You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ডিমলা উপজেলা (নীলফামারী)

ডিমলা উপজেলা (নীলফামারী) অনেক পুরাতন। ১৮৫৭ সালে এটি থানার মর্যাদা পায় এবং ১৯৮৩ সালের ১লা জুলাই উপজেলায় উন্নীত হয়। এখানকার জনগণ বরাবরই অধিকার-সচেতন ছিল। তেভাগা আন্দোলনের সময় (১৯৪৬-৪৭) স্থানীয় ভূস্বামী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার খগাখড়িবাড়িস্থ খামার
বাড়িতে এক সংঘর্ষে আন্দোলনের নেতা তত্নারায়ণ বর্মণ নিহত হন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-এ অংশগ্রহণের অভিযোগে জামশেদ আলী চাটিকে গ্রেফতার করে রাজশাহী জেলে পাঠানো হয়৷ এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সব জাতীয় আন্দোলন-সংগ্রাম, সত্তরের নির্বাচন ও নির্বাচনোত্তর অসহযোগ আন্দোলন-এ এ এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও এর হাতে ক্ষমতা না
দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলেও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এ উজ্জীবিত হয়ে অত্র এলাকার ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তারা ভারতে যায় এবং কুচবিহারের টাপুরহাট, জলপাইগুঁড়ি, ঘুঘুডাঙ্গা ইয়ুথ ক্যাম্প, হলদিবাড়ি ট্রাঞ্জিট ক্যাম্প ও দেওয়ানগঞ্জের রাজগঞ্জ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়।
ডিমলা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রউফ এমএনএ, বজলার রহমান চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, আবদুল মান্নান, মনির উদ্দিন, তফিল মাস্টার, ইসমাইল মুন্সী, সহিমুদ্দিন মিয়া, তোজাম্মেল হক, ধজরউদ্দিন চৌধুরী,আবদুর রহিম মাস্টার, শাহাদাত হোসেন খান লোহানি, এন কে আলম চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, নিতাইচরণ সৎপতি, হানিফ পাটোয়ারী, কুদরত আলী সরকার, সায়েদ আলী, পেনু মিয়া প্রমুখ। আর কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হারেজ উদ্দিন, অপিল উদ্দিন, রওশন আলী, জয়নাল আবেদীন, মনিরুজ্জামান ও বুলবুল।
পাকবাহিনী যাতে ডিমলায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ডিমলা হেডকোয়ার্টার্স থেকে বের হওয়ার রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা মাইন স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু সে প্রতিরোধ ভেঙ্গে পাকবাহিনী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেনট থেকে এসে এপ্রিল মাসে ডিমলায় প্রবেশ করে এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে থানা হেডকোয়ার্টার্সে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে মে-জুন মাসে খগাখড়িবাড়ি হাইস্কুল, ডাঙ্গারহাট প্রাইমারি স্কুল, জোরজিগা হাটের পশ্চিম- উত্তরের প্রাইমারি স্কুল এবং শুটিবাড়িহাটের গয়াবাড়ি স্কুলে সাবক্যাম্প স্থাপন করে।
ডিমলা উপজেলায় মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীরা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে। তাদের মধ্যে গনি মিয়া, ওয়াজেদ আলী প্রধান, মর্তুজা, সাইদুল বারী (দুলু), ডা. খয়ের উদ্দিন, সামসুদ্দিন হাজী, আব্দুল্যা হেল কাফি, ডা. আজিমুদ্দিন, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মো. মজিবর রহমান, চেয়ারম্যান হবিবর রহমান, মো. রফিকুল ইসলাম, ফজিবর চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন, চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন, আজিজার রহমান মাওলানা, হেফাজ উদ্দিন চৌধুরী, মোতালেব হোসেন প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এদের তত্ত্বাবধানে শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
পাকবাহিনী তাদের সহযোগীদের নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। ডাঙ্গারহাটের পশ্চিম পার্শ্বে তারা এটি গণহত্যা চালায় এবং হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে। খগাখড়িবাড়ির উত্তরবাড়ি এলাকায় প্রায় ৪০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পূর্ব ছাতনাইয়ের দাতব্য চিকিৎসালয় ও টেপাখড়িবাড়ির আজিজার রহমানসহ অন্যদের ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
ডিমলা থানা হেডকোয়ার্টার্সে পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো।
ডিমলা উপজেলার বালাপাড়ায় একটি গণকবর রয়েছে। বালাপাড়া মাইন বিস্ফোরণে শহীদ ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে কবর দেয়া হয়। এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আরো ছয়টি পৃথক কবর রয়েছে। সে-সবের মধ্যে একটি ডাঙ্গারহাটের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত।
উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের কলোনিহাট, পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের ঠাকুরগঞ্জ, বালাপাড়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারহাট, খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের টুনিরহাট, গয়াবাড়ি ইউনিয়নের শুটিবাড়িহাট, খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ডালিয়া ও ছোটখাতা এবং ডিমলা ইউনিয়নের বাবুরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত শুটিবাড়িহাটের যুদ্ধে মাহমুদ আলী (চিলাহাটি, ডোমার উপজেলা) নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও পাঁচজন সাধারণ মানুষ পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন এবং সুলতান (রংপুর) ও সামসুল আলম নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা পাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের নিয়ে যাওয়ার সময় সুলতান গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যান এবং সামসুল আলমকে গাছে বেঁধে নির্মম নির্যাতনের পর পাকবাহিনী হত্যা করে। পুরাতন থানার পূর্বপাশে তাঁর কবর রয়েছে।
টুনিরহাটের যুদ্ধে পাকবাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আসাদ আলী (কুড়িগ্রাম) শহীদ এবং সামছুল হক কিবরিয়া আহত হন। সামছুল হক চিকিৎসার জন্য ভারতে গেলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। আসাদ আলীকে বাদিয়াপাড়া হাটে কবর দেয়া হয়। এছাড়া ওয়াহেদুল ইসলাম নামে একজন সাধারণ গ্রামবাসী পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। তাঁর ছেলে চপলের মুখের ভেতরে গুলি ঢুকে বাঁ-গাল দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে বেঁচে যায় এবং এখনো জীবিত। বালাপাড়া বিওপি ক্যাম্পের নিকট একটি মাইন বিস্ফোরণে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে স্বপন (অন্য উপজেলার) নামে একজনের নাম জানা গেছে। ১১ই ডিসেম্বর ডিমলা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ডিমলা উপজেলায় ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন ডিমলা উপজেলার। তাঁরা হলেন- সামছুল হক কিবরিয়া (পিতা সামছুল হক, খগাখড়িবাড়ি) এবং মো. আব্দুস ছাত্তার (পিতা আব্দুল কাদের, মধ্য ছাতনাই; পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লায়)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে উপজেলার বাবুরহাট হেডকোয়ার্টার্স চৌরাস্তায় ‘স্মৃতি অম্লান’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। বালাপাড়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারহাটের পশ্চিম পার্শ্বে একটি স্মৃতিফলক অর্ধনির্মিত অবস্থায় এবং ডাঙ্গারহাট চৌরাস্তায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আসাদ আলীর নামে পশ্চিম ছাতনাইয়ে একটি বাজারের নামকরণ করা হয়েছে আসাদগঞ্জ বাজার। [নাজিফা আলম মেঘনা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!