You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে তারাকান্দা উপজেলা (ময়মনসিংহ)

তারাকান্দা উপজেলা (ময়মনসিংহ) ১৯৭১ সালেফুলপুর উপজেলার অংশ ছিল। ১৯৯৯ সালের ১৯শে মে এটি থানা এবং ২০১৩ সালের ৩রা জানুয়ারি উপজেলার মর্যাদা লাভ করে।
তারাকান্দা একটি রাজনীতি-সচেতন এলাকা। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতা মো. শামসুল হকের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- তারাকান্দায় যান। বঙ্গবন্ধু সে-সময় ইউনুস আলী তালুকদারের কাঠের দোতলা ঘরের বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে এলাকার ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার সমর্থনে এবং ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলার প্রতিবাদে তারাকান্দা বাজারে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর নেতা-কর্মীরা বহু প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এ কে মোশারফ হোসেন আকন্দ এমএনএ ও মো. শামসুল হক এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে বিজয় লাভ করার পরও বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সারা দেশের মতো তারাকান্দার সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর তারাকান্দায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। তারাকান্দায় শামসুল হক এমপিএ-র নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন আবদুল মজিদ, ননী গোপাল পণ্ডিত, হাসান খান, মো. আব্দুল মান্নান, আবদুল হেকিম, আবদুল হামিদ চৌধুরী, প্রদীপ চক্রবর্তী, সাইন উদ্দিন ফকির প্রমুখ।
সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা, মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য ও গুরুত্বের কথা প্রচার করতে থাকেন। তাঁরা পাকবাহিনী, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। সে-সময় পাগলী ইউনিয়নের আকাপাড়া গ্রামের কবি হোসেন আলী মিয়া বিভিন্ন হাট-বাজারে নিজের রচিত কবিতা পাঠ ও গান গেয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে তারাকান্দার কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদের মধ্যে ননী গোপাল পণ্ডিত, গোলাম মোর্শেদ বকুল ও জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আক্তার স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ-সময় মুজিব বাহিনীর সদস্য আব্দুল মান্নান, জনাব আলী ও সাদেকুর রহমানের নেতৃত্বে বানিহালা ইউনিয়নের লাউটিয়া গ্রামের প্রফুল্ল সরকারের বাড়ি এবং কলহরি গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মঞ্জুরুল হক তোতা। এ কোম্পানি ‘তোতা কোম্পানি’ নামে পরিচিত ছিল। গৌরীপুরের তফাজ্জল হোসেন চুন্নুর নেতৃত্বাধীন একটি কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন তারাকান্দার ননী গোপাল পণ্ডিত। দুলাল চন্দ্র সরকার (পিতা যতীশ চন্দ্র সরকার, কাকনী)-সহ তারাকান্দার বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা দেশের অন্যান্য স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৯শে এপ্রিল কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই ময়মনসিংহ থেকে তারাকান্দায় অনুপ্রবেশ করে।
ময়মনসিংহ জেলা সদরের সঙ্গে ফুলপুর ও হালুয়াঘাট উপজেলার পাকসেনাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। প্রধানত ফুলপুর ও হালুয়াঘাট থেকে পাকসেনারা তারাকান্দার সকল এলাকায় নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালাত। তবে তারাকান্দা রাংসা নদীর সেতুর কাছে পাকবাহিনী একটি ক্যাম্প স্থাপন করেছিল।
তারাকান্দায় মুসলিম লীগ ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে সাধারণ জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার-নির্যাতন করত। তারাকান্দার মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মধ্যে তারাকান্দা ইউনিয়নের ইয়াকুব আলী (মধুপুর), মুমিন তালুকদার (তালদিঘি), কাকনী ইউনিয়নের আবদুল মজিদ খান, মাফিজ উদ্দিন সরকার, আবদুল মোতালেব খান, কাবিল (রণকান্দা), ইউনিয়নের আমছর আলী (মাশকান্দা) প্ৰমুখ উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতার পর কাবিল ও আমছর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়।
স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নানাভাবে সহযোগিতা করে। তারা পাকবাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করত। পাকসেনাদের সঙ্গে মিলে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞচালাত। জুন মাসের শেষের দিকে গালাগাঁও ইউনিয়নের বড়ইপুকুরিয়া গ্রামের শঙ্কর দত্তের বাড়ি ও মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ চক্রবর্তী ওরফে রনু ঠাকুরের বাড়িতে পাকসেনা ও রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ করে। গালাগাঁও ইউনিয়নের ডওহাতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ও ইসমাইল ফকিরের বাড়িতে রাজাকার কালামের নেতৃত্বে লুটপাট করা হয়। তারা বাড়ির লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে টাকার বিনিময়ে মুক্তি দেয়। রাজাকার আবদুল মোতালেব, মুমিন তালুকদার ও আবদুল মজিদ খানের নেতৃত্বে কাকনী ইউনিয়নের আউটদার বাঁশতলা গ্রামের মতিলাল সরকারের বাড়িসহ ২০টি হিন্দু বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। লুটের মালামাল পরদিন কাকনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গণিমতের মাল বলে নিলাম দেখিয়ে রাজাকাররা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে।
সেপ্টেম্বর মাসে পাকসেনারা কামারগাঁও ইউনিয়নের রাজদারিকেল বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওয়াহেজ উদ্দিনকে আটক করে জিপের সঙ্গে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে শরচাপুর ফেরিঘাটে নিয়ে হত্যা করে। এদিন গালাগাঁও ইউনিয়নের বড়ইপুকুরিয়া বাজারে সন্তোষ ঠাকুর পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হন। এর কয়েকদিন পর তারাকান্দা-ধোবাউড়া রাস্তার ঢাকুয়া ইউনিয়নের হারিয়াগাই ব্রিজের নিচে ধনা বাবু, জামিনী পাল ও স্বপন পালকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। উপজেলার কিছু হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম পাকসেনাদের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত হয়।
কাকনী ইউনিয়নের দাদরা কামার বাড়িতে ৩রা ডিসেম্বর একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এ গণহত্যায় ৫ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। নিহতদের বাড়িতে গণকবর দেয়া হয়। দাদরা কামার বাড়ি গণহত্যা- তারাকান্দায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নির্মমতার এক নিদর্শন। এ উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে, যা বাখাই গণকবর নামে পরিচিত। তারাকান্দা এলাকা মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ-ফুলপুর- হালুয়াঘাট উপজেলার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্থায়ীভাবে তারাকান্দায় কোনো নির্যাতনকেন্দ্র না থাকলেও এ এলাকার মানুষকে ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে অত্যাচার করা হতো।
২৭শে জুন ননী গোপাল পণ্ডিত ও গোলাম মোর্শেদ বকুলের নেতৃত্বে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কে বিসকা ইউনিয়নের খিচা নামক স্থানের একটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এ আক্রমণের পর ১৮ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে রামপুর ইউনিয়নের বাহেলা নামক স্থানে প্লাটুন কমান্ডার ননী গোপাল পণ্ডিতের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনতা ৩ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। তাদের ব্যবহৃত একটি জিপ দখলে নিয়ে তাঁরা ভারতের শিববাড়ি ক্যাম্পে হস্তান্তর করেন। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা তারাকান্দা রাংসা নদীর ব্রিজ ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করেন।
৯ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহে ফেরত আসার পথে তালদিঘি ও কাকনী নামক স্থানে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে পড়ে। এ-সময় ২ জন ভারতীয় সেনা এবং লাউটিয়া গ্রামের একজন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। ৯ই ডিসেম্বর তারাকান্দা হানাদারমুক্ত হয়। প্রতিবছর এদিন হানাদারমুক্ত দিবস হিসেবে পালিত হয়।
তারাকান্দা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- রহিম উদ্দিন (মাইলুরা), গোলাম মোস্তফা (বাবনীকোনা) ও আবুল কাশেম (গ্রাম স্বল্প, ইউনিয়ন রামপুর; বাখাই-মধ্যনগর যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ)।
১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে তারাকান্দায় বঙ্গবন্ধু কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। [আলী আহাম্মদ খান আইয়োব ও মোহাম্মদ আলী জুয়েল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!