You dont have javascript enabled! Please enable it!

জাতীয় চার নেতার অন্যতম, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, ভাষা-সংগ্রামী, আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক (১৯৬৬-১৯৭২), জাতীয় চার নেতার অন্যতম, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী এবং ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাপরবর্তী সময়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় খুনিচক্র কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত।
১৯২৫ সালের ২৩শে জুলাই বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মো. ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুন্নেসা। তিনি ঢাকা সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। রাজনীতির কারণে ১৯৪৮ সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে এবারও মেধার স্বাক্ষর রেখে কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৩ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। রাজনীতিতে সময় দেয়ার কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বারবার ব্যাহত হয়। স্কুলে ছাত্র থাকাকালে তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু। তিনি পূর্ব পকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (১৯৪৮) ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার (১৯৪৯) সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম বা প্রগতিশীল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল লীগ কর্মীদের ১৫০ নম্বর মোগলটুলী পার্টি হাউজের পূর্ণকালীন কর্মী ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন-এ তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্ট থেকে পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে মতিঝিলের হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল (১৮-২০শে মার্চ)-এ বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের যে কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি- পেশের চেষ্টা করেন, সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ৭ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬-দফা আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন, মুজিব- ইয়াহিয়া আলোচনা এর প্রতিটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনেবিজয় লাভ করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়ার। সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন, যা ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলে। এ-সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ আন্দোলন সম্পর্কিত নির্দেশনাবলি দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদান করতেন এবং পূর্ব বাংলার প্রশাসন সে অনুযায়ী পরিচালিত হতো। পাকিস্তানের প্রশাসন পূর্ব বাংলায় সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে।
২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে, ২৭শে মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ-কে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে ঝিনাইদহ পৌঁছেন। সেখান থেকে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে যান। ৩০শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতঃপর ২রা এপ্রিল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম-কে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকার গঠনসহ বিস্তারিত আলোচনা হয়। দিল্লি থেকে ফিরে তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী স্থানে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ-দের এক অধিবেশন আহ্বান করেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এভাবে ১০ই এপ্রিল ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-কে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) করে ৬ সদস্যের একটি সরকার গঠিত হয়, যা মুজিবনগর সরকার- নামে তখন সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করে। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধকে সর্বজনীন রূপদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতিনিধিদের এক বৈঠক আহ্বান করে ৬ই সেপ্টেম্বর নিজহাতে আমন্ত্রণপত্র লিখে তাঁদের তা প্রেরণ করেন। ৮ ও ৯ই সেপ্টেম্বর এ দুদিন মুজিবনগরে (বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়) ঐ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তাঁর নেতৃত্বে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়।
বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং ও অস্ত্রের ব্যবস্থা, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী ১ কোটি শরণার্থীর নানা সমস্যা দেখাশুনা, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত সরকারের পাশাপাশি মুক্তাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা, বৈদেশিক রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত সরকারের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা, জাতিসংঘ-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রে প্রতিনিধি দল প্রেরণ, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন দেশে স্থাপিত বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের ব্রিফিং, ভারতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আগত বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তাঁর সাক্ষাৎকার দান, মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন ও মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করা, সর্বোপরি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নিজ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় ষড়যন্ত্র ইত্যাদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়। সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ-এর উদ্যোগ ও উৎসাহে এবং তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্ত ও সর্বপ্রকার সহযোগিতায় ২৪শে জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি কক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ৮ ধরনের ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়, যা ঐ সময় মিডিয়াসহ সর্বমহলের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। ১০ই এপ্রিল সরকার গঠনের পর জাতির উদ্দেশে দেয়া তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে (১১ই এপ্রিল) তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, ‘স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সর্বজনবিদিত।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করে ভারতে যাত্রাকালে স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের উদ্দেশ্যে এক চিরকুটে তিনি লিখে রেখে যান, ‘জোহরা পারলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে মিশে যেয়ো’।
স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি পুনরায় অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একদল ঘাতক-খুনি চক্রের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে তাঁর বাসভবনে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হন। এটি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশার বাস্তবায়ন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন মোশতাক সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার কারণে ২২শে আগস্ট তাজউদ্দীন আহমদ ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অপর তিন জাতীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।
১৫ই আগস্টের একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর গভীর রাতে মোশতাক সরকারের নির্দেশে বন্দি অবস্থায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদকে ব্রাশ ফায়ার করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে একদল সেনাসদস্য অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বজনদের কর্তৃক বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ-কে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র : এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমী ২০১২; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ২০১৮ (৪র্থ মুদ্রণ); জাতীয় চার নেতা স্মারকগ্রন্থ, চাতীয় চার নেতা পরিষদ ১৯৯৯; সিমিন হোসেন রিমি এমপি-এর সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার; শারমিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, ঐতিহ্য ২০১৪

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!