ঢাকা শহর গণহত্যা ও বধ্যভূমি
ঢাকা শহর গণহত্যা ও বধ্যভূমি ১৯৭১-এ পুরো বাংলাদেশকে একটি বধ্যভূমি বানিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। বাংলাদেশের নানা স্থানে বধ্যভূমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কোনো- কোনো বধ্যভূমি রয়েছে নগরের প্রান্তে, কোনোটি ইট-কাঠের মাঝে, কোনোটি জলার ধারে, কোনোটি বনাঞ্চলে বা কৃষিজমিতে। প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে শহীদদের দেহাবশেষ ও রক্ত। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ পরিচালিত মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ও ফরেনসিক গবেষণায় দেখা যায় যে, দেশে ছোট-বড় প্রায় ৫ হাজার বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার বধ্যভূমি শনাক্ত করে করা সম্ভব হয়েছে। আর ৩ হাজার বধ্যভূমি হয়তো কোনোদিনই চিহ্নিত করা যাবে না, কেননা সেগুলো ইমারতের তলদেশ, কংক্রিটের ঢালাই, রাস্তাঘাট এবং ক্ষেত-খামারের মধ্যে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। চিহ্নিত করা যায় এমন বধ্যভূমির বাইরে ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ ব্যবহার করে ৭১-এর ঘাতকগোষ্ঠী গণহত্যা চালায়। সামগ্রিকভাবে প্রায় ৭০ ভাগ বধ্যভূমি রয়েছে বিভিন্ন জলার ধারে। ঐ সময় যারা গণহত্যা ও নির্বিচার হত্যার শিকার হন, তাদের ৭০ ভাগকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে।
বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা পরিকল্পনার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজধানী ঢাকা শহর এবং এর শহরতলী এলাকা। ২৫শে মার্চ রাতেই এ শহরে হত্যা করা হয় ৭ হাজারের অধিক ঘুমন্ত ও ঘুম থেকে জেগে ওঠা নিরীহ মানুষকে। ঐদিন মধ্যরাত থেকে ২৭শে মার্চ দুপুর পর্যন্ত অপারেশন সার্চলাইট-এর আওতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৩ থেকে ২৪ হাজার লোককে ঢাকা শহরে হত্যা করে। কারো মতে এ সংখ্যাটি ৫০ হাজার হতে পারে। এছাড়া ঐ সময়ের মধ্যে টঙ্গী থেকে বুড়িগঙ্গা হয়ে জিঞ্জিরা এবং মিরপুর ব্রিজ থেকে আদমজী পর্যন্ত এলাকায় প্রায় ৯০ হাজার মানুষ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হয়। এপ্রিলের মধ্যে জনবহুল এ শহরের অর্ধেক লোক আত্মরক্ষার জন্য যে যেখানে পারে পালিয়ে যায়।
সারা দেশে সবচেয়ে বেশি বধ্যভূমি পাওয়া গেছে ঢাকা শহর ও তার উপকণ্ঠে। এখানে ৬৪টি বধ্যভূমি ও গণহত্যা স্পট চিহ্নিত হয়েছে। সেগুলো হলো- ১. জগন্নাথ হল, ২. ঢাকা হল, ৩. রোকেয়া হল, ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল, ৫. জহুরুল হক হল (ইকবাল হল), ৬. রমনা পার্ক, ৭. রমনা কালীবাড়ি, ৮. শাঁখারী বাজার, ৯. তাঁতী বাজার, ১০. নারিন্দা মাঠ, ১১. নারিন্দা বাজার, ১২. নারিন্দা মন্দির, ১৩. লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, ১৪, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ১৫. সূত্রাপুর লোহার পুল, ১৬, জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়), ১৭. নবাবপুর বিসিসি রোড, ১৮. নবাবপুর খালপার, ১৯. মৎস্যপট্টি, ২০. ঠাঁটারী বাজার, ২১. ইসলামপুর ফাঁড়ি, ২২. সোয়ারিঘাট, ২৩. ধলপুর ডিপো, ২৪. দয়াগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প, ২৫. টিএন্ডটি কলোনি, ২৬. (আদমজীনগর), ২৭. সেনানিবাস (কুর্মিটোলা), ২৮. কুর্মিটোলা গোডাউন, ২৯. ঢাকা সেনানিবাস, ৩০. পুরাতন বিমান বন্দর, ৩১. তেজগাঁ এতিমখানা, ৩২. এমএনএ হোস্টেল (নাখালপাড়া), ৩৩. কৃষি সম্প্রসারণ ইনস্টিটিউট (তেজগাঁ), ৩৪. টিবি হাসপাতাল (মহাখালী), ৩৫. ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়, ৩৬. ইস্কাটন গার্ডেন, ৩৭. শারীরিক শিক্ষা কলেজ (মোহাম্মদপুর), ৩৮. রায়েরবাজার, ৩৯. আদাবর, ৪০. কল্যাণপুর বাসডিপো, ৪১. জল্লাদখানা (মিরপুর), ৪২. মুসলিম বাজার (মিরপুর), ৪৩. সারেংবাড়ি (সেকশন-১, মিরপুর), ৪৪. বুদ্ধিজীবী কবর স্থান (হরিরামপুর গোরস্থান, মাজার রোড), ৪৫. ওয়াপদা বিল্ডিং (সেকশন-১০, মিরপুর), ৪৬. পানির ট্যাংক (সেকশন-১২, মিরপুর), ৪৭. কালাপানির ঢাল (সেকশন-১২, মিরপুর), ৪৮. ১৩নং সেকশন (মিরপুর), ৪৯. ১০/সি লাইন (সেকশন-১৪, মিরপুর), ৫০. ১৪নং সেকশন (মিরপুর), ৫১. সিরামিক ফ্যাক্টরি (মিরপুর), ৫২. শিয়ালবাড়ি (মিরপুর), ৫৩. হরিরামপুর (মিরপুর), ৫৪. মিরপুর ব্রিজ, ৫৫. রাইনখোলা (মিরপুর), ৫৬. দারুল রশিদ মাদ্রাসা (মিরপুর), ৫৭. বায়তুল আজমত জামে মসজিদ (মিরপুর), ৫৮. আলোকদি (মিরপুর), ৫৯. বাংলা কলেজ (মিরপুর), ৬০. সিন্নিরটেক (মিরপুর), ৬১. গোলারটেক (মিরপুর), ৬২. প্রিন্স আয়রন এন্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ (মিরপুর), ৬৩. খালের পাড় (মান্দাইল) ও ৬৪. পোস্তগোলা। এর মধ্যে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণ, রমনা কালীবাড়ি, শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, নারিন্দা, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, নারিন্দা মন্দির, জল্লাদখানা (মিরপুর ১০নং সেকশন) এবং মিরপুরের কালাপানির ঢাল ক্লাসিক্যাল গণহত্যা স্পটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় শুধু মিরপুরে বধ্যভূমির সংখ্যা ২৫। খোঁজাখুজি করলে আরো অনেক বধ্যভূমি বেরিয়ে আসবে। ২৫শে মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় ৫৭ বিগ্রেডের একটি কলাম তেজগাঁ বিমানবন্দর ও ফার্মগেট অতিক্রম করে। ঐ বিগ্রেডের ২২ বালুচ রেজিমেন্ট আক্রমণ করে পিলখানা এবং ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। ৩২ ও ১৮ পাঞ্জাব এবং ২২ বালুচের একটি করে মোট ৩টি কোম্পানির ৪ শতাধিক সৈন্য নামানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তদ্সংলগ্ন এলাকায়, যাদের দায়িত্ব ছিল জগন্নাথ হল ও জহুরুল হক হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হল, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, শহীদ মিনার, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজের পেছনের বকশীবাজার রেল লাইন ও পলাশী সংলগ্ন এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে টার্গেটসমূহ সমূলে ধ্বংস করা।
ঢাকা শহর ও এর আশপাশের প্রধান-প্রধান বধ্যভূমি ও গণকবরের পরিচিতি-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: মেশিনগানের গুলি ছুড়ে, হলের ভেতর এবং আঙ্গিনায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শত্রুদুর্গ দখলের কায়দায় জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল, রোকেয়া হল, ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) ইত্যাদি লক্ষ্যবস্তুর ওপর ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল তাজ। অপারেশনকালে তারা হলের প্রতিটি কক্ষে হানা দেয়। সিঁড়ির নিচ, আনাচ-কানাচ, ছাদ, ড্রেন, হলের নিম্নশ্রেণির কর্মচারীদের কোয়ার্টার্স, শিক্ষকদের আবাসস্থল কোনো কিছুই তাদের তাণ্ডবের হাত থেকে রেহাই পায়নি; রক্ষা পায়নি ছাত্রদের সেবায় নিয়োজিত মেস স্টাফ, ধোপা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়িগণ। ছাত্রদের যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই তারা হত্যা করেছে। হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েও ছাত্ররা পাকিস্তানি সেনাদের হত্যার কবল থেকে রক্ষা পায়নি। হলে অবস্থানকারী বহিরাগতরাও তাদের হত্যার নির্মম শিকার হন।
২৫শে মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও বহিরাগত অতিথি মিলে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করা হয় এবং গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। ঐ ৭০ জনের মধ্যে ৩ জন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র ও ৪ জন ছিল হলের কর্মচারী। শহীদ ৩ জন শিক্ষক হলেন ড. এ এন এম মুনিরুজ্জামান, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জি সি দেব) ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। ২৭শে মার্চ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লেখক ডা. এম এ হাসান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে দেখতে পান। ৩০শে মার্চ গুহঠাকুরতা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা মধুসূদন দে-র (মধুদা) বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূকে হত্যা করে। শিববাড়ির ৫ জন সাধুকেও বর্বর পাকসেনারা হত্যা করে। আতঙ্কগ্রস্ত হলের কর্মচারীদের ওপর রাইফেল তাক করে তাদের লাশ সরানোর কাজে নিয়োজিত করে হায়েনার দল। জগন্নাথ হল মাঠের – উত্তর-পশ্চিম কোণায় তাদের দিয়ে বিরাট গর্ত খুঁড়ে লাশ ফেলানো হয়। সে কাজ শেষ হলে তাদেরও গুলি করে গণকবরের গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেয়া হয়। সেখানে কারো হাত, কারো পা মাটি ফুড়ে বের হয়ে আসা অবস্থায় ২৭শে মার্চ পর্যন্ত থাকতে দেখা যায়। এরপর বুলড্রোজারের সাহায্যে লাশগুলোকে মাটির গভীরে ঠেলে দেয়া হয়।
জহুরুল হক হল (সাবেক ইকবাল হল) ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জগন্নাথ হলের অনুরূপ টার্গেট। এ হলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছাত্র নিহত হন। হত্যার পর ২৭শে মার্চ সকালে প্রায় দুশ মৃতদেহ টেনে-হিঁচড়ে হলের সম্মুখে ফুটবল মাঠের পূর্ব দিকে গোল পোস্টের কাছে ৩ সারিতে রাখা হয়। ছাত্র ছাড়া হলের কর্মচারী ও কিছু বহিরাগতও নিহত হয়। ২৭শে মার্চ দুপুর ১২টায় লেখক ডা. এম এ হাসান নিজেই তাদের ঐ অবস্থায় দেখতে পান। একই দিন বিকেলে হলের জীবিত কর্মচারী ও ধাঙ্গড়দের সহায়তায় নিহতদের ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় পুরান ঢাকার ধলপুর ময়লা ডিপোতে। সেখানে তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়।
মধ্যরাতের পর কার্জন হলের নিকটস্থ ঢাকা হলে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন ছাত্র ও ২ জন শিক্ষককে হত্যা করে। তাদের ৪ জনকে (২ জন ছাত্র, ২ জন শিক্ষক) লেখক ২৭শে মার্চ বেলা ১১টায় হলের ভেতর মৃত অবস্থায় দেখতে পান। পরবর্তীতে তাঁদের কোথায়ও পুঁতে ফেলা হয়।
একই রাতে রোকেয়া হলের ৭ জন ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষার বাসায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টার্সে অবস্থানরত মালি, দাড়োয়ান, পিয়ন, ঝাড়ুদার ও তাদের আত্মীয়-পরিজনসহ ৪৫ জনকে হানাদাররা হত্যা করে। স্বাধীনতার পর রোকেয়া হলের পেছনে রাস্তার পাশে একটি গণসমাধি খনন করে ১৫ জনের মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ঢুকে পাকিস্তানি হানাদাররা ২ জন ছাত্রকে হত্যা করে। নিউ মার্কেটের সন্নিকটে অবস্থিত আর্ট কলেজ হোস্টেল (বর্তমান শাহনেওয়াজ হোস্টেল)-এ তারা আর্ট কলেজের ছাত্র শাহনেওয়াজ-কে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলটি আক্রান্ত না হলেও মে-জুন মাসে এখানে অবস্থানরত কতিপয় বাঙালি ছাত্র ও একজন ডাক্তার পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের শিকার হন। ডাক্তারের নাম হাসিময় হাজরা। তাদের হত্যার পর হলের কাছে আমবাগানে গণকবরে ফেলে দেয় পাকিস্তানি হায়েনারা।
রমনা পার্ক এলাকা: মিন্টুরোড সংলগ্ন সাবেক প্রেসিডেন্ট হাউজের বিপরীতে রমনা পার্কের উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে গণকবর ও বধ্যভূমি। প্রেসিডেন্ট হাউজের অভ্যন্তরে বা আশপাশে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের রমনা পার্কের ভেতর গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর প্রেসিডেন্ট হাউজের দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি লাশ পাওয়া যায়।
রমনা পার্কের দক্ষিণে দেয়াল ঘেঁষা ফুলগাছের প্রথম সারির কাছে হানাদারদের খোঁড়া ট্রেঞ্চের মধ্যে ১৬ই ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৯টায় অনেক মহিলার লাশ দেখতে পান মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানি হানাদাররা মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও অভিজাত এলাকা থেকে ধরে এনে গণভবন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও মন্ত্রী পাড়ায় নিয়ে দীর্ঘদিন ধর্ষণ করে। আত্মসমর্পণ করার পূর্ব মুহূর্তে তারা ঐসব মহিলাদের বুক, পেট বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দেয়।
রমনা কালীবাড়ি মন্দির: ২৫শে মার্চ ঢাকা আক্রমণের পর অনেক হিন্দু পরিবার রমনা কালীবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। ২৭শে মার্চ রাতে ২৫শে মার্চের মতো গোলা উড়ে এসে মন্দিরের গায়ে আঘাত হানলে তা ধসে পড়ে। ওপরে-নিচে আশ্রিত মানুষদের পালাবার সুযোগটুকুও ছিল না। চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল পাকিবাহিনী। ২৫শে মার্চ রাতে এবং ২৬শে মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি থেকে যেমন কয়েকজন সাধুকে ডেকে এনে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে হত্যা করা হয়, তেমনি ২৭শে মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর কালীবাড়িতে বসবাসরত মন্দিরের পুরোহিত স্বামীজী পরমানন্দ এবং বহুসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জড়ো করে লাইনে দাঁড় করানো হয়। খাকি পোশাক পরা একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তাদের পাহারা দিচ্ছিল। একটু পরে মেশিনগানের আওয়াজ। এরপর তাদের সবার মৃতদেহ একত্রিত করে পুড়িয়ে দেয়া হয় ঐ রাতেই। সাংবাদিক শিবসাধন চক্রবর্তী ছিলেন এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম শিকার। ঐদিন পুরো মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। ২৯শে মার্চ রাতে এখানে ঘটে বাঙালি ইপিআর হত্যার আর একটি মর্মান্তিক ঘটনা। প্রেসিডেন্ট হাউজ ও গভর্নর হাউজ থেকে ইপিআর অফিসার ক্যাপ্টেন আজাদসহ শতাধিক বাঙালি ইপিআর সদস্যকে এখানে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার নায়ক ছিল লে. কর্নেল আনোয়ার শাহ ও অবাঙালি ইপিআর অফিসার মেজর গোলাম মোহাম্মদ।
শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, নারিন্দা, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির এবং নারিন্দা মন্দির: ২৫শে মার্চ হিন্দু অধ্যুষিত শাঁখারী বাজার পাকিস্তানি সেনাদের ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়। পাকিস্তানি সেনাদের বিশেষ কয়েকটি লক্ষ্যস্থল ছিল শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, নারিন্দা ও সূত্রাপুর। ২৫শে মার্চ থেকে ২৯শে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা ও অস্ত্রধারী বিহারিরা উপর্যুপরি আক্রমণ করে কেবল শাঁখারী বাজারেই ৬ শ হিন্দুকে হত্যা করে। এদের লক্ষ্য ছিল ঐ এলাকার লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির এবং নারিন্দা মন্দির। প্রতিটি মন্দির তারা আক্রমণ করে। মন্দিরে আশ্রয় নেয়া সকল সাধুসহ ভক্ত ও পুরোহিতদের হত্যা করে ঐসব নরপশুর দল। এদের অনেককেই হত্যার পর মন্দির প্রাঙ্গণে পুঁতে রাখা হয়। গণহত্যার অপর দুটি স্থান ছিল নারিন্দা মন্দির সংলগ্ন নারিন্দা বাজার ও নারিন্দা মাঠ।
হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো আক্রমণের সময় নবাবপুর খাল পারের কাঠের আড়ৎ সংলগ্ন এলাকা, ইসলামপুর ফাঁড়ি, নারিন্দা বাজার, সূত্রাপুর, লোহারপুল ও সোয়ারিঘাট বাজার আক্রান্ত হয়। বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে জিঞ্জিরায় আক্রমণ হয় ২রা এপ্রিল।
পুলিশ লাইন্স: ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করে কয়েকশ বাঙালি পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ৩২ পাঞ্জাবের বর্বর সেনারা। পরে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে অনেককেই নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এখানেও নারীদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। এখানে একটি বধ্যভূমিও রয়েছে।
সূত্রাপুর লোহার পুল: পাকসেনা ও তাদের দোসররা বহু মানুষকে সূত্রাপুর লোহার পুলের ওপর এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ পুলের ওপর দাঁড় করিয়েই বিজ্ঞানী ড. হরিনাথ দে- কে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা।
জগন্নাথ কলেজ: এ কলেজে পাকসেনারা সুদৃঢ় ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। তারা ও তাদের দোসররা পুরো ৯ মাস এখান থেকেই পুরনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে অগণিত মানুষকে হত্যা করে ও হাজার-হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটায়। ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি শনিবার ছাত্র সংসদের অফিসের সামনে মানুষের কঙ্কালের অস্তিত্ব পেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশকে সংবাদ দেয়। সে-সময়ের কোতোয়ালি থানা প্রধান রঘুনন্দন সাহা একদল পুলিশ নিয়ে স্থানটি খুঁড়ে ৭টি কঙ্কাল উদ্ধার করেন।
নবাবপুর বিসিসি রোড: এ এলাকার একটি বাড়িতে ছিল রাজাকার ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকাররা ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে।
ঠাঁটারী বাজার মৎস্যপট্টি: নবাবপুর বিসিসি রোডের রাজাকার ক্যাম্প থেকে গ্রেফতারকৃত দুই ঘাতকের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ঠাঁটারী বাজার মৎস্যপট্টির পেছনে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। এ বধ্যভূমিতে তারা বহু মানুষকে জবাই করে হত্যা করে।
ঢাকার ধলপুর ডিপো: ঢাকার ধলপুর ডিপো এলাকায় রয়েছে গণকবর। ধলপুর ময়লা ডিপো নামে পরিচিত স্থানটির বিশাল-বিশাল গর্তে হাজার-হাজার মানুষকে মাটিচাপা দেয়া হয় মার্চ ও এপ্রিল মাসে। ২৫-২৬শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে সমগ্র ঢাকা শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। চারিদিকে পড়ে ছিল লাশ আর লাশ। এসব লাশ সরিয়ে নেবার ভার পড়েছিল ঢাকা পৌরসভার ওপর। এ সময় ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিল পাকিস্তানি মেজর সালামত আলী খানশূর। মেজর সালামত পৌরসভার সকল সুইপার ইন্সপেক্টরকে ডেকে ঢাকা শহরের সব লাশ দ্রুত সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশ অনুযায়ী লাশগুলোকে ধলপুর ডিপো এলাকার গর্তে মাটিচাপা দেয়া হয়। সম্ভবত এটাই ছিল মূল শহরের বৃহৎ গণকবর।
দয়াগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প: দয়াগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প ছিল। ঐ ক্যাম্পে পুরান ঢাকার নানা স্থান থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, চাকুরে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এ ঘটনার সাক্ষী সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ধাঙ্গর রামুর কন্যা কমলা (স্বামীর নাম সুরেশ; মুক্তিযুদ্ধের সময় টিএন্ডটি-তে চাকির করতেন)। তিনি জানান- দয়াগঞ্জ পুলের কাছে আর্মি ক্যাম্প ছিল। বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি সেনা অফিসার কমলার বাবা রামুকে ডেকে নিত। বাবার মুখেই সে শুনেছে, অন্য কথা বলে ডেকে নিয়ে গিয়ে রামুকে দিয়ে লাশ সরানোর কাজ করাত পাকসেনারা। কাজ শেষ হলে আবার তাকে দয়াগঞ্জ পুলের কাছে এনে ছেড়ে দিত। সেই সঙ্গে এ বলে হুঁশিয়ার করে দিত ‘তোমাকে দিয়ে যে কাজ করাই তা কাউকে বলবে না এবং কখনও কাজে ‘না’ বলবে না, যা করতে বলব তাই করবে, তা না হলে গুলি করে মেরে ফেলব।’ কিন্তু রামু প্রতিদিন এসে কমলার মায়ের কাছে সেসব ঘটনা বলত। গ্রেগরি স্কুলের ব্রাদাররা প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, ‘রামু তুমি কোথায় যাও?’ কিন্তু প্রাণের ভয়ে চুপ করে থাকত সে। রাতে জেগে বসে থাকত রামু; আতঙ্কে ঠিকমত ঘুমাতেও পারত না। পাকিসেনারা টাকা-পয়সা তেমন দিত না, তবে তাকে চাল ও আটা দিত।
টিএন্ডটি কলোনি: টিএন্ডটি কলোনির পাশে ছিল একটি জলাশয়। ঐসব স্থান এবং কমলাপুরের কাছে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করে ঐ জলার মধ্যে ফেলে দেয়া হতো। এর সাক্ষী ছিল সুইপার মারি। মরা ঠেলতে ঠেলতে ভীত হয়ে ঐ মারি ৭১-এ ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দর্শনায় ধরা পড়ে। সেখানে শিবলাল নামে একজন ডোমের সঙ্গে তাকে লাশ দাফনে বাধ্য করা হয়। ৬ মাসে কয়েকশ লাশ দাফন করে মারি।
আদমজীনগর শিমুলপাড়া ব্লক: পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা বিভিন্ন স্থান থেকে বহু বাঙালিদের ধরে এনে শিমুলপাড়া ব্লকে হত্যা করে। তাদের লাশ বিভিন্ন কল- কারখানার আঙ্গিনা এবং রাস্তার পাশে মাটিচাপা দেয়া হয়।
সেনানিবাস ও পুরাতন বিমান বন্দর: ঢাকার সেনানিবাস ও তেজগাঁ পুরাতন বিমান বন্দর এলাকার আশেপাশে ছিল বিশাল কয়েকটি গণকবর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন শতশত লাশ নিয়ে ঐখানে আসত। তারপর বুলডোজার চালিয়ে গর্ত করে সেসব লাশ মাটিচাপা দিত। ঢাকা সেনানিবাস ও পুরাতন বিমান বন্দর এলাকায় এভাবে দিনের পর দিন অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়৷
ঢাকা শহরের বস্তি বা বাড়িঘরগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সাঈদের। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের তখনকার বাঙালি ফোরম্যান আফতাব স্বাধীনতাপরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে জানান- ঢাকা সেনানিবাস ও ঢাকার পুরানো বিমানবন্দর এলাকায় সে বুলডোজার চালাত। পাকিস্তানি সেনারা অসংখ্য বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দেয়। ঢাকা বিমান বন্দর সংলগ্ন এলাকায় অসংখ্য লোককে তারা হত্যা করে। প্রায় একশ মেয়েকে ধরে নিয়ে আসা হয় সেনানিবাসে। পাশবিক অত্যাচারের পর সবাইকে হত্যা করা হয়। আফতাব নিজ চোখে সুবেদার শের শাহ খানকে নিরপরাধ মানুষ খুন করতে দেখেছেন। একদিন সাভারের উদ্দেশে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। জিপ থেকে নেমে শের শাহ খান গুলি করে স্বামীকে হত্যা করে।
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ধারে রামুর মতো অনেক ধাঙ্গর তেজগাঁ বিমান বন্দর ও কুর্মিটোলায় নির্মীয়মাণ বিমান বন্দরে বিশাল- বিশাল গর্তে বাঙালিদের মৃতদেহ ঠেলে মাটিচাপা দিত। এরপর বুলডোজার চালিয়ে পুরো স্থানটি পিশে ফেলত পাকিস্তানি সেনারা। প্রত্যেক ধাঙ্গর দৈনিক কয়েকশ মানুষকে গর্তের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। প্রতি মৃতদেহের জন্য ৪ আনা হারে তাদের দেয়া হতো।
কুর্মিটোলা গোডাউন: সে-সময় ঢাকার উত্তর প্রান্তে কয়েক মাইল এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এপ্রিলের শেষে নির্মীয়মাণ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য ৩০০ জন লোক ধরে এনে তাদের জোর করে কাজে লাগায় পাকিস্তানি সেনারা। তাদের অধিকাংশই ছিল বাঙালি মুসলিম। কিছু ছিল পুরান ঢাকার হিন্দু। অধিকাংশ হিন্দুকে শুরুতেই মেরে ফেলা হয়। কুর্মিটোলার একটি গোডাউনে ৫০০-র মতো বন্দি বাঙালি ছিল।
তেজগাঁ এতিমখানা: ৭১-এর শেষ সময়ে তেজগাঁ এতিমখানায় হামলা করে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী। তারা বিশ্ববাসীকে ধারণা দিতে চায় যে, ভারতীয় বাহিনী দেশের ভেতরে ঢুকে এরূপ আক্রমণ চালিয়েছে। এতে ২০ জনের অধিক এতিম সন্তান নিহত হয়। তাদের এতিমখানার ভেতরে মাটিচাপা দেয়া হয়। মাটিচাপা দেয়ার কাজে যাদের ব্যবহার করা হয় তাদের একজন ছিল সুইপার এ্যাল্লাইয়া। সে এক সাক্ষাৎকারে বলে-
চারদিকে যুদ্ধের দম বন্ধ করা পরিবেশ। এরই মধ্যে একদিন তাদের বস্তিতে আসে পাকসেনারা। তাদেরকে ডেকে বলে ‘তোমাদের ভয় নেই, তোমরা এসো’। কিন্তু আতঙ্কিত ছিল তারা। ওদের ভয় ভাঙাতে খান সেনারা বলে, ‘তোমরা ঝাড়ুদার, তোমাদের কিছু কাজ আছে, কাজ শেষ হলে ছেড়ে দেব এবং কিছু জিনিসপত্র দেব।’ এরপর পাঁচ সাত জনকে গাড়িতে করে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। সেখানে ২০-২৫ জন শিশুর লাশ পড়েছিল। এরা সবাই এতিমখানায় আশ্রিত শিশু। সেখানে আগেই গর্ত খোঁড়া ছিল। তার মধ্যে বাচ্চাদের ফেলে মাটিচাপা দেয়া হয়। এরপর গাড়িতে করে তাদের সুইপার কলোনিতে পাঠানো হয়।
এমএনএ হোস্টেল: ঢাকার তেজগাঁ নাখালপাড়া এমএনএ হোস্টেলে অনেককে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা গাজীপুর অস্ত্র কারখানা থেকে বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে ধরে এনে এমএনএ হোস্টেলে হত্যা করে। ঢাকার এমএনএ হোস্টেল ছিল মিনি বন্দিশালা। শেরে বাংলা নগরের বর্তমান সংসদ ভবনে স্থাপিত মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টার্সে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো, তাদের অনেককে রাতের বেলা বা অন্য সময় এমএনএ হোস্টেল পাঠিয়ে দেয়া হতো। এরপর এখানে তাদের হত্যা করা হতো। শহীদ আলতাফ মাহমুদকে এ স্থানে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। এদের প্রায় সবাইকে তেজগাঁ বিমান বন্দরের ভেতরে মাটিচাপা দেয়া হয়। ঐ স্থানে একাধিক গণকবর রয়েছে। অনেককে হত্যা করে ড্রেন ও ম্যানহোলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এমএনএ হোস্টেলেও একটি মার্শাল ল’ কোর্ট স্থাপন করা হয়। এর প্রধান ছিল পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আসলাম। তেজগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ ইনস্টিটিউট: এখানেও নিরীহ মানুষ হত্যার প্রমাণ মিলেছে। এখানকার ২৮, ৩৩ ও ৩৭ নম্বর স্টাফ কোয়ার্টার্স প্রাঙ্গণ খুঁড়ে বেশ কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে এসব হতভাগ্য বাঙালিদের হত্যা করা হয়।
মহাখালী টিবি হাসপাতাল: ঢাকার মহাখালী টিবি হাসপাতালের কাছে একটি গর্ত থেকে ডিসেম্বর মাসে বেশকিছু গলিত ও বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়।
ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়: মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়কে বাঙালি নির্যাতন ও হত্যা কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। প্রতিদিন বহুলোককে ধরে আনা হতো এ কেন্দ্রে। এরপর চলত নির্যাতন। এখানে হত্যা শেষে লাশ কোনো ঘরে অথবা বাথরুমে ফেলে রাখত। এরপর সন্ধ্যা নামলে ঐসব লাশ গাড়িতে করে নিয়ে যেত।
ইস্কাটন গার্ডেন: ইস্কাটন গার্ডেনেও পাওয়া গেছে অসংখ্য নরকঙ্কাল। ইস্কাটন গার্ডেনের কাছে ছিল সেনাবাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের কাছেই একটি গর্ত থেকে অনেক লাশ উদ্ধার করা হয়। গর্ত থেকে শাড়ি, গহনা এবং কিছু টাকা-পয়সাও উদ্ধার হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে ঢাকা শহরের পতনের আগে পাকসেনারা সান্ধ্য আইন জারি করে বিভিন্ন স্থান থেকে মহিলাদের ধরে এনে ইস্কাটনের নানা গৃহে রেখে অত্যাচারের পর হত্যা করে। রায়েরবাজার বধ্যভূমি: ৭১-এর ১৮ই ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়। ঐদিন বধ্যভূমির বিভিন্ন গর্ত বা খন্দক থেকে প্রচুর লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে অধ্যাপক, ডাক্তার, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাঁদের মধ্যে সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ন আ ম ফয়জুল মহী, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক ও ক্রীড়া সংগঠক এম এ মান্নান লাডু ভাই, সাংবাদিক মুহম্মদ আখতার হোসেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের প্রথমে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজের নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দি করে অমানবিক টর্চার শেষে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। আবার অনেককে একই নির্যাতনকেন্দ্রে বা শহরের অন্যত্র হত্যা করে লাশ এ বধ্যভূমিতে এনে ফেলে দেয়া হয়। ১৬ই ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের দুই-একদিন পূর্বে হত্যা করা লাশের পাশাপাশি কালুশাহ পুকুরপাড় থেকে গোল মসজিদ পর্যন্ত রায়েরবাজারের বিস্তীর্ণ মাঠ ও এলাকার হাজার-হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে পড়েছিল অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল। ৯ মাসে কোনো বাঙালি এখানকার ইটখোলার রাস্তা দিয়ে যেতে সাহস করেনি। এখানকার হত্যাকাণ্ডে পাকসেনাদের সহযোগী আলবদর-, বিহারি মুজাহিদ ও রাজাকাররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন ১৯৭২ সালের ২১শে ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা পত্রিকায় তাঁর এক লেখায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, ‘… এরপর বদর বাহিনী আমাদের বাসে করে নিয়ে চললো। কৌশলে চোখের বাঁধন আলগা রাখার সুযোগ হলো বলে দেখতে পেলাম সামনে বিরাট এক বটগাছ। তার সম্মুখে একটা বিরাট বিল। মাঝে মাঝে কোথাও পুকুরের মতো রয়েছে। বটগাছের আরো কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম ১৩০ থেকে ১৪০ জন লোককে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জল্লাদের দল বেয়নেট দিয়ে হত্যালীলা শুরু করে দিয়েছে। ছুঁড়ছে গুলি। চারদিকে আর্ত চিৎকার। আমি চোখের বাঁধনের কাপড়টি সরিয়ে ফেলে খুব জোরে দৌড় দিলাম।’ তিনি সাংবাদিক সেলিনা পারভীন- কে ঘাতকরা কীভাবে প্রথমে মুখে ও বুকে বেয়নেট চার্জ, পড়ে গুলি করে হত্যা করে এবং এর পূর্বে সেলিনা পারভীন তাঁর শিশু পুত্রের জন্য নিজের প্রাণ রক্ষায় যে হৃদয় বিদারক আকুতি ঘাতক-খুনিদের কাছে করেছিলেন, তারও মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেলোয়ার হোসেনের ঐ লেখায় রয়েছে। উল্লেখ্য, অন্যান্য অনেকের মতো তাঁকেও ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকার শান্তিবাগ এলাকা থেকে আলবদর বাহিনী হাত ও চোখ বেঁধে হত্যার উদ্দেশ্যে তুলে এনেছিল মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ নির্যাতনকেন্দ্রে।
আদাবর: মোহাম্মদপুর জয়েন্ট কলোনি ও কল্যাণপুর বাস ডিপোর মাঝামাঝি আদাবরে ১৯৭২ সনে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। জলার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন বাড়িগুলোর বেশির ভাগই ছিল টর্চার সেল ও হত্যা কেন্দ্র। তাদের হত্যা করে বসিলা ও কালিন্দি নদীতে ফেলে দেয়া হতো। এখান থেকে শতশত মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। একটি মসজিদের পাশে পাওয়া গেছে ঐ এলাকার সর্ববৃহৎ গণকবর। ঐ মসজিদের পাশেই ছিল একটি দোতলা ভবন। এ ভবনটি ছিল রাজাকার ও আলবদরদের ক্যাম্প।
মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ নির্যাতনকেন্দ্র: মুক্তিযুদ্ধকালে সামমসজিদ রোডে অবস্থিত মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ (১৯৫৫) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছিল। ২৫শে মার্চের পরপর কয়েক হাজার মিলিশিয়ার আস্তানা হয়ে ওঠে এটি। এরপর এটি বিহারি ঘাতক এবং আলবদরদের আস্তানায় পরিণত হয়। ২৫শে মার্চের পরপর এ স্থানে বন্দি করা হয় ইপিআর সদস্যসহ বেশকিছু বাঙালি ছাত্র, শিক্ষক এবং সরকারি কর্মকর্তাকে। শুরুতে অবাঙালি ইপিআর অফিসার গোলাম মোহাম্মদসহ ইপিসিএফ-এর মিলিশিয়া সদস্য এ ক্যাম্পের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। এটি হয়ে ওঠে ঢাকার অন্যতম বন্দিশালা ও নির্যাতনকেন্দ্র। কলেজের জিমনেসিয়াম ও প্রশাসনিক ভবনের কয়েকটি কক্ষ ছিল তাদের নির্যাতনের স্থান। চারদিক থেকে বদ্ধ অন্ধকার কক্ষ। আলো, বাতাস, পানি কোনো কিছুই নেই। সারক্ষণ বন্দিরে হাত ও চোখ বাঁধা থাকত। এ অবস্থায় তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হতো। এটি নারী নির্যাতনেরও অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে এখানকার কলেজ সংলগ্ন মাঠটি রাজাকার ও আলবদরের ট্রেনিং সেন্টার ছিল। এক সময় এটি পরিদর্শনে আসে ব্রিগেডিয়ার বশির, রাও ফরমান আলী, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ। আলবদর বাহিনীর সালাউদ্দিন উইং-এর প্রধান আশরাফুজ্জামান খান এবং তার অন্যতম সহযোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমরান ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ওখানে মিটিং করে।
সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, ইপিআর-এর শওকত আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ন আ ম ফয়জুল মহী, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী প্রমুখকে এখানে এনে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন শেষে হাত ও চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা অবস্থায় বন্দিদের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হতো রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। সেখানে একাধিক গ্রুপকে রশি দিয়ে লাইন করে বাঁধা অবস্থায় রেখে ৬-৭ জনকে অন্ধকারে নিয়ে বুক ও পেটের মাঝখানে বেয়নেট ঢুকিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে মাটিতে ফেলে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হতো। তারপর মৃতদেহগুলো পুকুর বা জলাশয়ে ফেলে দিত।
পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের পর শারীরিক শিক্ষা কলেজের দেয়ালে, সিঁড়িতে, মেঝেতে চতুর্দিকে শুধু রক্তের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। কোথাও রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে। শুকনো রক্তের ছাপগুলো সম্ভবত নিহতদের বাঁচার শেষ আকুতির চিহ্ন ছিল। নির্যাতনের সময় অনেককে বেয়নেট চার্জ করা হয়। এখানে মেয়েদের লম্বা চুল পড়ে থাকতে দেখা যায়।
কল্যাণপুর বাসডিপো: কল্যাণপুর বাসডিপোর কাছাকাছি স্থানে যাত্রীবাহী কোচ ও বাস থামিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে এরপর তাদের হত্যা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে।
মিরপুর বধ্যভূমি ও গণহত্যা: মিরপুর ছিল পূর্ব থেকেই বিহারি অধ্যুষিত পাকিস্তানি দোসরদের আস্তানা এবং যুদ্ধকালে মিনি ক্যান্টনমেন্ট। মিরপুরের প্রতিটি ইঞ্চি যেন ছিল বধ্যভূমি। প্রতি ১০০০ বর্গমিটারে ১০-১২ বর্গমিটার পরপর বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটেয়ে থাকা বধ্যভূমি পাওয়া যায় মিরপুরে। অবাঙালি অধিবাসী, পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদাররা এখানে একাধিক হত্যাকেন্দ্র গড়ে তোলে। আইএসআই ও পাকিস্তানি সেনা পরিচালিত অনেকগুলো সামরিক, আধাসামরিক ও বেসামরিক কিলিং স্কোয়াড ছিল ঐ মিরপুরে। ইপিসিএএফ, প্যারামিলিটারি ও রাজাকার সমন্বিত এই কিলিং স্কোয়াড-এর জন্য বিহারি অধ্যুষিত এলাকাগুলো ছিল অভয়ারণ্য। এ ধরনের কিলিং স্কোয়াড ঢাকার মোহাম্মদপুর, আদাবর, কাটাবন, রায়েরবাজার, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, নাখালপাড়া, মালিবাগ, স্বামীবাগসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়ানো- ছিটানো ছিল।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা মিরপুরের সংখ্যালঘু বাঙালিদের হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ঘৃণ্য পেশাদার হত্যাকারী ও কসাইদের দ্বারা এখানে প্রতিদিন অগণিত নিরীহ বাঙালিকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে হত্যা করেছে। কখনো দিনের পর দিন বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা বাঙালি নরনারীকে বন্দি করে নির্যাতন করেছে এবং তারপর। নৃশংসভাবে হত্যা করে এখানে ছড়ানো-ছিটানো কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কখনো এদের অঙ্গচ্ছেদ করে উল্লাস করেছে। এ এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ি, কল-কারখানা, নদীর ধার, স্টিল মিল, সিরামিক ফ্যাক্টরি সবই ব্যবহার করেছে হত্যাকাণ্ডের উন্মুক্ত স্থান হিসাবে।
১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় হলেও মিরপুর ছিল বিহারিদের নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিহার রেজিমেন্টকে মিরপুরের সশস্ত্র বিহারিদের নিয়ন্ত্রণ করার। দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তারা মূলত একই এলাকার : অধিবাসী অর্থাৎ বিহারের অধিবাসী হওয়ায় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল বলে মনে হয়। ফলে সে অভিযান ব্যর্থ হয়। পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে লে. সেলিম (লেখক ডা. এম এ হাসানের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) নেতৃত্বে বিহারিদের কবল থেকে মিরপুর উদ্ধার করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩০শে জানুয়ারি ১৯৭২ সম্মুখ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরের দিন মিরপুর শত্রুমুক্ত হয়।
৩০শে জানুয়ারি এখানে যাঁরা শহীদ হন, তাঁদের মধ্যে ৪৫ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- লে. সেলিম এম কামরুল হাসান, সুবেদার আব্দুল মোমিন, হাবিলদার ওয়ালি উল্লাহ, হাবিলদার মো. হানিফ, নায়েক হাফিজ আহম্মেদ, নায়েক তাজুল হক, নায়েক আবুল ফজল, নায়েক শামসুল হক, ল্যান্স নায়েক আব্দুল রাজ্জাক, ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম, সিপাহি নূর মিঞা, সিপাহি আব্দুল মোতালেব, সিপাহি আব্দুস সামাদ, সিপাহি কেরামত আলী, সিপাহি আবুল কালাম মিয়া, সিপাহি শফিকুর রহমান, সিপাহি আজিজুল হক, সিপাহি আবুল খায়ের পাটোয়ারী, সিপাহি ইকরামুল হক, সিপাহি আব্দুল হক, সিপাহি আব্দুস সামাদ, সিপাহি ফয়েজ উদ্দিন, সিপাহি হাফিজুর রহমান, সিপাহি মোমিনুল হক, সিপাহি আব্দুর রশিদ হাওলাদার, সিপাহি মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ, সিপাহি মো. দেলোয়ার হোসেন, সিপাহি আবুল খায়ের, সিপাহি আব্দুল হাই, সিপাহি আমজাদ উদ্দিন, সিপাহি সোবহানুল বারী চৌধুরী, সিপাহি ইউনুস মিঞা, সিপাহি রফিকুল ইসলাম, সিপাহি রফিকুল আলম, সিপাহি ফজলুল হক, সিপাহি আব্দুল খালেক, সিপাহি সিদ্দিক মিঞা, সিপাহি মজিবুর রহমান, সিপাহি আ. কাদের, সিপাহি আলী আহাম্মেদ, সিপাহি মো. হানিফ সরকার, এ এস পি জিয়াউল হক খান লোদী, এ সি আবদুল ওয়াহেদ, ও সি কাজী আব্দুল আলিম এবং চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান।
মিরপুর জল্লাদখানা: মিরপুর ১০নং সেকশনের বধ্যভূমির পরিচিতি জল্লাদখানা হিসেবে। খালের ধারের এ নির্জন এলাকায় ছিল একটি ছোট পাকা ঘর। পয়ঃনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল এর অবস্থান। ৭১-এ শতশত লোককে নির্মমভাবে নির্যাতন করে এখানে হত্যা করা হয়। এখানে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে অমানবিক নির্যানত শেষে অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর ট্যাংকের গর্ত থেকে উদ্ধার করা হয় অগণিত লাশ। চল্লিশ ফিট গভীর এ ট্যাংকটি ছিল নরকঙ্কালে ভরা। নরকঙ্কাল ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখে বোঝা যায়, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সের মানুষকেই ঘাতকরা এখানে হত্যা করে। ১৯৯৯ সালের ১৫ই নভেম্বর থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ১০ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে অবস্থিত জল্লাদখানা বধ্যভূমির খনন কাজ শুরু করে। খনন কাজ চলাকালে হাড়গোড়, মাথার খুলি ছাড়াও প্লাস্টিকের জুতা, বুটের শুকতলি, স্যান্ডেল, কাঁচি, বেণীর অংশ, কানের দুল, হাতের চুড়ি ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের ৭ম ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ৪৩ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এ বধ্যভূমি থেকে মোট ৭০টি মাথার খুলি ও ছোট-বড় ৫,৩৯২টি হাড়গোড় এবং শহীদদের ব্যবহৃত অন্যান্য নিদর্শন উদ্ধার করে। জল্লাদখানা থেকে প্রাপ্ত হাড়গোড়ের ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’র বিশেষজ্ঞগণ জীবাণুমুক্ত করে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির পক্ষ থেকে লেখক নিজে দেশে ও দেশের বাইরে ঐসব হাড়ের ডিএনএ টেস্টসহ উচ্চতর ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নেন। এখানে অধিকাংশ লোককে ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে জবাই করে হত্যা করা হয়। কাউকে-কাউকে রড জাতীয় ভোঁতা অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করে হত্যা করা হয়। বেশকিছু হাড়ে বিশেষ করে মাথায় গুলির চিহ্ন এবং ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।
এখান থেকে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে হত্যা ও নির্যাতন কার্যে ব্যবহৃত বেশকিছূ যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়। তার মধ্যে আঙ্গুলের অগ্রভাগ এবং নখে চাপ দেবার একটি যন্ত্রও উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল এখান থেকে ঐ সময় ব্যবহৃত গোলাবারুদ ও তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করে, যা খননকার্য চলাকালে নিষ্ক্রিয় করা হয়।
মুসলিম বাজার (মিরপুর): ২৭শে জুলাই ১৯৯৯ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে মুসলিম বাজার সংলগ্ন নূরী মসজিদের খনন কার্য চালানোর সময় এ বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ট রাজাকারদের হিংস্রতা যে কত ভয়াবহ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এ খনন কার্যের সময়। এতে বেরিয়ে আসে ৭১- এর সেসব হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচিহ্ন। মাথার খুলি ও হাড়গোড়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে চুলের বেণী, ওড়না, কাপড়ের অংশবিশেষসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য সামগ্রী। ধারণা করা হয়, এখানে ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্যাতিত বাঙালিসহ ৩০শে জানুয়ারি মিরপুর মুক্তি অভিযানে শহীদ হওয়া লে. সেলিম, তাঁর ৪১ সহযোদ্ধা, পুলিশের এএসপি জিয়াউল হক খান লোদী ও পুলিশ বাহিনীর অন্যান্য সদস্যসহ অনেকের লাশ নূরী মসজিদের কূপসহ মিরপুরে ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন কূপের মধ্যে ফেলা হয় ও আশপাশে মাটিচাপা দেয়া হয়। এদের কাউকে কালাপানির ঢালেও ছুড়ে ফেলা হয়। মসজিদ কমিটি প্রথমে ব্যাপারটি ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জানাজানি হয়ে যাওয়ায় ও কতিপয় স্থানীয় যুবকের তৎপরতার কারণে আর ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি।
মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন পানির ট্যাংক: এখানে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ট্যাংকের আশপাশের বিভিন্ন ডোবায় তাদের মৃতদেহ ফেলে দেয়া হতো। এ অঞ্চলে ঐ সময় অনেক কুয়ো ছিল। অনেকের দেহ টুকরো-টুকরো করে ঐ সমস্ত কুয়োয় ফেলে দেয়া হয়। সিরামিক ফ্যাক্টরি (মিরপুর) : মিরপুর ১২নং সেকশনের সিরামিক ফ্যাক্টরির প্রবেশ পথের ডান দিকের ঢালে একটি নিচু জমি, কুয়ো এবং ডোবা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিবাহিনীর গাড়ির আনাগোনা ছিল সিরামিক কারখানায়। সন্ধ্যার পর কারখানার ট্রাকগুলোর গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক। কারখানার ভেতর এবং আশেপাশে অসংখ্য ইটের স্তূপের ফাঁকে প্রায় নিয়মিতভাবে নিরপরাধ বাঙালি বন্দিদের নিয়ে কখনো জবাই করে কখনো ভারী জিনিসের আঘাতে মাথা থেতলিয়ে হত্যা করা হতো। অধিকাংশ লাশ ঐ জলায় এবং কুয়োয় ফেলে দেয়া হতো। স্বাধীনতার পর জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বেশকিছু লাশ ঐ এলাকা থেকে উদ্ধার করেন। কারখানার ভেতর নিরপরাধ মানুষদেরকে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো।
শিয়ালবাড়ি (মিরপুর): ঢাকার মিরপুরের উপকণ্ঠে অবস্থিত শিয়ালবাড়ি। সে-সময় আড়াই হাজারের মতো লোক এ গ্রামে বাস করত। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস এ গ্রামটি ছিল জনমানবশূন্য। ১৯৭২ সালে পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিনিধি গ্রামটি ঘুরে এসে যে রিপোর্ট করেন, তার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা হলো— ‘খবর পেয়ে শিয়ালবাড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। মিরপুরের পুলিশ ভাইয়েরাও আমাদের সাথে ছিলেন। তন্ন তন্ন করে সারা গ্রাম দেখলাম। মনে হল, প্রতি ইঞ্চি জায়গাতে মানুষের লাশ আর কঙ্কাল পড়ে আছে। এত কঙ্কালের মিছিল জীবনে কেউ কোথাও দেখেছে বলে মনে হয় না। ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে যেখানে চোখ ফেলেছি দেখেছি শুধু মানুষের কঙ্কাল। কোথাও পরনের টুকরো কাপড়টা, কোথাও মাথার চুল, গায়ের গেঞ্জি।’
হরিরামপুর (মিরপুর): মিরপুরের হরিরামপুরেও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমান মিরপুর বুদ্ধিজীবী মাজার রোড থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে হরিরামপুর গোরস্থান সংলগ্ন একটি গর্ত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ও একজন চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষককে এখানে এনে হত্যা করা হয়। হরিরামপুর ইউনিয়নের বাইলজুরি গ্রাম ও খালপাড়ে অসংখ্য লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
হরিরামপুরে বাঙালি পরিবারগুলো গৃহ ছেড়ে চলে গেলে তাদের শূন্য গৃহগুলো হত্যাকেন্দ্রে পরিণত হয়। এর একটি গৃহ ছিল ডা. আজমলের। হরিরামপুর ইউনিয়নভুক্ত লাল কুটির মাজার রোডে ৮/বি/ই বাড়িটিতে থাকতেন বাঙালি ডাক্তার আজমল হোসেন। একজন সরকারি চিকিৎসক হিসেবে ১৯৬৫ সাল থেকে নির্ভয়ে সেখানে তিনি বসবাস করে আসছিলেন। ২৫শে মার্চ প্রাণের ভয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। স্বাধীনতার পর ৭২-এর এপ্রিলে ঘরে ফিরে পুরো ঘরে জমাট বাঁধা রক্ত ও রক্তের ছাপ দেখতে পান। ঐ অঞ্চলের অসংখ্য পরিত্যক্ত গৃহের মতো তাঁর গৃহটিও হত্যা ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবর স্থান (হরিরামপুর গোরস্থান): ৯ই জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত রিপোর্টে একটি ডায়েরির কথা বলা হয়। সে ডায়েরিটি বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের বলে উল্লেখ করা হয়। এই আশরাফুজ্জামান মিরপুর হরিরামপুর গোরস্থানে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। যে গাড়িতে করে শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয়, তার চালক মফীজ উদ্দীন পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানায়।
এ ডায়েরিটির দুটি পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিকিৎসক গোলাম মোর্তজার নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। এই ২০ জনের মধ্যে ১৪ই ডিসেম্বর যে ৮ জন নিখোঁজ হন, তাঁরা হলেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট), আনোয়ার পাশা (বাংলা), রশীদুল হাসান (ইংরেজি), অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), ড. ন আ ম ফয়জুল মহী (শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) ও ডা. গোলাম মোর্তজা।
৫ই জানুয়ারি ১৯৭২ মিরপুর গোরস্থানে মাটির নিচে পাওয়া যায় ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, ড. ন আ ম ফয়জুল মহী ও ডা. মোর্তজার লাশ। অন্য ৩টি লাশ ছিল ভয়ানকভাবে গলিত ও বিকৃত, যা শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বাংলা কলেজ: বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ধরে এনে এখানকার আমবাগানে তাদের হত্যা করা হতো। স্বাধীনতার পর এ স্থানটির সর্বত্র নরকঙ্কাল ছড়িয়ে ছিল। শাড়ি, ব্লাউজ, চুল এসব পাওয়া গেছে এখানে। এ স্থানটিতে অনেক নারীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছে। যে জায়গাটিতে হত্যা করা হতো, সেখানে একটি গভীর গর্ত এবং কয়েকটি উঁচু ঢিবি ছিল। তার নীচে ছিল শহীদদের দেহাবশেষ।
মিরপুর ব্রিজ: মিরপুর কালী নদীর ওপরের ব্রিজটি ছিল নির্বিচার হত্যার আরেকটি স্থান। সন্ধ্যার পর এ ব্রিজের নিকট বিভিন্ন স্থান থেকে হাত ও চোখ বাঁধা অসংখ্য যুবককে এখানে এনে হত্যা করত পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের অনেককেই বিহারি কসাইরা পশুর মতো জবাই করে কালী নদীতে ছুড়ে ফেলে দিত। অনেককে দিনের বেলাতেও বাস থেকে নামিয়ে এনে এখানে হত্যা করা হয়েছে। একাজে নির্মাণাধীন ব্রিজটি অধিকাংশ সময় ব্যবহার করা হয়েছে। আর মিরপুরে যেসব দালাল এরূপ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে আখতার গুন্ডা, নেসার, কালু, বুল্লা, ভকসা মাছওয়ালা, মজিদ বোম্বার, আলী আসগর ওরফে মাস্তানা ও বেনারসীর নাম উল্লেখযোগ্য। মিরপুর ১২নং সেকশনে মাস্তানার বাড়ির পার্শ্বের কুয়োটিও ছিল একটি কিলিং স্পট।
কালাপানির ঢাল (মিরপুর ১২নং সেকশন): ৩১শে জানুয়ারি ১৯৭২ অবাঙালি মুজাহিদ ও পাকিস্তানি সেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত এলাকাটি মুক্তকরণ অভিযানে লে. সেলিম নিহত হলে লেখক নিজে সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে কালাপানির ঢালে পৌঁছে হাজার-হাজার মৃতদেহ ও নরকঙ্কাল দেখতে পান। তাদের অধিকাংশকে মুসলিম বাজার মিরপুর ১২নং সেকশন সংলগ্ন এলাকায় হত্যা করে ওখানে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। কালাপানির ঢাল সংলগ্ন কয়েক মাইল জলায় ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট পরপর পচা ফোলা লাশে পূর্ণ ছিল। এসব লাশের মধ্যে নারী ও শিশুদের লাশও ছিল। অধিকাংশ লাশ কুকুর ও শকুনে খেয়েছে।
২৭শে মার্চ বিহারিরা মিরপুরে হত্যা করে ইত্তেফাক-এর সাংবাদিক আবু তালেবকে নিজ ঘরের মধ্যে জবাই করে। বি ব্লকের ২নং রোডে অবস্থিত তাঁর বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এ ব্লকের এভিনিউ ১-এর বাড়িটি ছিল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমানের। বিহারিরা তাঁর বাড়িটিও লুট করে। তিনি তাদের হাতে মারাত্মকভাবে জখম হন।
মিরপুর ১৪নং সেকশনে একটি বিল্ডিং-এর মধ্যে একজন বাঙালিকে নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। লোকটির চার হাত-পা চারদিকে টেনে ধরে চারটি বড় গজাল দ্বারা গেঁথে রাখা ছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েরা জীববিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষাতে ব্যাঙ কাটার সময় যেভাবে হাত-পা ছড়িয়ে আলপিন দিয়ে আটকে রাখে, ঠিক সেভাবে লোকটাকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। এরকম বীভৎস হত্যাকাণ্ড তখন আরো অনেক স্থানে ঘটেছে।
রাইনখোলা বধ্যভূমি: রাইনখোলা বধ্যভূমিটি চিড়িয়াখানার কাছে অবস্থিত। স্বাধীনতার পরপরই এটিকে চিহ্নিত করা হয়। একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে রাইনখোলা এলাকার ‘ডুইপ’ প্রকল্পে বধ্যভূমিটির সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে একটি পরিত্যক্ত স্যুয়ারেজ রিজার্ভার এবং তার ওপর একটি ছোট পাম্প হাউজ ছিল। নিচু জমিটি ভরাট করার শেষ পর্যায়ে পাম্প হাউজটি ভেঙ্গে ফেলা হলে তার নিচে প্রায় পঞ্চাশ ফুট ব্যাস ও পঁচিশ ফুট গভীর একটি স্যুয়ারেজ রিজার্ভারের ভেতর মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, তাদের সহযোগী বিহারি, রাজাকার ও আলবদর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে রিজার্ভারের ভেতর ফেলে দিত।
ঢাকা শহরে সংঘটিত গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসে কখনো থেমে থাকেনি। এমনকি চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পরেও ৩০শে জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত চলতে থাকে হানাদারদের বীভৎস হত্যাকাণ্ড। এটি ঘটে মিরপুরে, যা মুক্ত হয় ৩১শে জানুয়ারি। রাজধানী ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- দেশের সেরা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী বাঙালিকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে শহরের বিভিন্ন উপকণ্ঠে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ঢাকা শহরই একটি সুবৃহৎ গণকবরে পরিণত হয়।
ঢাকা শহরের মতো সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদাররা ঢাকা শহরের অনেকগুলো সরকারি ভবন, পরিত্যক্ত কল- কারখানা, বাড়িঘর ও গ্যারেজ তাদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে। অনেক অবাঙালি তাদের কল-কারখানা, অফিস আদালত, খামাড় বাড়ি ও বাগান বাড়ি তাদের ব্যবহার করতে দেয়। তারা এসব স্থানকে বাঙালি নিধনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। বগুড়ার ভার্জিনিয়া টোব্যাকো ফ্যাক্টরি, মিরপুরের সিরামিক ফ্যাক্টরি, লাকসামের সিগারেট ফ্যাক্টরি, গাইবান্ধার কফিল শাহ্ গুদাম, খুলনার বিভিন্ন কল-কারখানা ও দেশের প্রায় সকল রেল স্টেশনগুলোকে তারা এভাবে ব্যবহার করেছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি ঘাতকরা রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহায়তায় স্কুল-কলেজ ও মসজিদ- মাদ্রাসাকে হত্যা ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া ক্যান্টনমেন্টগুলোর আশপাশেও তাদের গোপন আস্তানা ও যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল। এ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে কিলিং স্কোয়াডের নেতা ও ইনফরমাররা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং রাও ফরমান আলী গংদের নিকট থেকে টেলিফোন, গাড়ি, অস্ত্র, বিস্ফোরক ইত্যাদি ছাড়া নগদ অর্থ ও পুরষ্কার লাভ করত। সেই সঙ্গে এসব কেন্দ্রে তারা পাকিবাহিনীর নিকট থেকে বিভিন্ন মৌখিক ও লিখিত নিদের্শ গ্রহণ করত এবং তাদের কাছে হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি ও তথাকথিত গোয়েন্দা রিপোর্ট পেশ করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র দেশে এ ধরনের স্থাপনা ও চেইন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে বাঙালি নিধনযজ্ঞে এবং তথাকথিত বিদ্রোহী দমনে। [এম এ হাসান ও হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্রঃ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও জেনোসাইড আর্কাইভ এন্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টারে সংরক্ষিত তথ্য; ডা. এম এ হাসান, যুদ্ধ ও নারী, ঢাকা ২০০২; ডা. এম এ হাসান, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ঢাকা ২০০১; রতন লাল চক্রবর্তী (সংকলিত ও সম্পাদিত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা : ১৯৭১ জগন্নাথ হল, ঢাকা; শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, একাত্তরের শহীদ ডা: আলীম চৌধুরী, আগামী প্রকাশনী ১৯৯৭; মো. শাহ্ আলমগীর (সম্পাদিত), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ২০১৫। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল হলে লেখক ডা. এম এ হাসান (মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার) ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সেলিম মো. কামরুল হাসান (পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শহীদ) ঢাকা শহরের গণহত্যা স্পট বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিদর্শন করে স্বচক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসের বীভৎসতা দেখতে পান।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড