You dont have javascript enabled! Please enable it!

ডেমরা গণহত্যা (ফরিদপুর, পাবনা)

ডেমরা গণহত্যা (ফরিদপুর, পাবনা) সংঘটিত হয় ১৪ই মে। এতে সহস্রাধিক লোক নিহত হয়।
ঘটনার দিন ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনী পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ও সাঁথিয়া উপজেলার রূপসী গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত করে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধ কালে পাবনা জেলার বর্বরতম এবং ভয়াবহতম গণহত্যা। হানাদার বাহিনী গণহত্যার পাশাপাশি এখানে ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ ও করে। ডেমরা গ্রামটি ছিল মূলত হিন্দুপ্রধান, তবে কিছু মুসলমানও এখানে বসবাস করত। যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকলেও গ্রামটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। ধনী কৃষক এবং ব্যবসায়ী শ্রেণির বসবাস ছিল গ্রামটিতে। ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে শহর থেকে অনেক মানুষ এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। রাজাকারদের দেখানো পথে পাবনা বাঘাবাড়ী থেকে আতাইকুলা হয়ে আসা পাকসেনারা এ গ্রামে আক্রমণ করে। ঘটনার দিন কয়েকশত পাকসেনা ও রাজাকার সমগ্র গ্রাম ঘিরে ফেলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের ভারী অস্ত্রের গর্জনে ঘুমন্ত মানুষ জেগে ওঠে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় এদিক-ওদিক পালাতে থাকে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী, স্কুল ছাত্র কেউই রেহায় পায়নি হায়েনাদের হাত থেকে। কোলে সন্তানসহ গুলিবিদ্ধ মায়ের লাশ, গাছের ডালে মানুষের লাশ, চতুর্দিকে শুধু লাশ আর লাশ। তারা ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে, ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, ডোবায় কচুরিপানার মধ্যে প্রাণ ভয়ে লুকিয়ে থাকা মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে কয়েকশত মানুষকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। রেফাত খাঁর বাড়ির সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষকে। একই সময়ে তারা পার্শ্ববর্তী রূপসী গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে বহু নারী- পুরুষকে হত্যা এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। নরপশুরা এ-সময় পিতার সামনে কন্যাকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, শাশুড়ী-পুত্রবধূকে এবং মা-মেয়েকে এক সঙ্গে ধর্ষণ করে। তারা শুধু হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ করেই ক্ষান্ত হয়নি, পুড়িয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির ও দোকান-পাট। তারা ডেমরা বাজার সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামের অনেক নারীকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়, লুট করে নিয়ে যায় সোনা-দানাসহ সংসারের অন্যান্য দ্রব্যাদি। তারা ডেমরার জামিদার বংশের সন্তান বলরাম রায়, রামবাবু ও তাঁর পুত্র এডরুক লি. পাবনা- এর লেবার ইনচার্জ দিলীপ বাবুকে গুলি করে। পরে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে তাদের পুড়িয়ে মারে। বড়াল নদী দিয়ে প্রাণ ভয়ে নৌকায় পালানোর সময় হানাদাররা অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। তারা অন্তঃসত্ত্বা মঙ্গলা কুণ্ডুর আকুতি পর্যন্ত উপেক্ষা করে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। নীলা আর শীলা নামে দুই বোনকে রাজাকার দালালদের সহায়তায় নরপিশাচরা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ডেমরা এবং রূপসী গ্রাম গণহত্যায় প্রায় সহস্রাধিক মানুষ শহীদ হন। বড়াল নদীতে ভেসে যাওয়া অসংখ্য লাশের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর এলাকার মানুষ কিছু লাশ মাটিচাপা দেয়, কিছু লাশ বড়াল নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ডেমরা গণহত্যায় শহীদ সকলের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- বলরাম রায় (ডেমরার জমিদার বংশের সন্তান), দিলীপ বাবু (পাবনা এডরুক লি.-এর লেবার ইনচার্জ) (পিতা বলরাম রায়; গুলি করার পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়), দুই বোন নীলা ও শীলা (ডেমরা, হানাদাররা তাদের ক্যাম্পে নেয়ার পর আর কোনো সন্ধান মেলেনি), মঙ্গলা কুণ্ডু (ডেমরা), মণীন্দ্রনাথ (ডেমরা), জগন্নাথ রায় (এডরুক লি.), দেবেন্দ্রনাথ পাল (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ), ছবি রাণি পাল (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ), মণীন্দ্রনাথ কর্মকার (বেড়া, পাবনা), অনাথবন্ধু পাল (পিতা জগবন্ধু পাল, কুঁচিয়ামোড়া, পাবনা সদর), হারান কুণ্ডু (পোতাজিয়া, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ), দিলীপ কুণ্ডু (পোতাজিয়া, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ), খগেন্দ্রনাথ (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ), নীলমণি পাল (বেড়া, পাবনা), মণীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (পাবনা সদর), ওহাব প্রামাণিক (পিতা রেফাতুল্লাহ প্রামাণিক, রূপসী, সাঁথিয়া, পাবনা), অশোক পাল (কুঁচিয়ামোড়া, পাবনা সদর), নিমাইচন্দ্র পাল (কুঁচিয়ামোড়া, পাবনা সদর), শান্তি রায় পাল (কুঁচিয়ামোড়া, পাবনা সদর), রাজশ্রী রানী (কুঁচিয়ামোড়া, পাবনা সদর), পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার রূপসী গ্রামের আহম্মদ ফকির, ওসমান প্রামাণিক, এবাদ প্রামাণিক, জামান প্রামাণিক, বাছদ প্রামাণিক, তফিজ উদ্দিন, রাম রায়, মণীন্দ্রনাথ নন্দী, কছিম খাঁ (পিতা কানু খাঁ, ডেমরা), কানু খাঁ (ডেমরা), হারান প্রামণিক, মোসলেম ফকির, কোরবান প্রামাণিক, মন্টু শেখ, বিহারী লাল, জিতেন্দ্রনাথ রায়, গোরা রায়, মহিম সেন, অখিল পাল, মলম সেন, কোরবান আলী, জাফর প্রামাণিক, দাসু রায়, শুধি লাল ঘোষ, খোরশেদ প্রামাণিক, খবির প্রামাণিক, ইউসুফ প্রামাণিক, মজু প্রামাণিক, ধীরেন সূত্রধর, অনন্ত কুমার চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ মালী, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, হীরালাল দাস, বরুণ দাস, নীলমণি তলাপাত্র, লক্ষ্মণ হালদার, ফজর আলী, প্রবোধ কুমার মজুমদার, বিমল রায়, নির্মল রায়, অমরেন্দ্রনাথ রায়, প্রদীপ হালদার, নারায়ণ রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ হালদার, ফকির চাঁদ ঘোষ, ঋশিকেষ কুণ্ডু, মণীন্দ্রনাথ, অনিল শীল, রবীন্দ্রনাথ শীল, গণেশ শীল, তিনকড়ি পাল, তিনকড়ি পালের স্ত্রী, বুলু প্রামাণিক, লাল বিহারী, ধীরেন পাল, আব্দুল জব্বার, অজু পাগল, অধির পাগল, আবুল হোসেন, নীরু পাটনী, হোসেন আলী, আজাহার আলী, আজগার আলী, খোরশেদ প্রামাণিক, আজরা পাটনি, আহেজ ফকির, আদির ফকির, ইবাদ ফকির, স্বপন তাম্বলী, বাসনা ঘোষ, সতীশ শীল, শুধালাল ঘোষ, বৈদ্যনাথ দাস, লক্ষ্মী হালদার, শশী ভূষণ, জিতেন রায়, কালী রানী, দুলাল চন্দ্র, তাফাল কুণ্ডু, সুধাময়ী, গীতা দাস, নারায়ণ রায়, বিমল পাল, কালীপদ হালদার প্রমুখ। এ সব শহীদের স্মরণে ডেমরায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [মো. আশরাফ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!