মুক্তিযুদ্ধে ডামুড্যা উপজেলা (শরীয়তপুর)
ডামুড্যা উপজেলা (শরীয়তপুর) ১৯৭১ সালে বর্তমান ডামুড্যা উপজেলাভুক্ত এলাকাসমূহ ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন কনেশ্বর ও দারুল আমান ইউনিয়ন ভেদরগঞ্জ এবং সিতুলকুড়া, ডামুড্যা ও ধানকাঠি ইউনিয়ন গোসাইরহাট থানার অংশ ছিল। ডামুড্যা আলাদা থানা হয় ১৯৭৫ সালে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ- প্রার্থী আবিদুর রেজা খান ও আবদুর রাজ্জাক- যথাক্রমে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচিত হন। সমগ্র দেশের মানুষের মতো ডামুড্যার জনগণেরও প্রত্যাশা ছিল নির্বাচনের রায় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে এবং বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসন- শোষণের অবসান ঘটবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কারণে মানুষের সে আশা ভূলুণ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ডামুড্যার সাধারণ মানুষও এতে অংশগ্রহণ করে। তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শত্রুর মোকাবেলা ও দেশকে মুক্ত করতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর থেকে ডামুড্যার ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ডামুড্যার কৃতী সন্তান আবদুর রাজ্জাক এমপিএ তখন আওয়ামী সেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর নির্দেশে ডামুড্যার ছাত্র-যুবকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রাক্তন সেনাসদস্য, আনসার, পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত প্যারেড পিটিতে অংশগ্রহণ করে। তাঁদের অনেকেই পরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। এঁরা প্রশিক্ষণ শেষে জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে ফিরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ডামুড্যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক, ফজলুর রহমান বেপারী, নাদের ছৈয়াল, মধু ঢালী, আলী আজম ছৈয়াল, ডা. গোপাল চন্দ্র ঘোষ, কামাল মাস্টার, ডা. আনোয়ার হোসেন, আ. রহমান সরদার প্রমুখ। যুদ্ধে যাঁরা কমান্ডারের ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন আবদুল ওয়াহাব খান শহীদ, শাহাদাৎ হোসেন খান, মোশাররফ হোসেন, সিরাজ মাদবর, মতিউর রহমান দেওয়ান, আ. হক মোল্লা, আলী আশরাফ সরদার, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। এঁদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি দলে ডামুড্যার মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধে অংশ নেন। এখানে স্থানীয় বিশেষ কোনো বাহিনী ছিল না। পাকবাহিনী কোনো প্রতিরোধ মোকাবেলা না করেই ডামুড্যায় প্রবেশ করে। গোসাইরহাটের মুসলিম লীগ নেতা ও সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সিরাজউদ্দিন আহম্মদ তাদের সহযোগিতা করে।
পাকবাহিনীর কতিপয় সদস্য স্থানীয় দালাল-রাজাকারদের যোগসাজসে জুন মাসের দিকে ডামুড্যার বিভিন্ন গ্রামে অনুপ্রবেশ করে। ডামুড্যাতে পাকবাহিনী কোনো ক্যাম্প স্থাপন করেনি। বাজারে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ফলে এক পর্যায়ে তারা এ ফাঁড়ি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
এ অঞ্চলে গোসাইরহাটের মুসলিম লীগ নেতা সিরাজউদ্দিন আহম্মদ পাকবাহিনীর প্রধান দোসর ছিল। তার পেছনে জামায়াত নেতা দীন মোহাম্মদের সহযোগিতা ছিল। মুসলিম লীগ ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এ এলাকায় পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য ও রাজাকাররা নানাভাবে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। গোসাইরহাট থানার রাজাকাররাও ডামুড্যা এসে ত্রাসের সৃষ্টি করে।
পাকবাহিনী জুন মাসে ডামুড্যা অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে হানা দেয়। তারা আওয়ামী লীগের নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আজম ছৈয়ালের ডামুড্যা বাজার সংলগ্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। দারুল আমান ইউনিয়নের চর রামরায়ের কান্দির আফসার বেপারীর বাড়ি ও উত্তর ডামুড্যার হাওলাদার বাড়ি তারা জ্বালিয়ে দেয়।
১৮ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা ডামুড্যা পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করেন। অতর্কিত এ আক্রমণে ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁড়ি থেকে ৫টি রাইফেল, ১টি ওয়ারলেস সেট ও প্রচুর গুলি দখল করেন।
ডামুড্যায় সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয় ১৫ই অক্টোবর। এদিন দুশতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার ডামুড্যা বাজারে আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে এখানে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। -ডামুড্যা বাজার যুদ্ধ-এ বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন।
১০ই নভেম্বর পাকবাহিনী গোসাইরহাট থেকে গোপনে মাদারীপুর পালিয়ে যায়। ফলে এদিনই ডামুড্যা সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়।
ডামুড্যায় যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁরা হলেন- আহসানুল হক (ছাত্র, ডামুড্যা), আ. খালেক রাঢ়ি (বিড়ি শ্রমিক, ডামুড্যা), আ. মালেক মৃধা (ছাত্র, ঠেঙ্গারবাড়ি, ডামুড্যা), আব্দুল হান্নান (ছাত্র, কাশিয়ানী), আব্দুল মান্নান (ছাত্র, কাশিয়ানী), আইয়ূব আলী (ইপিআর সদস্য, গোপালগঞ্জ), হাবিলদার খোরশেদ আলম (ইপিআর, শিবচর), আবদুশ শুকুর (পুলিশ সদস্য, ভাঙ্গা, ফরিদপুর), আব্দুল বাকী (পুলিশ সদস্য, ভাঙ্গা, ফরিদপুর), জাহিদ হোসেন (ইপিআর সদস্য, সূত্রাপুর, নারায়ণগঞ্জ), তৈয়বুর রহমান (ইপিআর সদস্য, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর), লিয়াকত আলী খান (ছাত্র, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর), সরদার শহীদুল্লাহ (ছাত্র, ভেদরগঞ্জ), সুলতান বেপারী (শ্রমিক), হায়দার আলী ছৈয়াল (শ্রমিক, দক্ষিণ ডামুড্যা), আবদুল জব্বার, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রহিম, ডা. মো. শহীদুল্লাহ (বিশাকুড়ি), সামসুল হক মিয়া (ডিনাই), আবুল হাসেম বেপারী (গুয়াখোলা), আবদুল কাদের মাদবর (ডামুড্যা) ও ফইজউদ্দিন মিয়া (চর মালিগাঁও)। ডামুড্যা উপজেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। [আবদুর রব শিকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড