শিরোনামে এটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে হায়াকাওয়ার গভীর সহানুভূতির কথা এ বই থেকে জানা যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন বলয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম ১৯৭২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ ব্যাপারে হায়াকাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সম্বন্ধে হায়াকাওয়া লিখেছেন, ‘সে সময় আমি বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে স্বাগত জানিয়েছিলাম এবং ডায়েটের সদস্য এবং দলীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আমি জাপান সরকারে ওপর প্রভাব খাটাতে থাকলাম এই বলে যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হোক। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, সরকার অন্য অনেক রাষ্ট্রের আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল।’ স্বীকৃতি দানের এক মাসের মধ্যে ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৩-১৪ই মার্চ, ১৯৭২ হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের জাপানি সংসদীয় প্রতিনিধি দল প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসেন। দেশে ফিরে গিয়ে ২৪শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী সাতোর কাছে পেশ করা রিপোর্টে তিনি প্রস্তাব রাখেন- (ক) বাংলাদেশকে ১০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি অনুদান অবিলম্বে প্রদান করা হোক এবং (খ) পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের হিস্যা আদায়ে জাপানের মধ্যস্থতা করা আবশ্যক। তাঁর সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সাতোর নির্দেশে ২৮শে মার্চ ১৯৭২ তারিখে জাপান বাংলাদেশে প্রথম অর্থনৈতিক সার্ভে মিশন পাঠায়। ঐ বছর ৬ই জুন তারিখে জাপান-বাংলাদেশ এসোসিয়েশন এবং কিছুকাল পরে জাপান-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন গঠিত হলে হায়াকাওয়া তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন এবং আমৃত্যু এর নেতৃত্বে ছিলেন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে জাপানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রথম সফরের সময় বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের যে ঐতিহাসিক ভিত্তি সৃষ্টি হয়, হায়াকাওয়া ছিলেন তার অন্যতম রূপকার। ১৯৭৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হায়াকাওয়া সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এলে রাষ্ট্রাচার উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে পদ্মা গেস্ট হাউজে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও সম্মান প্রদর্শন করেন। এ ঘটনাটিকে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে সুদূরপ্রসারী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সোপান বলে হায়াকাওয়া তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন। এ সফরের সময় হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে সফরকারী জাপানি প্রতিনিধিদলের কাছে বঙ্গবন্ধু যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জাপানি সহায়তার আহ্বান জানান।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এক দল ঘাতক-খুনি চক্রের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে হায়াকাওয়া খুবই ব্যথিত হন।
বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু, এ দেশের উন্নয়নে ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ, ‘মি. বাংলাদেশ” নামে জাপানে সর্বমহলে পরিচিত তাকাশী হায়াকাওয়ার ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায়’ ভূষিত করে।
১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে হায়াকাওয়া জাপানি সহায়তায় সোনারগাঁ হোটেলের উদ্বোধন উপলক্ষে শেষবারের মতো বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় আসেন। ১৯৮২ সালের ৬ই ডিসেম্বর ৬৬ বছর বয়সে টোকিওতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৮৩ সালের ৯ই নভেম্বর তাঁর দেহভস্ম বাংলাদেশের কমলাপুরস্থ বৌদ্ধ মন্দিরে বিশেষ আধারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৮৫ সালের ১০ই নভেম্বর ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে হায়াকাওয়ার আবক্ষমূর্তি স্থাপিত হয়। সেই মূর্তিতে উৎকলিত হয়েছে তাঁর স্মৃতিকথার শেষ দুটি বাক্যে উচ্চারিত তাঁর জীবনদর্শনের মর্মবাণী— ‘বর্তমান সময়ে মানব জাতিকে টিকে থাকতে হলে একটি পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। আমার বাংলাদেশ প্রীতি এবং ভাবাবেগ এই আদর্শের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ও পরীক্ষা।’ [মোহাম্মদ আবদুল মজিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড