You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.15 | ডামুড্যা বাজার যুদ্ধ (ডামুড্যা, শরীয়তপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

ডামুড্যা বাজার যুদ্ধ (ডামুড্যা, শরীয়তপুর)

ডামুড্যা বাজার যুদ্ধ (ডামুড্যা, শরীয়তপুর) সংঘটিত হয় ১৫ই অক্টোবর। এটি এ এলাকার একটি বড় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন।
মুক্তিযোদ্ধারা অক্টোবর মাসের দিকে পালং, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও জাজিরা থানায় পাকহানাদার বাহিনীর দোসরদের উৎখাত করে বর্তমান শরীয়তপুর জেলার অধিকাংশ অঞ্চল মুক্ত করেন। তবে তখনো ডামুড্যা বন্দরে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার জন্য পাকবাহিনীর দোসররা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা ডামুড্যা বন্দর নিজেদের অধীনে রাখতে এবং এখানে যাতে পাকবাহিনী বা তাদের দোসাররা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বাংকার খনন করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
বর্তমান ডামুড্যা থানার উত্তরপাশে ডা. শহিদুল্লাহ্ বাড়িতে এবং থানার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সত্য রঞ্জনের বাড়িতে বাংকার স্থাপন করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। বাংকারগুলোর পাশে নদীর তীরে একটি বড় চালতা গাছ ছিল। ঐ গাছে উঠে নদীর দক্ষিণে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। এ গাছে পালা করে সব সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা পাহারায় থাকতেন দূরে পট্টি থেকে পাকবাহিনীর কোনো জলযান ডামুড্যা বন্দর অভিমুখে আসছে কি-না তা দেখার জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে ১০-১২ দিন পাহারা দেন। ইতোমধ্যে তাঁদের রসদ কমে আসে। ১৫ই অক্টোবর তাঁদের রসদ সংগ্রহ সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনার জন্য মধ্য বাজারে আলী আকবর মালের ফার্মেসিতে কমান্ডার ইকবাল আহমেদ বাচ্চু, আওয়ামী লীগ-এর সাধারণ সম্পাদক ফজলুল করিম বেপারী, মধু ঢালী, আলী আজম ছৈয়াল, আলী আকবর মাল প্রমুখ সকাল ১১টায় যখন বৈঠক করছিলেন এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন চালতা গাছ থেকে দেখা যায় যে, ডামুড্যা নদীর মোহনায় হানাদার বাহিনীর গানবোট ঢুকছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করার জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নেন। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে খবর আসে যে, গানবোট ও লঞ্চসহ শত্রুবাহিনী তালতলা এসে রাজাকারদের তীরে নামিয়ে দ্রুতবেগে বাজারের দিকে এগিয়ে আসছে। শত্রুরা কাছাকাছি চলে এলে দশম শ্রেণির ছাত্র তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আহসান এসএলআর দিয়ে ফায়ার শুরু করেন। তখন এ স্থানে ২৫-৩০ জন রাজাকারের বিপরীতে মাত্র ৪-৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ফলে রাজাকারদের পাল্টা-আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধা আহসান গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। থানার দক্ষিণের বাংকার থেকে গোপালগঞ্জের আর্টিলারি বাহিনী দুই ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ করে। এতে হানাদার বাহিনীর কাঠের বডির লঞ্চের ছাদের অংশবিশেষ উড়ে যায়। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৪ ঘণ্টা তীব্র গোলাবর্ষণ ও গুলি বিনিময় চলে। রাজাকার বাহিনী স্থল পথে এসে পেছন দিক থেকে গুলি করে। গুলিতে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর মুক্তিযোদ্ধা মামা-ভাগ্নে মান্নান ও হান্নান শহীদ হন। যুদ্ধে শিবচরের হাবিলদার খোরশেদ আলম, গোপালগঞ্জের আইয়ুব, ডা. শহীদুল্লাহ্, আ. খালেক রাড়ি, আবদুল খালেক মৃধা প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ডা. শহীদুল্লাহ্ জীবিত ধরা পড়ার পর হানাদাররা তাঁকে হত্যা করে। শত্রুদের তীব্র গুলির মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ-কেউ নৌকায় এবং অনেকে সাঁতরে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করেন। পালং-এর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল কাসেম মৃধাসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা কয়েক ঘণ্টা নদী সাঁতরে নিরাপদ স্থানে যান। এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। কেউ-কেউ আহত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা পড়েন। লাকার্তা গ্রামের আহত মুক্তিযোদ্ধা পল্টু ভূঁইয়া শত্রুর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার পর রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী বাজারে অগ্নিসংযোগ করে কোটি-কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করে।
ডামুড্যা বাজার যুদ্ধ সমগ্র পূর্ব মাদারীপুর তথা বর্তমান শরীয়তপুর জেলার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। সাময়িক পরাজয় হলেও এ-যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের সাহসী তৎপরতা চলতে থাকে। কিছুদিন পর সমস্ত শক্তি দিয়ে শত্রুদের উৎখাত করে ১৬ই ডিসেম্বর ডামুড্যার মানুষ স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করতে সক্ষম হয়। [আবদুর রব শিকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড