মুক্তিযুদ্ধে তজুমদ্দিন উপজেলা (ভোলা)
তজুমদ্দিন উপজেলা (ভোলা) ভোলার একটি প্রাচীন থানা। এটি ১৯৮৩ সালে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। উপজেলার অর্ধেকটা জুড়ে নদী (শাহবাজপুর চ্যানেল)। এ উপজেলায় মোট ৫টি ইউনিয়ন এবং ৬২টি গ্রাম রয়েছে। মলংচড়া, সোনাপুর, চাঁদপুর, চাঁচড়া ও শম্ভুপুর এই পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত তজুমদ্দিন রাজনৈতিক ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি উপজেলা। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানি শাসন- শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতির আহ্বান এ উপজেলার মানুষজনকেও ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। সঙ্গে-সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের আগেই ভোলার সব উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৭ই মার্চ তজুমদ্দিন উপজেলায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মোফাজ্জল হোসেন মাস্টার (শশীগঞ্জ) ও মো. মোস্তফা কামাল কাজী (শশীগঞ্জ)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মাওলানা মুকবুল আহম্মদ (সহ-সভাপতি, আড়ালিয়া), মো. ইউনুছ মাস্টার (সাংগঠনিক সম্পাদক, শশীগঞ্জ), হাফিজ উদ্দিন ওরফে টুনু মিয়া (প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক, সোনাপুর), আলহাজ্ব সানু মিয়া মাস্টার (সহ-সভাপতি, শশীগঞ্জ), সাইফুল ইসলাম মিন্টু মিয়া (সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বড় মলংচড়া), আলহাজ্ব আবুল হাসেম তহসিলদার (কোষাধ্যক্ষ, শশীগঞ্জ), শাহজান সাজী (সদস্য সচিব, সোনাপুর), মোজ্জামেল হক মাস্টার (সদস্য, সোনাপুর), আলতাবুর রহমান মাস্টার (সদস্য, চাঁচড়া), মিন্টু লাল বিশ্বাস (সদস্য, চাঁদপুর), সাগর চন্দ্র আবুল হাসেম (সদস্য, পিতা ইব্রাহীম খলিল, শশীগঞ্জ), আব্দুর রশিদ হাওলাদার (সদস্য, পিতা আব্দুল হাদী হাওলাদার, সোনাপুর) প্ৰমুখ। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আবু তাহের (প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক, চাঁচড়া), আব্দুর রব মানিক মিয়া (সভাপতি, আড়ালিয়া), আবুল হাসেম ওরফে সেলিম তালুকদার (সহ-সভাপতি, শশীগঞ্জ), তৈয়বুর রহমান (সহ-সভাপতি, চাঁদপুর), অলিউল্যাহ মিয়া (সাধারণ সম্পাদক, শশীগঞ্জ), অজিউল্ল্যাহ মিয়া (সহ-সাধারণ সম্পাদক, শশীগঞ্জ), এ কে এম সামসুদ্দিন সেলিম (সাংগঠনিক সম্পাদক, আড়ালিয়া), মো. মহসীন (কোষাধ্যক্ষ, শশীগঞ্জ), মো. হাবীবউল্যাহ (সদস্য- সচিব, চাঁদপুর), মীর মো. সামসুদ্দীন (প্রচার সম্পাদক, শশীগঞ্জ), মো. সেলিম সাজী (সদস্য, সোনাপুর), খোরশেদ আলম (সদস্য, পিতা আবদুল হাদি হাওলাদার, সোনাপুর), অরুণ দেবনাথ (সদস্য, বড় মলংচড়া), সুলতান আহম্মদ ওরফে কাঞ্চন মিয়া (সদস্য, চাঁচড়া), নাজিম উদ্দিন ওরফে আলম পাটোয়ারী (সদস্য, শশীগঞ্জ) প্রমুখ। ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভুমিকা রাখেন আলহাজ্ব মোশারেফ হোসেন দুলাল (শশীগঞ্জ), অহিদ উল্ল্যাহ হাওলাদার (সোনাপুর), ফকরুল আলম (চাঁদপুর), ফজলুল হক দেওয়ান (শম্ভুপুর), নাজিম উদ্দিন বাবুল (মলংচড়া), মোস্তাফিজুর রহমান (শশীগঞ্জ) এবং গোলাম মোস্তফা ওরফে মিন্টু মিয়া (শশীগঞ্জ)। ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। চাঁদপুর হাইস্কুল মাঠে আনসার কমান্ডার অহিদুর রহমান, সেনাসদস্য মীর আবুল কাসেম, সুবেদার এম এ রশিদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। উপজেলার বহু মানুষ এখানে প্রশিক্ষণ নেন। মলয় কৃষ্ণ হাওলাদার ও যোগেশ চন্দ্র ঠাকুরের বাড়িতে আরো দুটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন মীর আবুল কাসেম, মোহাম্মদ হোসেন (সেনাসদস্য), মো. ইউনুছ মিয়া, হযরত আলী (সেনাসদস্য) ও কয়েকজন আনসার কমান্ডার। তজুমদ্দিনে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রস্তুতি পরিচালিত হয়। সংগ্রাম কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে। এক্ষেত্রে মূল দায়িত্বে ছিলেন কমিটির কোষাধ্যক্ষ আবুল হাসেম তহসিলদার। তজুমদ্দিন উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন আনসার কমান্ডার অহিদ মিয়া।
৮ই জুন পাকবাহিনী তজুমদ্দিন উপজেলায় প্রবেশ করে মোজাম্মেল হক চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসে। তবে তারা এখানে কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। রাজাকাররা ভোলার যুগীরঘোল সংলগ্ন ওয়াপদা কলোনি থেকে পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে এসে তজুমদ্দিন থানা সংলগ্ন ওয়াপদা অফিসে অবস্থান করত এবং সেখান থেকে অপারেশন চালাত। অনেককে এখানে ধরে এনে তাদের ওপর নির্যাতন করত।
এ উপজেলায় রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল বদিউল আলম ওরফে আবু মাওলানা (পিতা আবুল হাসেম, মাওলানা কান্দি)। রাজাকার বাহিনীর অন্য সদস্যরা হলো- মো. ছালামত উল্ল্যাহ, জয়নাল আবেদিন, মনতাজ দরবেশ, আব্দুল আজিজ, আব্দুল বারেক চৌকিদার, মো. আবুল কাসেম মুন্সি ও মো. আলতাফ চৌকিদার। শান্তি কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিল যথাক্রমে মোজাম্মেল হক মিয়া ও বদিউল আলম (আবু মাওলানা)। এর সদস্য ছিল কোব্বাত পাটোয়ারী, আছমাত মাস্টার, আব্দুস ছামাদ হাওলাদার, মনির মুন্সি, হাজী দেলোয়ার হোসেন, ফেরু মিয়া, নুরুল ইসলাম, আক্তারুজ্জামান পাটোয়ারী, মো. ছালেম মিয়া, শহিদুল ইসলাম, ফরিদ উদ্দিন, কাঞ্চন পাটোয়ারী প্রমুখ। আগস্ট মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী রাজাকার ফেরু মিয়ার সহযোগিতায় শম্ভুপুর ইউনিয়নে জনৈক অনিল সাধুর বাড়িতে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত ভবতোষ কর্মকার, বীরেন কর্মকার ও রঘু পোদ্দার নামে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে এবং তাদের লাশ ইটের সঙ্গে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। রাজাকার আবদুল বারেক চৌকিদারের সহযোগিতায় অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা গুরিন্দাতে ননী মজুমদার, বাসুদেব ও অরুণ দেবনাথ নামে আরো তিনজনকে খেয়াঘাটে নিয়ে গুলি করে পানিতে ফেলে দিলে দুজন ঘটনাস্থলে নিহত হন, তবে তৃতীয় জন (অরুণ দেবনাথ) প্রাণে বেঁচে যান। এরপর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইন্দ্রনারায়ণপুরে রাজাকার আলতাফ চৌকিদার পুলিশের সহযোগিতায় আব্দুর রহিম, আফতাব ও হাফেজ মিয়া নামে তিনজনকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয়। পরে পাকসেনারা তাদের হত্যা করে। ৭ই জুলাই পাকসেনারা শশীগঞ্জের হাওলাদার বাড়ি ও মুন্সিবাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রথমে নুরু হাওলাদার এবং মাজেদ হাওলাদারকে মারধর করে। এরপর তারা ঐ বাড়ির দুজন নারী মাছুমা খাতুন ও বিবি হনুফাকে নির্যাতন করে। রাজাকার কমান্ডার বদিউল আলম (আবু মাওলানা) তার সহযোগীদের দিয়ে শশীগঞ্জের অলিউল্যাহ, অজিউল্যাহ ও মীর সামসুদ্দীনকে ধরে থানা সংলগ্ন ওয়াপদা বিল্ডিং-এ এনে একটি স্ট্যাম্পে জোর করে মুক্তিযুদ্ধ না করার অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভবিষ্যতে সহযোগিতা করা হলে পাকসেনাদের দিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করা হবে বলেও শাসানো হয়। একই তারিখে পাকবাহিনী আলহাজ্ব রহম আলী হাওলাদার, মাস্টার মোফাজ্জল হোসেন, হাসেম তহসিলদার, আবদুল হক হাওলাদার, নুরু হাওলাদার, হাকিমদ্দিন হাওলাদার এবং হরমোহন পণ্ডিতের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এতে কয়েক লক্ষ টাকার আসবাবপত্র ও মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সংগ্রাম কমিটির কোষাধ্যক্ষ আবুল হাসেম তহসিলদারের বাড়ি থেকে মুক্তিবাহিনীর জন্য রক্ষিত নগদ লক্ষাধিক টাকা রাজাকাররা লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
২৮শে অক্টোবর তজুমদ্দিন থানা অপারেশন – পরিচালিত হয়। এর ফলে থানার পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে এবং থানা হানাদারমুক্ত হয়। নভেম্বর মাসের শেষদিকে গরুচৌকা খাল নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান, আলী আকবর হোসেন, চৌধুরী মিন্টু মিয়া এবং সুবেদার এম এ রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ১৮ জন পাকসেনা ও ১৩ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এটি গরুচৌকা খাল যুদ্ধ নামে পরিচিত। এদিনই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
তজুমদ্দিন উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- হাবিলদার আব্দুল মান্নান (পিতা মজিবুল হক ভূঁইয়া, কাজিকান্দি; ২৯শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে শহীদ), নায়েক জহুরুল হক (পিতা আমিন উদ্দিন, কাজিকান্দি; ২৯শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে শহীদ), শাহে আলম (পিতা লাল মিয়া, মোহাম্মদ ভেলা; টনির হাটের যুদ্ধ-এ শহীদ) এবং মো. আব্দুল মোতালেব (পিতা আব্দুল গণি, গোলকপুর)।
সার্জেন্ট মো. ইদ্রিস মহাজন (পিতা সোনা মিয়া, মহাজন কান্দি) এখানকার একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং মালেকা খাতুন (শশীগঞ্জ) একজন বীরাঙ্গনা। তিনি কুমিল্লা সেনানিবাস সংলগ্ন ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলের দ্বিতীয় তলায় বন্দি অবস্থায় নির্যাতিত হন। [মো. খোরশেদ আলম হাওলাদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড