You dont have javascript enabled! Please enable it! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিজীবী হত্যা - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিজীবী হত্যা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিজীবী হত্যা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জঘন্য ও নারকীয় গণহত্যা। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এ সামরিক অভিযানের নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। এর আওতায় সারাদেশে একযোগে বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ হয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্বর পাকবাহিনীর আক্রমণের বিশেষ টার্গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নামানো হয় এক কোম্পানি সেনা (৫০ জন পাঞ্জাবি ও ২২ জন বালুচ সেনা), যাদের দায়িত্ব ছিল জহুরুল হক হল (ইকবাল হল) ও জগন্নাথ হলে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করা। কেননা জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হল ছিল আওয়ামী লীগ-এর শক্তিশালী ঘাঁটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫শে মার্চ মধ্য রাতে আরম্ভ হওয়া হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসলীলার ব্যাপ্তি ছিল দেড় দিন বা ৩৬ ঘণ্টার অধিক। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অন্যান্য আবাসিক হল, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আক্রান্ত হয়। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এছাড়াও ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময় ও স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও কর্মচারীদের সঙ্গে শহীদ হয়েছেন জাতির সূর্য সন্তান হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ।

বুদ্ধিজীবী হত্যার বিবরণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও আবাসিক এলাকাসমূহে গণহত্যার বিষয়টি পাকবাহিনীর জঘন্যতম কার্যকলাপের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। নরঘাতক পাকবাহিনী নিরপরাধ ও নিরস্ত্র ছাত্র, কর্মচারী ও জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে। ২৬শে মার্চ তথা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন পর্যন্ত সময়কালে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে (যার মধ্যে ১৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক)।
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (১৯৪৫-১৯৭১) অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি সিলেট জেলার জন্তুরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দ্বিগেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রীয় কবিরাজ। এলাকায় সকলে তাঁকে ‘পণ্ডিত মশাই’ বলে সম্বোধন করত।
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ১৯৬১ সালে নবীগঞ্জ জে কে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৩ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে মেধা তালিকায় ১০ম স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় ২য় শ্রেণিতে এবং ১৯৬৭ সালে এমএসসি পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ৪র্থ স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৮ সালের ১৪ই মার্চ ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে এবং ১লা আগস্ট জগন্নাথ হলে সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি কলম্বো পরিকল্পনার আওতায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পান। ঐ বছরের শেষদিকে তাঁর সেখানে যোগদানের কথা ছিল।
জগন্নাথ হলের এসেম্বলি ভবনের পূর্ব অংশ হলের প্রাধ্যক্ষের – কার্যালয় ও আবাসিক শিক্ষকদের বাসস্থান এবং পশ্চিম অংশ ছাত্রদের আবাসিক কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উল্লেখ্য যে, জগন্নাথ হলের এসেম্বলি ভবনটি ১৯৮৫ সালের ১৫ই অক্টোবর ভেঙ্গে পড়ে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এ ভবনটির স্থানে নির্মিত হয়েছে ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’। এসেম্বলি ভবনের পূর্ব অংশে একা বসবাস করতেন আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ শেষ রাতে জগন্নাথ হলের এসেম্বলি ভবন আক্রমণ করে এবং অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে ধরে ফেলে। যশোদা জীবন সাহা এবং গ্রন্থাগারের কর্মী কেশব চন্দ্র পালের স্ত্রী শোভা পাল এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়ার পর পরিধানের শুভ্র ধুতি দিয়ে দুটি হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে তাঁকে টেনে এসেম্বলি ভবনের এসেম্বলি কক্ষে নিয়ে আসে। ২৫শে মার্চ রাতেই পাকবাহিনী জগন্নাথ হলের টিন শেডের ছাত্রাবাস দুটিতে ও ক্যান্টিনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ আগুন ক্যান্টিন সংলগ্ন বস্তিতে ছড়িয়ে পড়লে বস্তিবাসীগণ আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে সকাল হলেই পাকসেনারা জগন্নাথ হলের ক্যান্টিন সংলগ্ন ও দক্ষিণ বাড়ির বস্তিতে তল্লাশি শুরু করে। ফলে বস্তিতে বসবাসরত পুরুষ ও সেখানে আশ্রয় নেয়া ছাত্র ও অতিথিরা ধরা পড়ে। এ-সময় বস্তির নারীদের একাংশ ভীত- সন্ত্রস্থ অবস্থায় এসেম্বলি ভবনের এসম্বলি কক্ষে আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানেই হানাদারদের কর্তৃক সর্বাঙ্গে নির্মম প্রহারের চিহ্ন ও যন্ত্রণা নিয়ে পরনে একটা ছোট অন্তর্বাস আর হাত দুটি ধুতি দিয়ে পেছন মোড়া করে বাঁধা অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য উবু বসে ছিলেন। এসেম্বলি কক্ষে জড়ো করা হয়েছিল আরো কয়েকজনকে। কিছুক্ষণ পর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ও দারোয়ান সুশীলকে এসেম্বলি কক্ষ থেকে নিয়ে দক্ষিণ বাড়ির দিকে যেতে হাতের ডান দিকে বড় একটি গাছের নিচে গুলি করে হত্যা করে পাকসেনারা। শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের মরদেহ জগন্নাথ হলের গণকবরে স্থান পায়।
আতাউর রহমান খাদিম (১৯৩৩-১৯৭১) আতাউর রহমান খাদিম ১৯৩৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউরা উপজেলার খরমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দৌলত আহমেদ খাদিম ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী ও মাতা আঞ্জুমান্নেছা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। আতাউর রহমান খাদিম ১৯৪৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে মেধা তালিকায় একাদশ স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ২য় স্থান অর্জন করায় ‘রাজা কালী নারায়ণ’ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি এমএসসি পরীক্ষায় ২য় শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৯ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে জার্মানিতে গমন করে গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ‘কোয়ান্টাম তত্ত্ব’ নিয়ে গবেষণা করেন। ১৯৬০ সালে জার্মানি থেকে প্রত্যাবর্তন করে খাদিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ফেলো হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর প্রভাষক এবং এ-সময় থেকেই তিনি শহীদুল্লাহ হলে আবাসিক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আবাসিক শিক্ষক হিসেবে তিনি হলে শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট একটি বাসভবনে অবস্থান করতেন। হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে শহীদুল্লাহ হল আক্রমণ করলে তাদের গোলার আঘাতে আতাউর রহমান খাদিম শহীদ হন। হলের কর্মচারী মতিয়ার রহমান, ঢাকা পৌরসভার সুইপার ইন্সেপক্টর মোহাম্মদ সাহেব আলী এবং চুন্নু ডোম এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ২৯শে মার্চ এ হল থেকে ৪টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এর দুটি হলো শিক্ষক আতাউর রহমান খাদিম এবং শিক্ষক শরাফত আলীরI

আনোয়ার পাশা (১৯৩২-১৯৭১) আনোয়ার পাশা ১৯৩২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মুর্শীদাবাদ জেলার বহরমপুর মহকুমার রাঙ্গামাটি চাঁদপাড়া ইউনিয়নের ডাবকাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী মকরম আলী, মাতা সাবেরা খাতুন। আনোয়ার পাশা ১৯৪৬ সালে মুর্শীদাবাদের ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ
কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫১ সালে তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৫৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে এমএ পাস করেন। এরপর তিনি ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসা, সাদি খান দিয়ার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এডওয়ার্ড কলেজে চাকরি করাকালে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করায় পাকিস্তান সরকার তাঁর পাসপোর্ট ৬ বছরের জন্য স্থগিত রাখে। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন (৩০নং ঈশা খাঁ রোড) থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মাত্র ৩৮ বছরের জীবনকালে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ নদী নিঃশেষিত হলে (১৯৬৩), উপন্যাস নীড় সন্ধানী, নিষুতি রাতের গাঁথা (১৯৬৮), রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালে তাঁকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।

ড. আবদুল মুক্তাদির (১৯৪০-১৯৭১) আবদুল মুক্তাদির ১৯৪০ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার সিলাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল জব্বার ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। আবদুল মুক্তাদির ১৯৫৬ সালে সিলেটের রাজা জি সি হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৫৮ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ থেকে বিএসসি এবং ১৯৬২ সালে এমএসসি পাস করেন। আবদুল মুক্তাদির ১৯৬২ সালে পানি ও বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে যোগ দিয়ে সাঙ্গু বহুমুখী প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জলবিদ্যার ওপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের ১৯শে অক্টোবর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি দক্ষিণ ফুলার রোড আবাসিক এলাকার ১২ নম্বর বাড়ির নিচ তলায় বসবাস করতেন। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করলে রাতেই সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঐ ভবনের তিন তলায় ড. সৈয়দ আবদুল নকীর বাসায় অবস্থান নেন। সকালবেলা হানাদার বাহিনীর কয়েক সদস্য আবাসিক এলাকায় এসে ড. সৈয়দ আবদুল নকীর বাসায় প্রবেশ করে আবদুল মুক্তাদিরকে গালিগালাজ করে এবং বুকে পেটে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ প্রথমে ব্রিটিশ কাউন্সিলে রাখা হলেও পরবর্তীতে তা সূর্যসেন হলে পাওয়া যায়। তাঁর স্ত্রীর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। শিক্ষক হিসেবে তিনি ভূতত্ত্ব বিষয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া তাঁর জীবনালেখ্য নিজেই লিখে গিয়েছেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত)।

এ এন এম (আবু নাসের মুহাম্মদ) মুনীরুজ্জামান (১৯২৪- ১৯৭১) আবু নাসের মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামান ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যশোর জেলার কাঁচেরকোল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী মুহাম্মদ মুসা ছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী। মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামানের স্থায়ী ঠিকানা যশোর জেলার হাট আমতলীর তারজ্জিয়াল গ্রামে। তিনি ১৯৪০ সালে নড়াইল এস ডি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪৪ সালে গণিত বিষয়ে স্নাতক সম্মান পাস করেন। ১৯৪৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পেশাগতম জীবনের প্রথম দিকে তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে রেইঞ্জ অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে তিনি এ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে পূর্ব বাংলা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা গবেষণার জন্য একটি গ্রুপ গঠন করেন, যা ১৯৫৬ সালে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি সোসিও-ইকোনমিক সার্ভে বোর্ড’ হিসেবে রূপ লাভ করে। ১৯৬০ সালে গঠিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে এন্ড রিসার্চ ইউনিটের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তীকালে এটি Institute of Statistical Research and Training (ISRT) হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পাট কমিটি সদস্য, বাংলা একাডেমির উপ-কমিটির সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য এবং পরিবার পরিকল্পনা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার আবাসিক এলাকার ৩৪ নম্বর ভবন ছিল আবু নাসের মুহাম্মদ মুনীরুজ্জামানের আবাসস্থল। ২৬শে মার্চ হানাদার বাহিনী এ ভবনে এসে তাঁর বাসার দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে বড় ছেলে, এক ভাই ও এক ভাগ্নেসহ তাঁকে নিচে নামিয়ে ভবনের সামনে গুলি করে হত্যা করে। হানাদাররা এই ৪টি লাশ জগন্নাথ হলে নিয়ে যায়। এ লাশগুলোর স্থান হয় জগন্নাথ হলের গণকবরে।

ড. আবুল খায়ের (১৯২৯-১৯৭১) আবুল খায়ের ১৯২৯ সালের ১লা এপ্রিল পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার কাঠালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুর রশীদ। আবুল খায়ের ১৯৪৫ সালে পিরোজপুর সরকারি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১ম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ইতোমধ্যে ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি বিএ (সম্মান) এবং ১৯৫১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩-৫৫ সময়কালে তিনি বরিশালের চাখার ফজলুল হক কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৫ সালের কিছু সময় তিনি জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৫ সালের ১২ই নভেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে ইতিহাস বিভাগের পাঠ্যসূচিতে আমেরিকার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কর্মসূচির অধীনে এশিয়া ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে ঐ বছরই তিনি আমেরিকা গমন করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে এমএ এবং ১৯৬২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘United States Foreign Policy in the Indo-Pakistan Sub-Continent, 1939- 1947’, যা ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। স্বল্পভাষী ড. আবুল খায়ের প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করলেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ রাজনীতি সচেতন। ২৬শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর পরিবারসহ তিনি গ্রিণ রোডে শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে বাধ্যতামূলক কাজে যোগদানের নির্দেশের ফলে অন্যদের মতো ড. আবুল খায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি নিয়মিত ইতিহাস বিভাগে আসতেন, ক্লাবে যেতেন, দেশের অবস্থা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। এর ফলে ১৩ই আগস্ট মধ্যরাতে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে তাঁকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রায় দেড় মাস আটক রাখা হয়। এ-সময় জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁর ওপর চলে মানসিক নির্যাতন। ৩০শে অক্টোবর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৪ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী সকালবেলা ড. আবুল খায়েরকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে। গায়ে জড়ানো স্ত্রী সাঈদা খায়েরের শাল দেখে তাঁর লাশ শনাক্ত করা হয়। শহীদ ড. আবুল খায়েরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের নিকট সমাহিত করা হয়।

গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (১৯৩৬-১৯৭১) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ১৯৩৬ সালের ১৯শে মার্চ নরসিংদীর বেলাব গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ডেপুটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল গফুর ছিলেন ডেপুটি
ম্যাজিস্ট্রেট এবং মাতা শামসুন্নাহার ছিলেন কিশোরগঞ্জের জনৈক ভূস্বামীর কন্যা। পিতা আবদুল গফুর ছিলেন পদার্থবিদ্যার ছাত্র, যিনি ১৯১৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। বড়ভাই নাসিরউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ডাক বিভাগের মহাপরিচালক। ছোটভাই ডা. রশীদউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন খ্যাতিসম্পন্ন নিউরো সার্জন। ৫ বোনের মধ্যে ৩ জনই ছিলেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক। মেধাবী ছাত্র গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে মেধা তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫২ সালে নটরডেম কলেজ থেকে মেধা তালিকায় ১০ম স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি ঢঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৫৫ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৭ সালে ২য় বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি ১৯৬৪ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিকস এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স (এলএসই)-এ ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে ইতহাস বিভাগে যোগ দেন এবং মহসীন হলের আবাসিক শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য পদ লাভ করেন এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে এশিয়াটিক সোসইটির কাউন্সিলের সদস্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সম্পাদক হয়ে তিনি ধ্বংসপ্রায় ক্লাবটির পূর্বের মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রেডিও এবং টেলিভিশনে বরীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হলে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। তিনি রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টারও বিরোধিতা করেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে নিহত হলে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং কঠোর ভাষায় বক্তৃতা দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকবাহিনীর গণহত্যার পর যে কয়েকজন শিক্ষক অর্থ সংগ্রহ করে শহীদ শিক্ষক পরিবারের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন তাঁদের নেতৃস্থানীয়। তিনি অসহায় ও বিপন্ন শহীদ শিক্ষক পরিবারের জন্য অর্থ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খবর, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে গোপনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ছোটভাই ডা. রশীদউদ্দিন আহমেদের সাহায্য নিয়ে অতি গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানপন্থী শিক্ষক ও ছাত্ররা গিয়াসউদ্দিন আহমেদের এসব কর্মকাণ্ডের খবর হানাদার বাহিনীর নিকট পৌঁছে দেয়। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে হানাদার বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখ মহসীন হলের কয়েকজন ছাত্র ও কর্মচারীসহ গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে হানাদার বাহিনী পুনরায় ধরে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। ছাত্র ও কর্মচারীদের নির্যাতন করে হানাদাররা জানতে চায় গিয়াসউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত কি-না। ২০শে নভেম্বর তিনি ছাড়া পান। ১৪ই ডিসেম্বর সকালবেলা আলবদর বাহিনী গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে একজন দারোয়ানের একটি লাল গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে হল থেকে নিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি মিরপুর ১০নং সেকশনের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে এ বুদ্ধিজীবীর দেহের কিছু অংশ এবং অন্যত্র লাল গামছা দিয়ে বাঁধা দেহাংশ পাওয়া যায়। এরপর তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের নিকট অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে সমাহিত করা হয়।

অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (১৯০৭-১৯৭১) গোবিন্দচন্দ্ৰ দেব ১৯০৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম গোবিন্দচন্দ্র দেবপুরকায়স্থ। তাঁর পিতার নাম ঈশ্বরচন্দ্র দেবপুরকায়স্থ। তাঁদের পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল গুজরাটে, ৫ম শতকে তাঁরা সিলেটে স্থায়ী হন। গোবিন্দচন্দ্ৰ দেব ১৯২৫ সালে বিয়ানী বাজার হাইস্কুল থেকে ১ম শ্রেণিতে প্রবেশিকা এবং ১৯২৭ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এফএ পাস করেন। ১৯২৯ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এমএ ডিগ্রি লাভের পর তিনি মুম্বাই-এর অমলনারে অবস্থিত রিসার্স ইনস্টিটিউটে ভারতীয় বেদান্ত দর্শন বিষয়ে গবেষণায় রত হন। এরপর তিনি কলকাতা সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় দিনাজপুরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে (১৯৩৯) সেখানে তিনি যোগ দিয়ে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘Idealism and Progress’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনার জন্য তিনি ১৯৪৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে প্রভাষক পদে এবং ১৯৫৭ সালে জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সালের ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত এ হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি দর্শন বিভাগে অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেন। তিনি আমৃত্যু দর্শন বিভাগের প্রধান ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে এবং কিছুদিনের জন্য তাঁকে কারাভোগ করতে হয়। তাঁর আন্তরিক চেষ্টা এবং অর্থানুকূল্যে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় দর্শন ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক, পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেসের সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার কমিটির সদস্য এবং বাংলা একাডেমির কার্যকর কমটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার উইলকার কলেজে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে গমন করেন। সেখানে অবস্থানকালে ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব প্রচারিত সমন্বয়ী এবং মানতাবাদী দর্শনে বিমুগ্ধ গুণগ্রাহীগণ তাঁর সম্মানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দি গোবিন্দদেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারগুড’। ১৯৭১ সালে দেশে ফিরে এসে ফেব্রুয়ারি মাসে দর্শন বিভাগে আবার যোগদান করেন।
২৬শে মার্চ সকালে জল্লাদ পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গোবিন্দচন্দ্র দেবের বাংলো আক্রমণ করে এবং নৃশংসভাবে তাঁকে ও তাঁর পালিত কন্যা রোকাইয়া সুলতানার স্বামী মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করে। দেবের পালিত কন্যা রোকাইয়া এ নির্মম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ‘মালাউন কো বাচ্চা দরোয়াজা খোলা দো’- এরূপ ঘোষণা দিয়েই উপর্যুপরি লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঘাতক পাকবাহিনী প্রথমেই গুলি করে রোকাইয়ার স্বামী মোহাম্মদ আলীকে। তিনি মেঝেতে পড়ে যাবার পর গোবিন্দচন্দ্র দেব পাকবাহিনীর উদ্দেশে অত্যন্ত শান্তভাবে বলেন, “বাবারা, কি চাও এখানে।’ একথার উত্তর নরাধম পাকসেনারা দেয় গুলির মাধ্যমে। গুলি গোবিন্দচন্দ্র দেবের মাথায় ও বুকে লাগে। ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞানবৃদ্ধ এই দার্শনিকের দেহ। এতেও নরঘাতকদের হত্যালালসা পরিতৃপ্ত হয়নি। বুটের লাথি ও বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় গোবিন্দচন্দ্র দেবের প্রাণহীন পবিত্র দেহ। রোকাইয়া সুলতানা গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও তার নিজ স্বামীর পবিত্র মরদেহ নিয়ে শিশুকন্যা রাবেয়াসহ অসহায়ভাবে বসে থাকে গুলিতে ঝাঁঝরা দেবের বাংলোতে। একদিন পর ২৭শে মার্চ পাকসেনাদের নির্দেশে চান্দ দেবরায়, মিশ্রীলাল ও শিবপদ কুড়ি গোবিন্দচন্দ্ৰ দেবের মরদেহ জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে আসে এবং তাঁর স্থান হয় গণকবরে।
ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব রচিত বই-এর সংখ্যা ৯টি। এর মধ্যে Idealism and Progress (1952), Idealism : A new Defence and a new Application (1958), Aspiration of the Common Man (1963), তত্ত্ববিদ্যাসার (১৯৬৬), আমার জীবন ও দর্শন (১৯৬৭) উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৭ সালে পূর্ববঙ্গ সারস্বত সমাজ তাঁকে ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (১৯২০-১৯৭১) জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ১৯২০ সালের ১০ই জুলাই ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায়। পিতা কুমুদচন্দ্ৰ গুহঠাকুরতা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে প্রবেশিকা এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৪৩ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় তিনি ঢাকা হল ইউনিয়নের সাহিত্য সম্পাদক এবং ডাকসুর সদস্য ছিলেন। ১৯৪৩ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। একই বছর তিনি জগন্নাথ কলেজে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যান এবং কিংস কলেজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘The Use of Classical Myths in the Plays of Swinburne, Bridges, Sturge Moore and TS Eliot’, যা ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে উন্নীত হন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক (১৯৫৮- ১৯৬৩) এবং প্রভোস্টের (২০শে এপ্রিল ১৯৭০ থেকে মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত) দায়িত্ব পালন করেন। ৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরু হলে একজন সৈন্য দরজা ভেঙ্গে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বাসায় প্রবেশ করে এবং উর্দু ভাষায় পরিচয় জিজ্ঞেস করে। পরিচয় নিশ্চিত হবার পর পাকসেনারা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বাইরে নিয়ে যায় এবং বাসার নিকটেই গুলি করে। গলায় ও স্পাইনাল কর্ডে গুলি লাগায় সঙ্গে-সঙ্গে মারা না গিয়ে তিনি মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকেন। চারদিকে অনবরত গুলিবর্ষণ ও কারফিউ থাকায় বাসার অদূরে অবস্থিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কয়েকজন মিলে তাঁর ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত দেহ বাসায় নিয়ে যায়। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার তখনো জ্ঞান ছিল। এভাবেই কেটে যায় দেড় দিন অর্থাৎ ২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত। এরপর কিছু সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল হলে ২৭শে মার্চ তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু অনেক দেরি হযোয়। ডাক্তারদের অনেকেই অনুপস্থিত। তবুও শুরু হয় চিকিৎসা। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব দেখা দেয়। অবশেষে ৩০শে মার্চ সকালবেলা তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অন্যদের সঙ্গে তাঁর পবিত্র মরদেহ মর্গে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আঞ্জুমানের গাড়ি অন্যান্য লাশ নিয়ে গেলেও হিন্দু বিধায় শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মরদেহ নিয়ে যায়নি। তাঁর মরদেহ সৎকার করা সম্ভব হয়নি, কারণ ইতোমধ্যে পাকসেনারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে। এভাবে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মরদেহ পড়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। এক সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের লোকজন তাঁর পবিত্র মরদেহ নিকটস্থ কোনো গাছের নিকট সমাহিত করে। স্বাধীনতার পর সেখানে নির্মিত হয় অনেক ভবন। ফলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার দেহাবশেষের কোনো চিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ড. ন আ ম ফয়জুল মহী (১৯৩৯-১৯৭১) ড. ন আ ম ফয়জুল মহী ১৯৩৯ সালের ১০ই আগস্ট নোয়াখালীর ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নূরুল ইসলাম চৌধুরী। ফয়জুল মহী ১৯৫৫ সালে ফেনী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, ১৯৫৭ সালে ফেনী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৯ সালে বিএ পাস করেন।
১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পাস করে ফেনী জি এম একাডেমিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। কয়েক বছর পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘A study on the Nutrient Metbolism in Soil at High Moisture Levels’। ১৯৭০ সালে তিনি পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফরিদা খানম শিরিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে স্ত্রী ফরিদা খানম উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাজ্য গমন করলে ফজলুর রহমান খান অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জগন্নাথ হলে গণহত্যা শেষে নীলক্ষেত এলাকায় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় রাত সাড়ে বারোটায় ড. ফজলুর রহমান খানের বাসভবন আক্রমণ করে। শুরু হয় উর্দু ভাষায় গালাগালি ও দরজা খোলার হুঙ্কার। ভাগ্নে কাঞ্চন দরজা খুলে দিলে পাকবাহিনীর গুলিতে প্রথমে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর দেহ। এরপর পাকবাহিনী গুলি এবং বেয়নেট চার্জ করে ফজলুর রহমান খানের দেহ ঝাঁঝরা করে দেয়। পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বাথরুমে লুকিয়ে গৃহকর্মী জবান আলী এ হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে। ২৭শে মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে নিকট আত্মীয়-স্বজনরা সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানে ড. ফজলুর রহমান খান ও কাঞ্চনের পবিত্র মরদেহ পাশাপাশি কবরে সমাহিত করে।

মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) মুনীর চৌধুরী ১৯২৫ সালের ২৭শে নভেম্বর মানিকগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের পৈতৃক নিবাস বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার গোপাইরবাগ গ্রামে। তাঁর
পিতার নাম আবদুল হালিম চৌধুরী এবং মাতা আফিয়া বেগম। পিতা হালিম চৌধুরী ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারি কাজে দক্ষতার জন্য খান বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। পিতা-মাতার ১৪ সন্তানের মধ্যে মুনীর চৌধুরী ছিলেন দ্বিতীয়। প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন তাঁর অগ্রজ। মুনীর চৌধুরী ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৪৬ সালে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৪৭ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে খুলনা বিএল কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। কমিউনস্টদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় ১৯৪৯ সালে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫০ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন। একই বছর ৩০শে আগস্ট তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন-এ ভূমিকা রাখার জন্য ২৬শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। একই বছর ১৫ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Executive Council (বর্তমান সিন্ডিকেট)-এর সভায় জননিরাপত্তা আইনে বন্দি থাকার জন্য মুনীর চৌধুরীসহ দুজন শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। একই বছর ২৮শে মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় তাঁকে ৬ই জুলাইর মধ্যে কর্মস্থলে যোগদানের জন্য বলা হয়। কিন্তু তিনি তখন দিনাজপুর জেলে কারারুদ্ধ। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে যোগদান করতে না পারায় কারারুদ্ধ হওয়ার দিন থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত হন। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর ১৯৫৪ সালে তাঁর কারাজীবনের সাময়িক অবসান হয়। কারাগারে থাকাকালে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত নাটক কবর এবং জর্জ বার্নার্ড শ-র ‘You Can Never Tell’ (কেউ কিছু বলতে পারে না) নাটকের বাংলা অনুবাদ। কয়েকদিনের মধ্যে ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে ৯২- ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার বরখাস্ত এবং পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হলে মুনীর চৌধুরী পুনরায় কারারুদ্ধ হন। কারাগারে থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ই নভেম্বর মুনীর চৌধুরী পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান শুরু করেন। ১৯৫৫ সালের ৮ই আগস্ট তিনি বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তান সরকার ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব প্রদান করে। ১৯৬৯ সালে তিনি Pakistan Nationalism শীর্ষক একটি পুস্তিকা রচনা করেন। তিনি ‘পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড’-এর সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বাংলা টাইপ রাইটিং এর নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা ১৪। এছাড়া ৭টি নাটক রচনা ও অনুবাদ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর মুনীর চৌধুরী ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭১ 7 সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চাপে পড়ে পাকিস্তানের অখণ্ডত্বের পক্ষে অন্যান্যদের সঙ্গে। বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি তাঁর আনুগত্য বুঝতে ভুল করেনি। তাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র দুদিন পূর্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুনীর চৌধুরীকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর কোনো – খোঁজ পাওয়া যায়নি।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (১৯২৬-১৯৭১) মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯২৬ সালে নোয়াখালী জেলার খালিসপুর গ্রামের মিয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বজলুর রহিম চৌধুরী এবং মাতা
মাহফুজা খাতুন। মোফজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৪২ সালে আহমেদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রবেশিকা এবং ১৯৪৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৪৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে এবং ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫টি। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবক এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ধারক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের ১৪-এফ বাসায় বসবাস করতেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচারের হাত থেকে থেকে রক্ষা পেতে তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা অধ্যাপক লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায় আশ্রয় নেন। ঠিকানা জেনে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ১৪ই ডিসেম্বর ভাইয়ের ৬৮/এ ইন্দিরা রোড-এর বাসা থেকে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

মোহাম্মদ সাদত আলী (১৯৪২-১৯৭১) সাদত আলী ১৯৪২ সালের ২৮শে জানুয়ারি নরসিংদী জেলার পঞ্চবটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত আলী। সাদত আলী ১৯৫৭ সালে ঢাকার গাছাউচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬০ সালে নরসিংদী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে বিকম (সম্মান) এবং ১৯৬৪ সালে এমকম ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং কিছুদিনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। মুক্ত চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী সাদত আলী পত্র-পত্রিকায় বেশকিছু চিন্তাশীল প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ২৬শে মার্চ তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা থেকে রক্ষা পেলেও ২৬শে এপ্রিল নরসিংদী থেকে ঢাকা আসার পথে হানাদার বাহিনী তাঁকে ধরে ফেলে। তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

মোহাম্মদ সাদেক (১৯৩৯-১৯৭১) মোহাম্মদ সাদেক ১৯৩৯ সালের ৩১শে মার্চ ভোলা জেলার ইলিশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মমতাজ উদ্দিন। মোহাম্মদ সাদেক ১৯৫৪ সালে ভোলা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৮ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি ভোলার পরানগঞ্জ হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকরি নেন।
১৯৫০-৬০ সালে তিনি ভোলার ব্যাংকেরহাট কো-অপারেটিভ হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ময়মনসিংহ টিটার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে তিনি ১৯৬১ সালে বিএড এবং ১৯৬২ সালে এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শহীদ হওয়ার পূর্বে তিনি এ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ফুলার রোডের ১১ নম্বর ভবনে মোহাম্মদ সাদেক থাকতেন। ১১ নম্বরের এ বাসভবনে তখন অবাঙালি শিক্ষকদের প্রাধান্য ছিল। ২৬শে মার্চ সকালবেলা পাকিস্তানি বাহিনী মোহাম্মদ সাদেকের ফ্লাটের দরজায় উপর্যুপরি আঘাত করলে তিনি নিজেই দরজা খুলে দেন। এরপর হানাদাররা মোহাম্মদ সাদেকের কাছে জানতে চায়, তিনি বাঙালি কি-না। বিশুদ্ধ ইংরেজিতে পরিষ্কারভাবে মোহাম্মদ সাদেক জানান যে, তিনি বাঙালি এবং নিরস্ত্র জনগণকে এভাবে মারা সেনাবাহিনীর কাজ নয়। উন্মত্ত পাকসেনারা তখনই গুলি চালায়। এতে মোহাম্মদ সাদেকের হাতদুটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তিনি ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। পাকসেনারা তাঁর ঘরে লুটপাট চালায়। ফিরে যাবার সময় হানাদাররা মোহাম্মদ সাদেকের গলায় বেয়নেট চার্জ করে। আত্মীয়-স্বজন ছুটে এসে রক্তাক্ত অবস্থায় মোহাম্মদ সাদেককে বিছানায় শোয়ায়। কিছু সময় পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৭শে মার্চ কারফিউ তুলে নেবার পর তাঁর ভাই আমিনুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজহার আলী ও আনোয়ার হোসেন ১১ নম্বর ভবনের পেছনে মোহাম্মদ সাদেককে কবর দেবার ব্যবস্থা করেন। লাশ গোসল করার জন্য পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এক বোতল পানি দিয়ে মোহাম্মদ সাদেকের দেহ সামান্য ধুয়ে-মুছে, বুলেটবিদ্ধ ছিন্নভিন্ন হাতদুটিকে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে কোনোরকমে জড়িয়ে এবং দু-একটি বাঁশ সংগ্রহ করে তাঁর মরদেহ কোনভাবে সমাহিত করেন।

রাশীদুল হাসান (১৯৩২-১৯৭১) রাশীদুল হাসান ১৯৩২ সালের ১লা নভেম্বর বীরভূম জেলার বড়সিজা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম শেখ মুহাম্মদ আবদুর রশীদ। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মদ সাঈদ। রাশীদুল হাসান ১৯৪৭ সালে ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসা থেকে উচ্চ মাদ্রাসা পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ৩য় স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট রাশীদুল হাসান কলেজ থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ১৯৫২ সালে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৫৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৪- ৫৫ সালে নরসিংদী কলেজ, ১৯৫৬-৫৯ সালে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ এবং ১৯৫৯ সালে বীরভূমের হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। রাশীদুল হাসান মুক্তবুদ্ধি চর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন। সক্রিয়ভাবে তিনি রাজনীতি না করলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২০শে অক্টোবর ঈশা খাঁ রোডের ৩১/এফ বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহিত করতেন। ২রা নভেম্বর তিনি মুক্তি পান। ১৪ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ঈশা খাঁ রোডের ৩০নং বাসা থেকে রাশীদুল হাসান এবং অধ্যাপক আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমিতে রাশীদুল হাসানের মরদেহ পাওয়া যায়। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের নিকট সমাহিত করা হয়।

শরাফত আলী (১৯৪৩-১৯৭১) শরাফত আলী ১৯৪৩ সালের ১লা জুলাই কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ রামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী আলী আজম এবং মাতা রজবেরনেছা। শরাফত আলী ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬৪ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর ১ম পর্ব পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে সিনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ২য় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি এমএসসি শেষ পর্ব পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৮ সালের ২০শে মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে হলের শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট বাসায় বসবাস শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ সকালবেলা পাকিস্তানি বাহিনী রাস্তা থেকে শহীদুল্লাহ হলের সম্প্রসারিত অংশে গোলাবর্ষণ করলে আগুন লেগে যায়। শরাফত আলী আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে হানাদাররা তাঁকে দেখে ফেলে। তারা বাসায় প্রবেশ করে শরাফত আলীকে বেয়নেট চার্জ এবং গুলি করে হত্যা করে। ২৬শে মার্চের পূর্বে দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয় চিকিৎসার জন্য তাঁর বাসায় অবস্থান নেন। এই অসুস্থ ব্যক্তিকে রেখে শরাফত আলী বাড়ি যেতে পারেননি। এই ব্যক্তি চৌকির নিচে পালিয়ে রক্ষা পান। তিনিই ২৮শে মার্চ সর্বপ্রথম শরাফত আলীর শহীদ হবার ঘটনা তাঁর পরিবারকে জানান। সন্তোষ ভট্টাচার্য (১৯১৫-১৯৭১) সন্তোষ ভট্টাচার্য ১৯১৫ সালের ৩০শে মার্চ ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ তারিণীচরণ মহামহোপাধ্যায়, যিনি ‘মায়ারাম বিদ্যাসাগর’ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। সন্তোষ ভট্টাচার্যের পিতা ক্ষিতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন একজন আইনজীবী। সন্তোষ ভট্টাচার্য ১৯৩২ সালে পগোজ স্কুল থেকে মেধা তালিকায় চতুর্দশ স্থান অধিকার করে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৩৪ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে মেধা তালিকায় ২য় স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৩৭ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৩৮ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। সন্তোষ ভট্টাচার্য দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও রাজনৈতিক ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণে ছিলেন সক্রিয়। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পর তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে থাকেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দিলে তিনি জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি ঈশা খাঁ রোডের ৩১নং বাসায় বসবাস শুরু করেন। ১৪ই ডিসেম্বর সকালবেলা ঘৃণ্য আলবদর বাহিনী চোখ বেঁধে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। মিরপুর বধ্যভূমিতে তাঁর ছিন্নভিন্ন ও গলিত লাশ পরিধানের ধুতি ও ধূসর চুল দেখে পুত্র প্রদীপ ভট্টাচার্য শনাক্ত করেন। পোস্তগোলার শ্মশানে তাঁর গলিত দেহাবশেষ দাহ করা হয়।

ড. সিরাজুল হক খান (১৯২৪-১৯৭১) সিরাজুল হক খান ১৯২৪ সালের ১লা জানুয়ারি ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার সাতকুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চান মিয়া খান। তিনি ১৯৩৯ সালে ফুলগাজী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৪১ সালে ফেনী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন। এরপর তিনি কয়েক বছর ফুলগাজী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি পাস করেন এবং প্রায় ১৬ বছর ঢাকার বিভিন্ন সরকারি স্কুলে শিক্ষাদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এমএড এবং ১৯৬৭ সালে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলারোডা থেকে শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের ১১ই জানুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৬শে মার্চের গণহত্যার পর ড. সিরাজুল হক খান খিলগাঁয় এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বসবাস শুরু করেন। সিরাজুল হক খান গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ সাহায্য করতেন। বিষয়টি ক্যাম্পাসে অবস্থানরত অবাঙালি শিক্ষক ও দালালরা জানতে পারে। ফলে ড. সিরাজুল হক খান মর্মান্তিক পরিণতির সম্মুখীন হন। ১৪ই ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ৩৬নং ফুলার রোডের বাসার নিচতলা থেকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা (১৯৩১-১৯৭১) ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৩১ সালের ১লা এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার চণ্ডীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলানা আবদুল মান্নান আজাহারী। ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৪৬ সালে কলকাতার বালীগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ১ম শ্রেণিতে প্রবেশিকা এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১ম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। ৬০-এর দশকে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জনসংখ্যা ও সম্পদ শীর্ষক গ্রন্থ রচনার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক
পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অনেক সময় প্রকাশ্যেই বাঙালির মুক্তির কথা বলতেন। তিনি ফুলার রোডের ১৪/এ বাসায় বাস করতেন। ১৪ই ডিসেম্বর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে তাঁর বিকৃত ও গলিত মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যা: শেষ পর্ব
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী-র যৌথ আক্রমণে পাকবাহিনীর পরাজয় যখন অত্যাসন্ন, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা চালায়। উল্লেখ্য, জুন মাস থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক শিক্ষকবৃন্দের একাংশ বিভিন্ন সময়ে এদের কাছ থেকে জীবনের হুমকি সম্বলিত চিঠি পেয়ে আসছিলেন। যাঁরা এ ধরনের চিঠি পেয়েছেন, তাঁদের একাংশ বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনার শিকার হয়েছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার পশ্চাতে উদ্দেশ্য ছিল নব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বশূন্য করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে একেবারে পঙ্গু করে দেয়া, যাতে স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে এবং দীর্ঘদিন পঙ্গু হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সর্বত্রই বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি সংঘটিত হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নেপথ্যে কতিপয় অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থী বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের হাত ছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঙালি শিক্ষকদের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এ সকল অবাঙালি শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বসবাস করত। ২৬শে মার্চের পর তারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী শক্তি। স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি শিক্ষকদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য তারা পাকবাহিনীকে সবসময়ই জানাত। এক কথায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঙালি শিক্ষকবৃন্দ বসবাস করতেন শত্রু- পরিবেষ্টিত অবস্থায়। ঘাতক আলবদর বাহিনী পরিচালিত হতো সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশেI
ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গেরিলা আক্রমণে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে একদল শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ৩রা ডিসেম্বর ভারতীয় এলাকায় বোমা বর্ষণ শুরু করলে ভারত সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ঢাকায় প্রতিদিন সান্ধ্য আইন ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এর ফলে সার্বিক পরিস্থিতি দ্রুত মোড় নেয়। একদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ, অন্যদিকে কারফিউ অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকামী বাঙালি শিক্ষকদের একাংশ কাছাকাছি সময়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়, কেউ-কেউ যাবার চেষ্টা করেছিলেন। কোনো-কোনো শিক্ষক দিনের বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করলেও সন্ধ্যার পূর্বে ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যেতেন। এরপরও বহুসংখ্যক বাঙালি শিক্ষক ক্যাম্পাসে থেকে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য যখন প্রায় উদিত, জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা যখন মাত্র সময়ের ব্যাপার, সেই চরম মুহূর্তের দুদিন আগে ঘটে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা। ১৪ই ডিসেম্বর সকাল ৮-১০টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা এবং অন্যান্য স্থান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক ও পেশাজীবীকে আলবদর বাহিনী অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। কারফিউ অব্যাহত থাকার মধ্যেই তা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসরত অবাঙালি ও পাকিস্তানি দালাল বাঙালি শিক্ষকদের দ্বারা চিহ্নিত বাসায় আলবদর বাহিনী অভিযান চালায় এবং চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় প্রথিতযশা এসব শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. মোর্তজার চোখ বাঁধে তাঁর শিশু কন্যার শাড়ি দিয়ে, ড. আবুল খায়েরের ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীর লাল শাল দিয়ে এবং গিয়াসউদ্দীনের চোখ বাঁধে তাঁর হলের দারোয়ানের গামছা দিয়ে। ফলে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে তাঁদের লাশ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
আলবদর বাহিনী কর্তৃক ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের ধরে নেয়ার ২১দিন পর ১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পুলিশ বাহিনীর ইনটেলিজেন্স ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের নতুন ডিআইজি এন এম খান, ঢাকার ইনটেলিজেন্স ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের এ পি আবদুস সামাদ তালুকদার ও মিত্রবাহিনীর মেজর কুণ্ডুর নেতৃত্বে গঠিত একটি বিশেষ টিম বুদ্ধিজীবীদের দেহাবশেষ অনুসন্ধানে নামে এবং সফল হয়। গলিত মৃতদেহ দেখে সেহজেই অনুমান করা যায় যে, হতভাগ্য বুদ্ধিজীবীদের চোখ বাঁধা অবস্থায় অত্যন্ত নৃশংসভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডাক্তার মোর্তজার দেহ তাঁর শ্যালক ওমর হায়াত পরিধেয় লুঙ্গি, শার্ট এবং তাঁর শিশু কন্যার যে শাড়ি দিয়ে চোখ বাঁধা হয়েছিল তা দেখে শনাক্ত করেন। কোমরের বেল্ট ও শার্ট- প্যান্ট দেখে ড. সিরাজুল হক খানের দেহ শনাক্ত করেন তাঁর পুত্র এনামুল হক খান। ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের দেহ শনাক্ত করেন তাঁর পুত্র প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের ধূসর চুল ও পোষাক-পরিচ্ছদই ছিল একমাত্র চিহ্ন। ড. ফজলুল মহীর দেহ শনাক্ত করেন তাঁর ভাই আবদুল আউয়াল। বুদ্ধিজীবীদের দেহাবশেষ এতটাই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও গলিত হয়ে গিয়েছিল যে, তা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ৬ই জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসিজদ প্রাঙ্গণে অত্যন্ত শোকাহত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় বর্বর আলবদর বাহিনীর হাতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জানাজা। এই জানাজায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিকসহ বিপুল সংখ্যক শোকাভিভূত ছাত্র-শিক্ষক ও জনতা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের সন্নিকটে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সমাহিত করা হয় এবং ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের দেহাবশেষ সৎকার করা হয় শ্যামপুর শ্মশানঘাটে। [রতন লাল চক্রবর্ত্তী ও মনিরুজ্জামান শাহীন]
তথ্যসূত্র: রতন লাল চক্রবর্ত্তী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৭-১৯৭১, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা, দি ইউনিভার্সেল একাডেমী, ২০১৫

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড