মুক্তিযুদ্ধে তাড়াশ উপজেলা (সিরাজগঞ্জ)
তাড়াশ উপজেলা (সিরাজগঞ্জ) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রতি সারা পূর্ববাংলার মানুষের মতো তাড়াশের জনমনেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৬-দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে। সে-সময়ের ৬-দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন তাড়াশ থানায় ব্যাপকতা লাভ করে। তখন ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন- ম ম আমজাদ হোসেন মিলন, অধ্যাপক ফলার রহমান, এডভোকেট আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন সরকার, অধ্যাপক ফজলু মিঞা, অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন, এ মোবারক হোসেন, মো. হাবিবুর রহমান তাড়াশী, মো. আফজাল হোসেন, এডভোকেট মহাসিন আলী, মীর সালাম প্রমুখ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে বাঙালিদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে পাকবাহিনী বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এ গণহত্যার বিরুদ্ধে তাড়াশে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এ দেয়া দিকনির্দেশনা থেকে তাড়াশে ছাত্র-জনতা কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু হয়। তাড়াশের ছাত্রনেতারা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১০৭টি সিভিল গান (বন্দুক) একত্রিত করে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন গাজী আব্দুর রহমান মিঞা, গাজী এম মোবারক হোসেন, গাজী আব্দুল বাছেদ, ওসমান গণি প্রমুখ। থানার থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ব্যবহার করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
মো. আতাউর রহমান, আব্দুর রহমান মিঞা এবং এম মোবারক হোসেন অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে স্থানীয়ভাবে তাড়াশের নওগাঁ ইউনিয়ন এলাকায় গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। সিরাজগঞ্জের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জার পরিচালনায় কামারখন্দের ভদ্রঘাট ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়াগাঁতী গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে পলাশডাঙ্গা যুবশিবির- প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে সাহরাপ হোসেন সরকার, ছাত্রনেতা বিমল কুমার দাস, আব্দুল আজিজ সরকার, আব্দুল আজিজ মির্জা এবং লুৎফর রহমান অরুণ মিলে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভদ্রঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এখানে তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে তাড়াশ থানার মুক্তিযোদ্ধারা কেবল প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি, স্থানীয় জনতার সহায়তায় হাজার- হাজার শরণার্থী যারা তাড়াশ দিয়ে ভারতসহ অন্যান্য স্থানে যাচ্ছিল তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন। তাড়াশ থানার চিকিৎসক-মুক্তিযোদ্ধা গাজী সিরাজ উদ্দিন খান তাঁর নিজের ডিসপেনসারি থেকে ঔষধ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেন এবং ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেন। তাড়াশে পাকবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠার পর ম ম আমজাদ হোসেন মিলন, মো. আফজাল হোসেন, আব্দুস সোবাহান, আমিরুজ্জামান খোকন এবং আরশেদুল ইসলাম তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা দেশে এসে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন।
তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করে অস্ত্র, গোলাবারুদ মাইন ও বিস্ফোরকসহ আব্দুল লতিফ মির্জা পরিচালিত পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন ও আব্দুল রহমান মিঞা ছিলেন যথাক্রমে সহ- অধিনায়ক ও প্লাটুন কমান্ডার। প্রশিক্ষক প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আব্দুল বাছেদ ও মো. জিন্নাহ। সেকশন কমান্ডার ছিলেন গাজী আফজাল হোসেন, গাজী আমিরুজ্জামান খোকন, গাজী মোবারক হোসেন, আতাউর রহমান, গাজী ওয়াজেদ আলী আজাদ, সাইদুর রহমান প্রমুখ। তাড়াশ থানায় মুক্তিযুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় বাহিনী ছিল পলাশডাঙ্গা যুব শিবির। অত্র এলাকায় এ বাহিনীর ব্যাপক কার্যক্রম ছিল।
কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই পাকবাহিনী তাড়াশে অনুপ্রবেশ করে। তবে তাড়াশে পাকবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাঘাবাড়ী ও উল্লাপাড়া তাদের দখলমুক্ত রাখার লক্ষ্যে বগুড়ার এঁড়ের বাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তাতে তাড়াশের প্রায় ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। ২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনী তাড়াশে অনুপ্রবেশ করে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন শুরু করে। তাড়াশে তাদের স্থায়ী কোনো ক্যাম্প ছিল না। তারা বগুড়া থেকে এসে তাড়াশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালাত।
তাড়াশ থানায় মোট ৩৫০ জন রাজাকার-আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। তারা থানা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছিল। তারা পাকসেনাদের পথ দেখাত ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর সম্পর্কে তথ্য দিত। তাদের মধ্যে শান্তি কমিটির সদস্য মওলানা মফিজ উদ্দিন আল মাদানী হিন্দুদের সম্পদ গনিমতের মাল এ ফতোয়া দিয়ে লুটতরাজে মদত দিত। রাজাকাররা বিভিন্ন গ্রামে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হাটবাজারে অত্যাচার চালাত। তাদের অনেকে যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের হাতে নিহত হয়। এ থানার অন্তত ৩ জন রাজাকার পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে অস্ত্রসহ পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরে আত্মসমর্পণ করে এবং পরে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেয়।
তাড়াশের রাজাকাররা হলো- মজিবর রহমান খন্দকার (তাড়াশ), শামসুর রহমান তালুকদার (দোবিলা), কাওসার আলী মাদানী (বস্তল), আজাহার আলী সরকার (তাড়াশ), তছের আলী (চকজয়কৃষ্ণপুর), হযরত আলী (কুমারপাড়া), আফছার আলী আকন্দ (সোনাপাতিল), আজাহার আলী (হামকুড়িয়া, মাগুড়াবিনোদ), আবুল খায়ের ওবায়দুল্লা (বস্তল, বারুহাস), মোশারফ হোসেন সরকার, মোজদার হোসেন (বস্তল, বারুহাস), আব্দুল খালেক সরকার (বস্তল, বারুহাস), জহুরুল হক (বস্তল, বারুহাস), হযরত আলী (বস্তল), হযরত আলী (বস্তল), ইসহাক আলী (বস্তল), আবুল কালাম দুদু (বস্তল, বারুহাস), আকরাম আলী (বস্তল), দেলোয়ার হোসেন ধনু (বস্তল), আবু বক্কর (বস্তল), শাহ আলম (বস্তল), আবুল কালাম (বস্তল), ইয়াসিন আলী (বস্তল), আয়েজ উদ্দিন (বস্তল), ছেফাত আলী (কুমারপাড়া, মাধাইনগর), মোকবুল সরকার (সোনাপাতিল), আবু জাফর সরদার (সোনাপাতিল), রওশন আলী (সোনাপাতিল), আলতাব হোসেন আকন্দ (সোনাপাতিল), আব্দুল মোমিন (সোনাপাতিল), আলী হাসান (সোনাপাতিল), নেজাব আলী মণ্ডল (সোনাপাতিল), জয়নাল আলী (সোনাপাতিল), নিজাম উদ্দিন (সোনাপাতিল), শব্দের আলী (সোনাপাতিল), জয়নাল আবেদিন (সোনাপাতিল), মজিবুর রহমান (সোনাপাতিল), শওকত আলী (সোনাপাতিল), নিজাম উদ্দিন (সোনাপাতিল), মিজানুর রহমান (বোয়ালিয়া), আমজাদ হোসেন তালুকদার (সোনাপাতিল), আজম আলী তালুকদার (সোনাপাতিল), আজিজুল প্রামাণিক (সোনাপাতিল), জামাল উদ্দিন (সোনাপাতিল), পরব আলী (সোনাপাতিল), আবুল হোসেন প্রামাণিক (মাধাইনগর), আবুল হোসেন খাঁ (মাধাইনগর), ক্ষিদির আলী আকন্দ (মাধাইনগর), মছের আলী (চকজয়কৃষ্ণপুর, মাধাইনগর), আব্দুল মতিন মোল্লা (নওগাঁ), জয়নাল আবেদিন (বানিয়াবাহু), আব্দুর রহমান (নওগাঁ), মাছিম মোল্লা (হামিদপুর), শাহাদত হোসেন (চকজয়কৃষ্ণপুর), আব্দুল খালেক (চকজয়কৃষ্ণপুর), তমিজ উদ্দিন (চকজয়কৃষ্ণপুর), আব্দল জলিল মুন্সি (শিবপুর, বারুহাস), তাজের সরদার (ঘরগ্রাম, মাগুড়াবিনোদ), রিয়াজ উদ্দিন (সোনাপাতিল), আব্দুল মালেক (লালুয়ামাঝিড়া, সগুনা), মোকছেদ মৌলভী (তাড়াশ), আব্দুল মাজেদ, আব্দুর রউফ ওরফে হান্নান (তাড়াশ), আনোয়ার হোসেন মুন্সি (বিনসাড়া, বারুহাস), শমসের আলী (বিনসাড়া), সাইদার রহমান (কুন্দইল, সগুনা), মাওলানা বেলাল হোসেন (হেমনগর, সগুনা), ইব্রাহিম হোসেন (হেমনগর), আকবর আলী (হেমনগর), আব্দুল বারী (হেমনগর), নুরুল ইসলাম তোতা (হেমনগর), আনোয়ার হোসেন মোল্লা (হেমনগর), আব্দুল লতিফ (হেমনগর), রোস্তম আলী (হেমনগর), ইসমাইল হোসেন (হেমনগর), ইলবাস কামাল লালু (ঈশ্বরপুর, সগুনা), আফতাব উদ্দিন (ঈশ্বরপুর), খাজেম আলী খাঁ (ঈশ্বরপুর), আয়েজ উদ্দিন মোল্লা (ঈশ্বরপুর), আব্দুস সাত্তার (ঈশ্বরপুর), ফয়াজ উদ্দিন (নওখাদা, সগুনা), মোকসেদ আলী মোল্লা (নওখাদা), মোহাম্মদ আলী মোল্লা (নওখাদা), বেলাল হোসেন (নওখাদা), খোদা বক্স (নওখাদা), আবুল ড্রাইভার আব্দুল (নওখাদা), সোহরাব আলী খোরজান (নওখাদা), আব্দুস সামাদ (নওখাদা), আবুল হোসেন (নওখাদা), শাহজাহান আলী (সবুজপাড়া, সগুনা), সাইফুল ইসলাম (সবুজপাড়া), হাবিবুর রহমান (সবুজপাড়া), আছের আলী (সবুজপাড়া), মোবারক হোসেন জিগড়া (সবুজপাড়া), আবু মুছা ছানা উল্লাহ (সবুজপাড়া), আব্দুল করিম (সবুজপাড়া), শহীদ আলী (সবুজপাড়া), আবুল হোসেন, মওলা বক্স (সবুজপাড়া), ছালেম খন্দকার (সবুজপাড়া), আবু মুছা (সবুজপাড়া), দবির সরকার (সবুজপাড়া), হয়দার আলী (সবুজপাড়া), আজিজল হক (সবুজপাড়া), আব্দুল রহমান (সবুজপাড়া), আব্দুর রশিদ (মনোহরপুর, বারুহাস), আব্দুল মতিন (পেঙ্গুয়ারী, বারুহাস), আনোয়ার হোসেন (পেঙ্গুয়ারী), আবু জাফর (পেঙ্গুয়ারী), আকবর আলী (পেঙ্গুয়ারী), জয়নাল খন্দকার (পেঙ্গুয়ারী), আব্দুল খালেক খন্দকার (পেঙ্গুয়ারী), কুনি খাঁ (পেঙ্গুয়ারী), চান্দু (পেঙ্গুয়ারী), গোলবার হোসেন (দেবীপুর, মাগুড়াবিনোদ), কোবাদ আলী (সবুজপাড়া), আব্দুল লতিফ (পেঙ্গুয়ারী), আফছার আলী (নওখাদা), বেলাল হোসেন (নওখাদা), ওয়াজেদ আলী (নওখাদা), আমজাদ হোসেন (নওখাদা), হাছেন আলী (নওখাদা), শাহজাহান আলী মণ্ডল (হেমনগর), আব্দুস সামাদ (হেমনগর), ইয়াকুব আলী (হেমনগর), সামাদ আলী (চরকুশাবাড়ি, বারুহাস), শফিকুল ইসলাম ( চরকুশাবাড়ি), আবেদ আলী রফাতুল্লাহ (চরকুশাবাড়ি), শাম আহমেদ (চরকুশাবাড়ি), দবির উদ্দিন সরদার (চরকুশাবাড়ি), আব্দুস সাত্তার সরদার (চরকুশাবাড়ি), ইসলাম সরদার (চরকুশাবাড়ি), সাইদুর রহমান (কুন্দইল), কালু (চরকুশাবাড়ি), আজমত আল (চরকুশাবাড়ি), আব্দুল মজিদ (চরকুশাবাড়ি), মজনু (হেমনগর) প্রমুখ।
শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিল- শামসুর রহমান তালুকদার (মাগুড়াবিনোদ), মজিবুর রহমান (তাড়াশ), আলেফ আলী আকন্দ, আজগর আলী আকন্দ (সোনাপাতিল, মাধাইনগর), ময়েজ উদ্দিন মৌলভী (হেমনগর, সগুনা), মফিজ উদ্দিন আল মাদানী (বস্তল, বারুহাস), আজিজুর রহমান (চৌপাকিয়া, নওগাঁ), মীর মোশারফ হোসেন (কুন্দইল, সগুনা) প্রমুখ।
১১ই নভেম্বর তাড়াশ থানার নওগাঁ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১৩০ জন পাকসেনা, শতাধিক মিলিশিয়া ও রাজাকার নিহত হয়, যা নওগাঁ যুদ্ধ নামে পরিচিত
১১ই নভেম্বর নওগাঁ যুদ্ধের পর ১৩ই নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনী নওগাঁর সন্নিকটস্থ আমবাড়িয়া (ইউনিয়ন মাগুড়াবিনোদ) গ্রামে হামলা করে। তারা গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইয়ার মাহমুদসহ ১৩ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যা করে, যা আমবাড়িয়া গণহত্যা- নামে পরিচিত। গণহত্যার পর হানাদাররা গ্রামের প্রায় অর্ধশত বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। গণহত্যায় শহীদদের এ গ্রামেই গণকবর দেয়া হয়।
আমবাড়িয়া গণহত্যা ছাড়াও পাকবাহিনী ও রাজাকাররা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আরো অনেককে হত্যা করে। নিহতরা হলেন— ওসমান গনি (পিতা আব্দুর রহমান, উলিপুর), মতিয়ার রহমান (পিতা রফাতুল্লাহ, দিঘী সগুনা, লালুয়ামাঝিড়া), মাহতাব উদ্দিন খান (পিতা হাজী পানা উল্লাহ খান, মাগুড়াবিনোদ; নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়), হীরা লাল গোস্বামী (পিতা অবিনাশ গোস্বামী, তাড়াশ), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা ধনা প্রামাণিক, কাঁস্তা, ওয়াশীন), মহাদেব চন্দ্র সাহা (পিতা গণেশ চন্দ্র সাহা, তাড়াশ), দিনেশ চন্দ্ৰ সিংহ (পিতা গণেশ চন্দ্ৰ সিংহ), শচীন্দ্র নাথ ঘোষ (পিতা সতীশ চন্দ্র ঘোষ, তাড়াশ), সত্য দাস (পিতা হারু দাস, তাড়াশ), জমসের আলী (পিতা নিথুরিয়া প্রামাণিক, তাড়াশ), আমজাদ হোসেন (পিতা পরাই মণ্ডল, তাড়াশ) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আমবাড়িয়া গ্রামের অন্তত ৪৮ জনের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। যাদের বাড়ি পোড়ানো হয়, তারা হলেন- মো. দেছের আলী প্রামাণিক (পিতা আমানিয়া প্ৰামাণিক), মো. আবুল হোসেন প্রামাণিক (পিতা মো. মহির উদ্দিন প্রামাণিক), মো. সাহেব আলী (পিতা বছির প্রামাণিক), মো. নায়েব আলী (পিতা বছির প্রামাণিক) মো. মঞ্জিল হক মণ্ডল (পিতা শহিদ মেহের মণ্ডল), মো. হাসেন আলী (পিতা বছির প্রামাণিক), মো. লুৎফর রহমান (পিতা শহীদ ইয়ার মোহাম্মদ), মো. পাষাণ সেখ (পিতা গুল মাহমুদ সেখ), মো. আশরাফ আলী সেখ (পিতা শহীদ সুলতান সেখ), মো. সাইদুর রহমান (পিতা দেছের আলী প্রামাণিক), মো. মেনহাজ আলী প্রামাণিক (পিতা এনাম আলী প্রামাণিক), মো লোকমান সেখ (পিতা রজব আলী সেখ), মো. দবির উদ্দিন প্রামাণিক (পিতা নাদির প্রামাণিক), মো. আনসার আলী (পিতা রওশন আলী), মো. নছিমুদ্দিন প্রামাণিক (পিতা নইম উদ্দিন প্রামাণিক), মো. জীবন ফকির (পিতা টোনা ফকির), মো. শোভন ফকির (পিতা টোনা ফকির), মো. আব্দুর রহিম (পিতা শহীদ জুব্বার ফকির), মো. মহির উদ্দিন প্রামাণিক (পিতা আমানিয়া প্রামাণিক), মো. হবিবুর রহমান (পিতা শহীদ আমিন প্রামাণিক), মো. আলীম উদ্দিন (পিতা কাজেম প্রামাণিক), মো. আব্দুল ফকির (পিতা বদিয়া ফকির), মো. সেরাজুল হক (পিতা চাঁদ আলী), শব্দের আলী সরদার (পিতা আকালিয়া সরদার), মো. সানাউল্লাহ (পিতা হারুনর রশিদ প্রামাণিক), মো. আব্দুল হাকিম (পিতা অমিত প্রামাণিক), মোছা. মরিয়ম বেগম (স্বামী শহীদ আব্দুর রহমান), মো. আছের আলী (পিতা চিলন প্রামাণিক), চিলন প্রামাণিক (পিতা রয়েজ উদ্দিন প্রামাণিক), মিলন প্রামাণিক (পিতা রয়েজ উদ্দিন প্রামাণিক), ইজ্জত আলী প্রামাণিক (পিতা রয়েনদি উদ্দিন প্রামাণিক), মোছা. খইরন বেওয়া (স্বামী ওসমান আলী), মো. আলী আহম্মদ (পিতা শহীদ মোক্তার হোসেন), মো. রবিউল করিম (পিতা শহীদ ফজলার রহমান), কায়েম উদ্দিন (পিতা হুজুর আলী), আবু শামা প্রামাণিক (পিতা শহীদ কিসমত আলী), মো. আনোয়ার হোসেন (পিতা শহীদ মজিবর রহমান), মো. শুকুর আলী (পিতা আবির আলী), মো. ফরজ আলী (পিতা মো. জানিক প্রামাণিক), মো. নুরুল ইসলাম (পিতা ময়াজ ফকির), মো. আবেদ আলী প্রামাণিক (পিতা কদম আলী), মো. সাদেক আলী প্রামাণিক (পিতা কদম আলী), মো. আব্দুল করিম মোল্লা (পিতা সেকেন্দার মোল্লা), মো. কাদের ফকির (পিতা গোদাই ফকির), মো. নওফেল সেখ (পিতা রজব আলী সেখ), মো. আফছার আলী (পিতা আবেদ আলী), মো. মাদারী মোল্লা (পিতা বেচন মোল্লা) ও মো. সাদারী মোল্লা (পিতা বেচন মোল্লা)। পাকবাহিনী আমবাড়িয়া ছাড়াও নওগাঁ ইউনিয়নের অন্য বহু গ্রামে রাজাকারদের সহযোগিতায় অগ্নিসংযোগ করে। কাস্তার রাজাকাররা ইয়াছিন আলীকে গুলি করে হত্যা করে। অন্য অনেক স্থানীয় লোক তাদের হাতে নির্যাতিত হন।
তাড়াশ উপজেলায় একটি গণকবর রয়েছে – আমবাড়িয়া গণকবর। আমবাড়িয়া গণহত্যায় নিহতদের এখানে কবর দেয়া হয়।
তাড়াশ থানায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে তাড়াশ থানা আক্রমণ ও নওগাঁ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ ও অন্যান্য জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত তাড়াশা থানা আক্রমণ এ এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল। অস্ত্র সংগ্রহ করা এবং পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষ্যে এ অপারেশন পরিচালিত হয়। এটি একটি সফল অভিযান ছিল। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ অভিযান পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পিতভাবে এ থানা আক্রমণ করেন।
চাটমোহর থানার হান্ডিয়াল ও তাড়াশ থানার নওগাঁ এলাকা থেকে প্রায় ১ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা বিকেল ৫টার দিকে নৌকাযোগে তাড়াশ থানা অভিমুখে রওয়ানা হন। নৌকাগুলোকে আগে থেকে বিভিন্ন উপদলে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যার পর অন্ধকার গাঢ় হলে মুক্তিযোদ্ধারা থানার সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী যাঁর- যাঁর অবস্থান নেন। থানার ভেতরে থাকা পুলিশরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোম্পানি কমান্ডার অস্ত্রের কোত দখল করে নেন। ওখানে এক পুলিশ আক্রমণ করার চেষ্টা করলে সে গুলিতে নিহত হয়। খুব দ্রুত মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশ ও রাজাকারদের সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেন। পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। তারা সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে এবং যাদের সামর্থ্য আছে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে এ নিশ্চয়তা দিলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। থানা থেকে ২০টির বেশি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
১১ই নভেম্বর নওগাঁ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভোর ৫টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ-যুদ্ধ চলে। আবদুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে এ-যুদ্ধে প্রায় ৫ শত মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। অপরদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩ কোম্পানি সেনা ও মিলিশিয়া এবং কয়েশ রাজাকার এতে অংশ নেয়। নওগাঁ যুদ্ধে ১৩০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় উত্তরবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১৩ই ডিসেম্বর তাড়াশ উপজেলা পাকহানাদারমুক্ত হয়। তাড়াশ মুক্ত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা থানার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, শরণার্থী পুনর্বাসন, লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার প্রভৃতি কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাড়াশের সকল মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ও জাতীয় নেতা এম মুনসুর আলীর নিকট অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান।
তাড়াশ উপজেলায় দুজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা করেন। তাঁরা খাবার তৈরি, তথ্য আদান- প্রদানসহ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। এ দুজন বীরাঙ্গনা হলেন— পচি বেওয়া (তাড়াশ) ও মোছা. পাতাসী বেগম (মাগুড়াবিনোদ)।
মুক্তিযুদ্ধে পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অবদান এবং উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে তাড়াশের নওগাঁতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলার এলজিইডি বিভাগ আমবাড়িয়া গণকবর পাকা দেয়ালের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছে। [সোহেল রানা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড