You dont have javascript enabled! Please enable it!

ডোমনাকান্দি যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী)

ডোমনাকান্দি যুদ্ধ (সেনবাগ, নোয়াখালী) সংঘটিত হয় ১৯শে নভেম্বর কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞার নেতৃত্বে। এটি ছিল নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার শেষ যুদ্ধ। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা ডোমনাকান্দি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে ৮ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয় এবং দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দুজন আহত হন। ফেনী-চৌমুহনী প্রধান সড়ক (বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা গাজী লোকমান সড়ক)-এর দক্ষিণ পাশে সেনবাগ উপজেলার কাবিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের অফিস ছিল। এর সংলগ্ন ছিল ইউনিয়ন কৃষি সহকারীর কার্যালয়। এই দুই পাকা ভবনের ভেতরে রাজাকাররা ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী অক্টোবর মাসে থানা সদর থেকে চলে যাওয়ার সময় ডোমনাকান্দি গ্রামে অবস্থিত এই রাজাকার ক্যাম্পে সকল রাজাকারকে রেখে যায়। রাজাকাররা তাদের ঘাঁটিকে নিরাপদ রাখার জন্য ক্যাম্পের চারদিকে মাটি দিয়ে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে। তারা স্থানীয় লোকজন এবং বাস থামিয়ে যাত্রীদের এ কাজ করতে বাধ্য করে। এছাড়া নিয়মিত তারা এলাকার মানুষের হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল জোর করে ধরে এনে জবাই করে খেত। তাদের এই অত্যাচারের খবর পেয়ে আঞ্চলিক কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞা রাজাকারদের ক্যাম্পটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে জাফর আহম্মদ নামে ক্যাম্পের একজন রাজাকার একটি রাইফেল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আজিম চৌধুরীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। তার বাড়ি ছিল আজিম চৌধুরীর গ্রামেই। তাকে নিয়ে আজিম চৌধুরী কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞার ক্যাম্প কেশারপাড়ে যান এবং রুহুল আমিন ভূঞা তার কাছ থেকে রাজাকার ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেন।
ডোমনাকান্দি গ্রামের ইলিয়াছ মিয়া এবং পাঠান বাড়ির রফিকুল ইসলাম খান নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাদের খবর দেয়া হয় রুহুল আমিন ভূঞার সঙ্গে দেখা করার জন্য। রুহুল আমিন ভূঞা তাদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেন। তারপর ডোমনাকান্দির উত্তর-পশ্চিম দিকে আজিজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসে বিএলএফ – জেলা কমান্ডার মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (স্বাধীনতার পর সংসদ সদস্য) এবং রুহুল আমিন ভূঞা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পরের দিন ছিল ঈদ। রাজাকাররা আনন্দেই থাকবে ধরে নেয়া হয়। এজন্য ঈদের আগের রাতেই আক্রমণ করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে কারা কোনদিক থেকে আক্রমণ করবে তা ঠিক করে দেন। তিনি রাত ১টার মধ্যে সকলকে যার-যার জায়গায় অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে বিকেল বেলা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ও মমিনুল হক ক্যাম্প এলাকা রেকি করে আসেন।
রাত ১টার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে রাজাকারদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন। রাজাকাররা তাদের ক্যাম্পের ছাদের ওপর মাটি ও বালির বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরি করেছিল। মোহাম্মদ আলী ও তাঁর গ্রুপ জাফর আহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যায়। অন্যদিকে জয়নালের গ্রুপের নুরুল ইসলাম, মফিজুর রহমান, আবু বকর ছিদ্দিক, নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ উল্যা, আবুল কালাম, আবদুল গফুর, নুরুল হুদা, ফয়েজ আহম্মদ, সৈয়দ আবুল কাশেম, জালাল আহম্মদ ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেন। এভাবে ক্যাম্পের চারদিকে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন।
রাত ২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররাও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের আবুল কাশেম ও নানু এগিয়ে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করেন। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। রাজাকাররা ক্যাম্পের ছাদের ওপর থেকে অনবরত ফায়ারিং করছিল। এই ফাঁকে বেশ কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর রাজাকারদের পক্ষ থেকে গুলির আওয়াজ না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ও আবু তাহের পজিশন থেকে উঠে দাঁড়ান। সঙ্গে-সঙ্গে রাজাকাররা ছাদ থেকে গুলি করলে দুজনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এ-সময় জাফর আহম্মদ ও আবদুর রহিম আহত হন। এঁদের সকলকে দ্রুত হাটিরপাড় গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ফিল্ড হাসপাতাল ক্যাম্পে ডা. নুরুজ্জামান চৌধুরীর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও আবু তাহেরকে মৃত ঘোষণা করেন। জাফর আহম্মদকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মাইজদী পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং আবদুর রহিমকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু আবদুর রহিম ৬ই ডিসেম্বর সোনাইমুড়ি যুদ্ধে শহীদ হন। রাত পোহালে পলায়নরত ৬ রাজাকারকে জনসাধারণ বাঁশ ও গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ জন রাজাকারকে জীবিত অবস্থায় ধরে ফেলেন এবং ক্যাম্পে প্রাপ্ত সকল অস্ত্রসহ কমান্ডার রুহুল আমিন ভূঞার নিকট হস্তান্তর করেন। এ- যুদ্ধে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ ও মাইজদী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন।
যুদ্ধশেষে কানকিরহাট হাইস্কুল মাঠে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ও আবু তাহেরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর স্কুল মাঠের দক্ষিণ পাশে তাঁদের দাফন করা হয়। মোহাম্মদ আলী সেনাসদস্য ছিলেন বলে স্বাধীনতার পর তাঁর কবর সেনা সদর দপ্তর থেকে পাকা করে দেয়া হয়। [মো. আবু তাহের]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!