You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণহত্যা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণহত্যা ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জঘন্য ও নারকীয় গণহত্যা। তাদের এ সামরিক অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট। পূর্ব পরিকল্পিত এ সামরিক অভিযান আরম্ভ হয়েছিল রাত ১২টার পরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিমান নিরাপদে করাচি পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে। ঢাকায় সামরিক অভিযানের দায়িত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্বর পাকিস্তনি বাহিনীর আক্রমণের বিশেষ টার্গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নামানো হয় ১৮ ও ৩২ পাঞ্জাব এবং ২২ বালুচের একটি করে ৩ কোম্পানি (৪ শতাধিক) সৈন্য, যাদের দায়িত্ব ছিল জহুরুল হক হল (তখনকার ইকবাল হল) ও জগন্নাথ হলসহ অন্যান্য টার্গেট সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। এখানকার অপারেশনের নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল তাজ। ২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে একটানা ৩৬ ঘণ্টার অধিক সময় চলে পাকবাহিনীর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসলীলা। এ-সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আক্রান্ত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসের গতি পরিবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেবলমাত্র প্রজ্ঞার প্রদীপ্ত আলো জ্বালানোর মধ্যেই এই সুমহান বিদ্যাপীঠের অবদান সীমিত ছিল না, তার চেতনার শাণিত তরবারি ঝলসে উঠেছে জাতির প্রয়োজনে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে, ১৯৪৮ ও ৫২-র ভাষা-আন্দোলন-এর মাধ্যমে যার সূত্রপাত; উন্মোচিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বরূপ। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্ফুরণ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে তৎকালীন ছাত্র সংগঠনসমূহের নেতৃত্বে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর (UOTC)-এর ডামি রাইফেল দিয়ে চলে প্রশিক্ষণ। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়ে ওঠে পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল।
১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রীডার মুহাম্মদ মোহর আলী তৎপর হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত গণহত্যাকে তারা আড়াল করার বা অপব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। লন্ডন টাইমস্-এ ৭ই জুন প্রকাশিত তাদের বক্তব্যে জগন্নাথ ও জহুরুল হক হল (ইকবাল হল) সম্পর্কে যা ছিল : ‘Iqbal Hall and Jagannath Hall at Dacca University had been turned into arsenals by Awami League volunteers, but very few students slept in their rooms during these weeks in March.’ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয় যে, ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এটি ঠিক যে, জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হল ছিল আওয়ামী লীগ-এর শক্তিশালী ঘাঁটি। তবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ এরূপ বক্তব্য ছিল কেবলই সত্যের অপলাপ।
মেশিনগানের গুলি ছুড়ে, হলের ভেতর এবং আঙ্গিনায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শত্রুদুর্গ দখলের কায়দায় জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল, রোকেয়া হল, ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) ইত্যাদি লক্ষ্যবস্তুর ওপর ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশনকালে তারা হলের প্রতিটি কক্ষে হানা দেয়। সিঁড়ির নিচ, আনাচ-কানাচ, ছাদ, ড্রেন, হলের নিম্নশ্রেণির কর্মচারীদের কোয়ার্টার্স, শিক্ষকদের আবাসস্থল কোনো কিছুই তাদের তাণ্ডবের হাত থেকে রেহাই পায়নি। রক্ষা পায়নি ছাত্রদের সেবায় নিয়োজিত মেস স্টাফ, ধোপা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়িগণ। ছাত্রদের যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই তাদের হত্যা করেছে। হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েও ছাত্ররা পাকিস্তানি সেনাদের হত্যার কবল থেকে রক্ষা পায়নি। হলে অবস্থানকারী বহিরাগতরাও তাদের হত্যার নির্মম শিকার হন।
জগন্নাথ হল: ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নারকীয় গণহত্যার প্রধান শিকার জগন্নাথ হল ও জহুরুল হক হল হলেও, ঘটনার ব্যাপকতা মারাত্মক ছিল জগন্নাথ হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ্ হল) এ দুটি ছিল হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরায় ১৯৫৭ সাল হতে জগন্নাথ হল হয় হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের আবাসিক স্থল। ভারত বিভাগ ও অন্যান্য কারণে জগন্নাথ হলের ছাত্রবৃন্দের একটি। উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং তাদের। অধিকাংশেরই পড়াশুনা নির্ভর করত গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে অর্জিত অর্থে। অন্যদিকে ঢাকা শহরের মুসলিম সম্প্রদায় তাঁদের মেয়েদের গৃহশিক্ষকতার কাজে অগ্রাধিকার দিতেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের। ফলে গৃহশিক্ষকতার কাজে জগন্নাথ হলের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের ছিল প্রাধান্য। তাই ছুটিতেও তারা ছাত্রাবাসে থাকত।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে ইউওটিসি-র দিক থেকে জগন্নাথ হলের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে এবং সেখান থেকে উত্তর বাড়ির দিকে মর্টারের গুলি ছোড়ে। মর্টারের গুলি একটি আম গাছে প্রথম আঘাত করায় বাড়ির দেয়ালে একটি গর্তের সৃষ্টি হয়। এর পরপরই শুরু হয় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। এরই মধ্যে পাকবাহিনীর ট্যাঙ্ক জগন্নাথ হলের মাঠের মধ্যে চলে আসে। এভাবেই সূচনা হয় জগন্নাথ হল আক্রমণের প্রথম পর্বের। হানাদার বাহিনী লাউড স্পিকারের মাধ্যমে উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে সকলকে বেড়িয়ে আসার নির্দেশ দেয়। জগন্নাথ হলের প্রায় সকল ছাত্রই তখন নিদ্ৰায়। আকস্মিকভাবে অবিরাম ও নির্বিচার গুলিবর্ষণে তাঁরা জেগে উঠে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যে যেভাবে পারে পালানোর চেষ্টা করে। ছাত্রদের একাংশ উত্তর বাড়ির ছাদে জলের ট্যাংকের নিচে, কেউবা শৌচাগারে, কেউ নিজের চৌকির নীচে, কেউ জলের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে ম্যানহোল অথবা কর্মচারীদের গৃহ ইত্যাদি স্থানে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। হানাদাররা ইতোমধ্যে উত্তর বাড়ির নিকট টিন শেডের ওয়েস্ট হাউস ও বর্তমান পূর্ব বাড়ির জায়গায় ক্যান্টিন ও সংলগ্ন টিন শেডের ছাত্রাবাসে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা শূন্যে ইলুমিনেটিং গুলি ছুড়ে সমস্ত স্থান আলোকিত করে পলায়নপর ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। ক্যান্টিন ও সংলগ্ন টিন শেডের ছাত্রাবাসে আগুন দেয়ার ফলে সেখানে বসবাসরত ছাত্রদের একজন নিকটস্থ একটি পরিত্যক্ত শৌচাগারে আশ্রয় নেয়। এভাবে সে বেঁচে যায়। ভোর হবার পূর্ব পর্যন্ত পাকবাহিনী জগন্নাথ হলের কোনো ভবনেই প্রবেশ করেনি। জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে অবস্থান করে বিভিন্ন ভবনের দিকে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। এর মধ্যে সকাল হয়ে যায়, ভেসে আসে পবিত্র আযানের ধ্বনি। সকাল বেলা হলের তালা ভেঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই হত্যা করে দারোয়ানদের। চতুর্দিকে ভারি বুটের শব্দ, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ এবং অবিশ্রান্ত গুলির আওয়াজ। এরপর হানাদাররা জগন্নাথ হলের উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ছাত্রদের খোঁজ করে, কক্ষের অভ্যন্তরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, শৌচাগার ও স্নানাগার ইত্যাদি স্থানে তল্লাশি চালায় এবং যাকে যেখানে পায় তাকেই সেখানে গুলি ও বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করে। একই সঙ্গে চলে উর্দু ভাষায় ‘বাঙালি’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ সম্পর্কে অশ্লীল গালি-গালাজ। হলের বিভিন্ন তলায় পড়ে থাকে ছাত্রদের মরদেহ। জল্লাদ পাকবাহিনীর কয়েকজন ছাদে উঠে যায়। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির ছাদে উত্তোলন করা ছিল কালো পতাকা ও বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা। পাকসেনারা ঘৃণাভরে পতাকাদুটি টুকরো- টুকরো করে ফেলে দেয়। উপেন্দ্রচন্দ্র রায়, সত্য দাস, রবীন, সুরেশ দাসসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে হায়েনার দল। এ পরিস্থিতিতে উপেন্দ্রচন্দ্র রায় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে পড়লে সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে গুলি করা হয়। মৃত অবস্থায় তাঁর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷ অশ্লীল ও অশ্রাব্য গালি দিয়ে ছাত্রদের ছাদের ওপর লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর জল্লাদের দল গুলি চালায়। পরে শহীদ ছাত্রদের মরদেহ ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়।
২৫শে মার্চ রাতে জগন্নাথ হল ও শহীদ মিনার আবাসিক এলাকায় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও বহিরাগত অতিথি মিলে ৭০ জনকে হত্যা করা হয় এবং গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। ঐ ৭০ জনের মধ্যে ৩ জন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র ও ৪ জন ছিল হলের কর্মচারী। শহীদ ৩ জন শিক্ষক হলেন- ড. এ এন এম মুনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), ড. গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেব (জি সি দেব; দর্শন) ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিজ্ঞান)। ড. এ এন এম মুনিরুজ্জামানের পুত্র ও কয়েকজন আত্মীয়কেও হত্যা করা হয়। ২৭শে মার্চ নিজ বাসভবনের বাইরে গুলিবিদ্ধ হন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি)। তাঁকে ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐদিন নিবন্ধের লেখক ডা. এম এ হাসান তাঁকে হাসপাতালের ৭নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পান। ৩০শে মার্চ গুহঠাকুরতা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক মধুসূদন দে (মধুদা)- র বাড়ি আক্রমণ করে তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূসহ তাঁকে হত্যা করে। শিববাড়ির ৫ জন সাধুকেও বর্বর পাকসেনারা অন্যান্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। নিহত সাধুরা হলেন- মাধব চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী, রাজেন ব্রহ্মচারী, সরোজা ব্রহ্মচারী, রামধনী ব্রহ্মচারী ও স্বামী মুকুন্দানন্দ স্বরস্বতী। তাঁদের সঙ্গে শঙ্কর কুরী, ভীর রায়, মনীরাম ও বোধিরাম এ ৪ জনকেও হত্যা করা হয়। ততক্ষণে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ির বিপরীত দিক থেকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. নূরুল উল্লাহ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে তাঁর ভিডিও ক্যামেরায় তুলছেন গণহত্যার ছবি। তাঁর ভিডিওতে দেখা যায়, লাইনে দণ্ডায়মান ছাত্র, কর্মচারী, কিশোর, যুবক, সাধু ও ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমান অনেকেই ঈশ্বর বা আল্লাহকে প্রার্থনা করছেন এবং করজোড়ে প্রাণভিক্ষা করছেন। কিন্তু পাক জল্লাদ বাহিনীর মন তাতে একটুও টলেনি। পাকসেনাদের ছোড়া গুলিতে লাইনে দাঁড়ানো প্রায় সকলেই লুটিয়ে পড়েন জন্মভূমির মাটিতে।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ঢাকায় সংঘটিত হিন্দু- মুসলমান সাম্প্রদায়িক ও বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার সময় জগন্নাথ হলে আশ্রয় নেয় বেশকিছু অমুসলিম পরিবার। এই অমুসলিম পরিবারের অনেকেই পরবর্তীকালে চলে গেলেও একটা অংশ জগন্নাথ হলে বস্তি বানিয়ে বসবাস করতে থাকে কালক্রমে এদের বড় একটা অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। শেষ পর্যন্ত এদের ঠিকানা হয়ে যায় জগন্নাথ হল। বস্তিবাসীদের একাংশ অমুসলিম হলেও বাঙালি ছিল না এবং এরা উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারত। উর্দুভাষী এসব বস্তিবাসীদের প্রথমে আশ্বস্ত করা হয় যে, হানাদার বাহিনীর কাজে সহযোগিতা করলে তাদের হত্যা করা হবে না। হানাদার পাকসেনারা সকালে তাদের বস্তিতেও আগুন লাগিয়ে দেয়। আতঙ্কগ্রস্ত হলের কর্মচারী ও এসব বস্তিবাসীদের ওপর রাইফেল তাক করে তাদের লাশ সরানোর কাজে নিয়োজিত করে হায়েনার দল। তাদের ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলো একস্থানে জড়ো করার কাজে লাগায়। ধরে আনা বেশ কয়েকজন ছাত্রকেও হানাদার বাহিনী মৃতদেহ বহনের কাজে লাগায়।
তারা ওপর মহলের ইঙ্গিতে সকল মৃতদেহ একটি স্থানে পুঁতে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে সুবিধাজনক স্থান হিসেবে জগন্নাথ হলের প্রশস্ত মাঠকে বেছে নেয়। মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণায় তাদের দিয়ে বিরাট গর্ত খুঁড়িয়ে লাশ ফেলানো হয়। লাশ ফেলার কাজ শেষ হলে এ কাজে নিয়োজিতদের গুলি করে গণকবরের গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেয়া হয়। সেখানে কারো হাত, কারো পা মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসা অবস্থায় ২৭শে মার্চ পর্যন্ত থাকতে দেখা যায়। পরে বুলডোজারের সাহায্যে লাশগুলোকে মাটির গভীরে ঠেলে দেয়া হয়। লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের মধ্য থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন পরিমল গুহ ও আইনের ছাত্র সুরেশ দাস।
জগন্নাথ হলের যে ৩৬ জন ছাত্র সেদিন পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়ে গণকবরে স্থান পায়- তাঁরা হলেন- উপেন্দ্রনাথ রায়, কিশোরীমোহন সরকার, কার্তিক শীল, কেশবচন্দ্র হাওলাদার, গণপতি হালদার, ননীগোপাল ভৌমিক, জীবনকৃষ্ণ সরকার, নির্মলকুমার রায়, নিরঞ্জন প্রসাদ সাহা, প্রদীপনারায়ণ রায়চৌধুরী, নিরঞ্জন হালদার, বরদাকান্ত তরফদার, বিধানচন্দ্র ঘোষ, মুরারীমোহন বিশ্বাস, বিমলচন্দ্র রায়, মৃনালকান্তি বোস, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, রমণীমোহন ভট্টাচার্য, রণদাপ্রসাদ রায়, রাখাল রায়, শিবকুমার দাস, সন্তোষচন্দ্র রায়, রূপেন্দ্রনাথ সেন, শিশুতোষ দত্ত চৌধুরী, সত্যরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তী, সুচিত দত্ত, সুশীল চন্দ্ৰ দাস, স্বপন চৌধুরী, হরিনারায়ণ দাস, অজিত রায়চৌধুরী, নিরঞ্জন চন্দ, প্রবীর পাল, ভবতোষ ভৌমিক, সত্যরঞ্জন নাগ ও সুব্রত সাহা। এছাড়া যে-সমস্ত কর্মচারী ও অতিথি সেদিন নিহত হন, তাঁরা হলেন— মধুসূদন দে, সুশীল চন্দ্র দে, খগেন্দ্ৰ চন্দ্ৰ দে, মতিলাল সেন, দাশু রাম, মিস্ত্রি রাজভর, মনভরণ রায়, প্রিয়নাথ রায়, সুনীল চন্দ্র দাস, শিবপদ কুড়ী, দুঃখী রাম মণ্ডল, জহরলাল রাজভর প্রমুখ।
সেদিনের এ ঘটনার যারা সাক্ষী, তারা হলেন- সুরেশ দাস, তপন বর্ধন, হরিধন দাস, রাধানাথ ভৌমিক, শেখর কুমার চন্দ, দেবী নারায়ণ রুদ্রপাল, বাদল কান্তি দাস, বেনেডিক্ট ডায়াস, যশোদা জীবন সাহা, রানু রায় (দে), অরুণ দে, চান্দ দেব রায়, মোহন, শ্যামলাল, কেশব চন্দ্র পাল, রেনুবালা দে, রাজকুমারী দেবী (বিন্দুর মা), চিল্লী, ইদু মিয়া, ধীরেন্দ্র চন্দ্র দে, ড. রবীন্দ্রনাথ ঘোষ ঠাকুর, ড. অজয় রায়, আব্দুল বারী, মাহমুদ হাসান, গোপালচন্দ্র দে, বনজকুমার চক্রবর্তী, পরিমল গুহ, ড. নূরুল উল্লাহ, পূর্ণচন্দ্র বসাক, বাসন্তী রাণী গুহঠাকুরতা, রোকাইয়া সুলতানা, গোপালকৃষ্ণ নাথ, কালীরঞ্জন শীল, কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ।
ঐদিন শহীদ হওয়া জি সি দেবের পালিত কন্যা রোকাইয়া সুলতানার স্বামী মোহাম্মদ আলী শহীদ হন। রোকাইয়া সুলতানা ২৭শে মার্চ লেখক ডা. এম এ হাসানকে জানান যে, ঘাতকরা ড. দেবের নাম উচ্চরণ করেই ড. দেবকে আড়াল করা মোহাম্মদ আলীকে প্রথমে হত্যা করে। অতঃপর ড. দেবকে হত্যা করে। রোকাইয়া সুলতানার স্বামী মোহাম্মদ আলী ও অধ্যাপক দেবকে এক সঙ্গে মাটিচাপা দেয়া হয় জগন্নাথ হলের গণকবরে। ড. দেবকে হত্যার সময় ভয়াবহ হিন্দুবিদ্বেষী নানা ঘৃণার বাণী তারা উচ্চারণ করে। একই দিন ঐ রাতে ভয়াবহ আহত এবং পরে মৃত ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতার বক্তব্যেও উঠে আসে সেদিন কীভাবে ইয়ামিন নামে এক পাকিস্তানি সেনা অফিসার ইংরেজিতে ড. গুহঠাকুরতার নাম নিশ্চিত হয়ে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে। এটি ঘৃণ্য গণহত্যার জ্বলন্ত উদাহরণ। জহুরুল হক হল (সাবেক ইকবাল হল): বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল জহুরুল হক হল। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গত কারণেই মুসলিম ছাত্রদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলে ১৯৫৫ সালে ছাত্রদের বসবাসের জন্য একটি টিনের চালাঘর নির্মাণ করা হয়। এখানেই ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় দ্বিতল ছাত্রাবাস, যার সরকারি নির্দেশে নামকরণ করা হয় ইকবাল হল। মুক্তিযুদ্ধের পর ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করা হয় জহুরুল হক হল। সার্জেন্ট জহুরুল হক (১৯৩৫-১৯৬৯) ছিলেন আগরতলা মামলার ১৭ নম্বর আসামি, যাঁকে পাকসেনারা ১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বন্দি অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করে। তখন চলছিল আইয়ুববিরোধী গণ-অভ্যুত্থান। সঙ্গে-সঙ্গে ছাত্ররা এ হলের নাম পাল্টিয়ে জহুরুল হক হল নাম রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি সচেতন ছাত্রদের বড় একটি অংশ এ হলে বসবাস করতেন। ফলে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকসেনারা জগন্নাথ হল আক্রমণের প্রায় কাছাকাছি সময়ে জহুরুল হক হলে আক্রমণ চালায়। অর্থাৎ, জগন্নাথ হল ও জহুরুল হক আক্রান্ত হয় প্রায় একই সময়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রমণের পূর্বে জহুরুল হক হলে এসে সিনিয়র ছাত্রনেতৃবৃন্দ সেখানে অবস্থানরত ছাত্র ও কর্মচারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের এ বার্তা ছিল বিলম্বিত, ফলে পাকসেনাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে অনেকেই নিষ্কৃতি পাননি। পাকবাহিনী জহুরুল হক হল আক্রমণ করতে পারে- এ আশঙ্কায় ছাত্রাবাসের আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং ছাত্রাবাসে প্রবেশের মূল গেটও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হত্যাযজ্ঞে উন্মত্ত পাকসেনারা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সমগ্র এলাকা আলোকিত করে তোলে এবং এরপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।
হানাদার বাহিনী প্রথমেই জহুরুল হক হল সংলগ্ন রেল- লাইনের পাশের বস্তিতে অগ্নিসংযোগ করে। মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠলে প্রাণ রক্ষার্থে বস্তিবাসীরা বেড়িয়ে এসে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের ওপর চলে নির্বিচারে গুলি। ফলে বহু সংখ্যক নিরপরাধ মানুষ এখানে গণহত্যার শিকার হয়। জহুরুল হক হলের ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষদর্শী নাজির আহমেদ, ফজলুল হক ও আবদুল মোমিন মিয়া। পাকিস্তানি বাহিনী জহুরুল হক হল এলাকায় প্রবেশ করে ট্যাঙ্ক নিয়ে। তারা মর্টার দিয়ে নির্বিচারে দীর্ঘক্ষণ গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু কোনো পাল্টা গুলির আওয়াজ না পেয়ে এক পর্যায়ে পাকবাহিনী গেট ভেঙ্গে জহুরুল হক হলের মধ্যে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে হলের দুজন ছাত্র চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান ও আবু তাহের পাঠানকে হত্যা করে। চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান পালিয়ে যাবার সময় ধরা পড়লে তাঁকে ডাইনিং হলের পাশে নিয়ে গুলি করা হয়। অন্যদিকে আবু তাহের পাঠানকে তাঁর নিজের কক্ষেই হত্যা করা হয়। আবু তাহের পাঠানের মরদেহ দুদিন হলের অভ্যন্তরেই পড়েছিল। কর্মচারী শামসু মিয়া ও আবদুল জলিলও ২৬শে মার্চ জহুরুল হক হলে শহীদ হন। শামসু মিয়াকে প্রথমে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে এবং পরে দেহ লেপ দিয়ে মুড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এ টি এম জাফর আলম ২৫শে মার্চ রাতে জহুরুল হক হলে শহীদ হন।
জগন্নাথ হলে পাকবাহিনীর গণহত্যার শিকার ছাত্র ও কর্মচারীদের একটি আনুমানিক সংখ্যা প্রদান করা সম্ভব হলেও জহুরুল হক হল এলাকায় গণহত্যার শিকার মানুষের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে এ হলে অধিক সংখ্যক ছাত্র নিহত হয়। সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষক এবং একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ইংরেজি বিভাগের যথাক্রমে কমরুদ্দীন আহমেদ ও মুনিমকে ২৬শে মার্চ সকালে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায় জহুরুল হক হলের মাঠে। সেখানে তাঁরা বহুসংখ্যক লাশ দেখতে পান। বিদেশী সাংবাদিক মাইকেল লরেন্ট ও পিটার হ্যাজেলহাস্টের প্রতিবেদনেও জহুরুল হক হলের মাঠে বহুসংখ্যক স্তূপীকৃত লাশের উল্লেখ রয়েছে। ২৭শে মার্চ দুপুরে নিবন্ধের লেখক ডা. এম এ হাসান জহুরুল হক হলের ফুটবল মাঠের পূর্বদিকে গোল পোস্টের কাছে ৩ সারি ছাত্র, কর্মচারী ও অন্যদের লাশ দেখতে পান। পাকবাহিনী অনেকের মৃতদেহ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বাকিদের ধাঙ্গরদের সহায়তায় ট্রাকে করে নিয়ে পুরান ঢাকার ধলপুর ময়লা ডিপোতে মাটিচাপা দেয়া হয়।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল : পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরুর প্রাক্কালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অবস্থানরত ছাত্রের সংখ্যা ছিল তুলামূলকভাবে কম। এ হলে পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষদর্শী অধ্যাপক কমরুদ্দীন আহমেদ (আইন বিভাগ), অধ্যাপক মুনিম (ইংরেজি বিভাগ) এবং ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মফিজুল্লাহ কবির। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সলিমুল্লাহ হল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের বাড়ি চলে যাবার পরামর্শ দেন। এরূপ পরামর্শ দানের পেছনে মূলত দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ক্যাম্পাসের উত্তপ্ত পরিস্থিতি, ছাত্রদের যে-কোনো সময় গ্রেপ্তার হবার সম্ভাবনা ছিল। অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকার খাদ্য সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় হলের ডাইনিং খোলা রাখা অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ সকাল ৭টার দিকে হানাদার বাহিনী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে প্রবেশ করে। তারা চেয়ারে বসা অবস্থায় অধ্যয়নরত একজন ছাত্রকে এবং বাগানে ধরে নিয়ে অপর এক ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে শহীদ ছাত্রদের পঁচাগলা বিকৃত লাশ ৪-৫ দিন পর ঢাকা পৌরসভার সুইপাররা তুলে নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গর্ত করে কবর দেয়।
ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল): ঢাকা হল বা শহীদুল্লাহ হল আক্রান্ত হয় ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে এবং পাকবাহিনী সেখানে মর্টার ছোড়ে। মর্টারটি ঢাকা হলের আবাসিক শিক্ষকদের দোতলা বাসস্থানে আঘাত হানে। এরপর পাকবাহিনী ঢাকা হলের প্রধান ভবনে আক্রমণ চালায়। এতে ২ জন শিক্ষক ও ১০-১২ জন ছাত্র নিহত হন। হলের ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষদর্শীরা হলেন- কর্মচারী আবদুল মতিন ও মতিয়ার রহমান এবং ঢাকা পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ সাহেব আলী ও চুন্নু ডোম। পাকবাহিনীর গোলায় ঢাকা হলের কর্মচারীদের বাসগৃহে আগুন লেগে যায়। লেখক ডা. এম এ হাসান ২৭শে মার্চ এখানকার গণহত্যায় নিহত ২ ন জন শিক্ষক ও ২ জন ছাত্রের লাশ দেখতে পান। শিক্ষকদ্বয় ছিলেন- হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক শরাফত আলী ও আতাউর রহমান খান খাদেম। ঢাকা পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ সাহেব আলী ও চুন্নু ডোম ঢাকা হল ন থেকে ২৯শে মার্চ এই ৪টি মৃতদেহ তুলে নিয়ে যায়।
রোকেয়া হল: ৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসযোগ আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু সংখ্যক ছাত্রী ডামি রাইফেল নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন পরিচালনার মনোবৃত্তি ছাড়াও এ ঘটনা ছিল মেয়েদের হলের প্রতি পাকবাহিনীর বিশেষ আক্রোশের আরেকটি কারণ। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে – পাকবাহিনী লোহার গেট ভেঙ্গে রোকেয়া হলে প্রবেশ করে। ল পাকবাহিনী রোকেয়া হলে প্রবেশ করা মাত্রই কয়েকজন ন কর্মচারী অনুমান করে যে, উন্মত্ত পাকসেনারা ছাত্রীদের মূল বাসভবনেও প্রবেশ করতে পারে। তারা অতি দ্রুত হলে অবস্থানরত ছাত্রীদের অন্যত্র চলে যাবার অনুরোধ জানান। ঐ রাতে রোকেয়া হলে অন্য কিছু সংখ্যক ছাত্রীদের সঙ্গে অনার্স ও এমএ শ্রেণির পরীক্ষার্থী আরো ৭ জন ছাত্রী অবস্থান করছিলেন। এ ৭ জন ছাত্রী হলেন- খুরশীদা বেগম, লুৎফুল নাহান বেগম, নাজমা বেগম, রাধা শেরেস্তা (নেপালী), আখতার ইমাম শেফাতুন্নেছা, ফরিদা খানম ও মমতাজ বেগম। হলের আবাসিক শিক্ষিকা সাহেরা খাতুনের সহায়তায় ঐ ৭ জন ছাত্রী শিক্ষকদের বাসায় অবস্থান করায় সেদিন হায়েনাদের কবল থেকে প্রাণে বেঁচে যান। পাকবাহিনী রোকেয়া হলে প্রবেশ করে কর্মচারীদের বাসভবনসমূহের ওপর আক্রমণ করে এবং নির্বিচারে
গণহত্যা চালায়। হানাদার বাহিনীর এ গণহত্যায় হলের কর্মাচরী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৫ জন শহীদ হন। এছাড়া দারোয়ান, মালী, বেয়ারার, লিটম্যান, ধোপা, প্রহরী ও পিয়ন এরূপ ৪৫ জন কর্মচারী বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সেদিন নিহত হন। এদের মধ্যে- নমী, সোলেমান, হাফিজুদ্দিন, মনিরুদ্দিন, চুন্নু মিয়া, আবদুল খালেক, নুরুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দীন, আহমেদ আলী, বাসুদেব, আলী আক্কাস, হাবুল মিয়া, নেওয়াজ আলী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদিকে হল গেটে নিহত একটি মেয়ে ও দুটি ছেলের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
১৯৭২ সালে শামসুন্নাহার হলের গেটের নিকট একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। ঐ গণকবরটি খনন করা হলে সেখানে মানুষের মাথার খুলি, হাড় ও মেয়েদের লম্বা চুল পাওয়া যায়। ঢাকা পৌরসভার সুইপার ইনস্পেক্টর মোহাম্মদ সাহেব আলী তার সাক্ষাৎকারে একটি মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেন।
আর্ট হোস্টেল (শাহনেওয়াজ হল): ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসটি বর্তমানে শাহনেওয়াজ হল নামে পরিচিত হলেও ১৯৭১ সালে এটি ছিল আর্ট কলেজের ছাত্রদের হোস্টেল। এটি নিউমার্কেট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। ২৬শে মার্চ আর্ট কলেজের ছাত্র শাহনেওয়াজ পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। পরবর্তীতে ছাত্রাবাসটি ‘শাহনেওয়াজ হল’ নামে পরিচিতি পায়। ১৯৭১ সালে আর্ট কলেজ (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ১৯৮৩ সালে আর্ট কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট হিসেবে রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসে আক্রমণ ও ছাত্রদের হত্যার ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ঢাকা হলের অনুরূপ ছিল। এ ছাত্রাবাসের ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র নজরুল এবং সুবীর চৌধুরী। মার্চ মাসের মাঝামাঝি অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আর্ট কলেজ হোস্টেলের অধিকাংশ ছাত্র তাঁদের নিজ-নিজ বাড়িতে চলে যান। ঘটনার সময় আর্ট কলেজ হোস্টেলে আনুমানিক ১০-২০ জন ছাত্র ছিলেন। ২৫শে মার্চ ঢাকার অন্যান্য স্থানের মতো নিউমার্কেট এলাকায় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও উত্তেজনা লক্ষ করা যায়। এ এলাকার বিভিন্ন স্থানের রাস্তায় পাকহানাদার বাহিনীর আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল: ২৫শে মার্চ রাতে এ হোস্টেলটি আক্রমণের শিকার না হলেও মে-জুন মাসে এখানে অবস্থানরত কতিপয় বাঙালি ছাত্র ও একজন ডাক্তার পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা আক্রান্ত হন। কেবল বাঙালি হবার কারণে তাঁদের হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ডা. হাসিময় হাজরা। তাঁদের হত্যার পর হলের কাছে আমবাগানে গণকবরে (বর্তমানে নিশ্চিহ্ন) ফেলে দেয় পাকিস্তানি ঘাতকরা।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম টার্গেট। তারা ঐ রাতে এবং কোথাও পরের দিন পর্যন্ত ছাত্র- শিক্ষক ও কর্মচারীদের গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ছাত্রীদের পাশবিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে। ঐ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁরা হলেন— অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিজ্ঞান), মোহাম্মদ আবদুল মুকতাদির (ভূতত্ত্ব), আতাউর রহমান খান খাদিম (পদার্থবিজ্ঞান), অধ্যাপক এ এন এম মুনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন), অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি; ২৫শে মার্চ নিজ বাসভবনের বাইরে হানাদারদের কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত এবং ৩০শে মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু), ড. ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), মোহাম্মদ সাদেক (ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, ইউল্যাব) ও শরাফত আলী (গণিত)।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী শহীদ হন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ২দিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনী রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের যাঁরা শিকার, তাঁরা হলেন- আনোয়ার পাশা (বাংলা), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), ড. ন আ ম ফয়জুল মহী (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী (বাংলা), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) ও ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা (প্রধান চিকিৎসক)।
২৫ ও ২৬শে মার্চ এ দুদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত ছাত্র-কর্মচারীদের সংখ্যা হবে কয়েকশ। মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ জন প্রথিতযশা শিক্ষক, ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক মোট ২০ জনকে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের ৯ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো অনেক ছাত্র-কর্মচারী পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন সংলগ্ন পশ্চিম দিকের চৌরাস্তার মধ্যবর্তী স্থানে নির্মিত (১৯৯৫) স্মৃতি চিরন্তন-এ শিক্ষকসহ ২০ জন বুদ্ধিজীবী, ১০৫ জন ছাত্র, ৬০ জন কর্মচারী ও মধুসূদন দে (মধুদা)-র পরিবারের ৪ জন শহীদের নাম খোদাই করা আছে।
জগন্নাথ হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গণকবরসমূহ এবং ছাত্রদের আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরি ও আবাসিক এলাকাসমূহে রক্ষিত শহীদদের নাম ও স্মৃতিফলক ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে। [রতন লাল চক্রবর্তী ও এম এ হাসান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!