You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ডুমুরিয়া উপজেলা (খুলনা)

ডুমুরিয়া উপজেলা (খুলনা) বিশ শতকের প্রথমার্ধে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানা কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এ থানার শোভনা গ্রামের চারু চন্দ্র বসু (চারু বোস) ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পুরুষ। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। চল্লিশের দশকের শেষার্ধে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে এখানকার শোভনা, কানাইডাঙা, ওড়াবুনিয়া, বকুলতলা, ধানিবুনিয়া প্রভৃতি স্থানে কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হয়। কৃষক নেতা বিষ্ণু চ্যাটার্জী (১৯১০-১৯৭১) ছিলেন এ আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করার পাশাপাশি তিনি নদীর লবণাক্ততা থেকে কৃষি জমি রক্ষার জন্য প্রায় দশ হাজার কৃষককে সংগঠিত করে শোভনার শাখাবাহী নদী ও জেলেপাড়া খালে বাঁধ নির্মাণ করেন।
পাকিস্তান আমলে এখানে বামপন্থী রাজনীতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ (ন্যাপ)-এর সংগঠন ও প্রভাব ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জনপ্রিয়তা ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রাদেশিক ও জাতীয় উভয় পরিষদে বিজয় লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডুমুরিয়ায় সশস্ত্র বামপন্থী রাজনীতির শক্তিশালী ভিত্তি ও সংগঠন ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বামপন্থীরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ডুমুরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন শেখ জোবায়েদ আলী, কমান্ডার নূরুল ইসলাম মানিক, শেখ আবদুল মজিদ প্ৰমুখ। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এডভোকেট এনায়েত আলী আওয়ামী লীগ থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন। তখন ডুমুরিয়ায় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন নারায়ণ চন্দ্ৰ চন্দ। এডভোকেট এনায়েত আলী এমএনএ ও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ভারতে যান এবং প্রশিক্ষণের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই ও তাঁদের রাজনৈতিকভাবে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডুমুরিয়া থানার এক অংশ ৮ নম্বর সেক্টর এবং অন্য অংশ ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনস্থ ছিল।
মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় কমান্ডার নূরুল ইসলাম মানিক স্থানীয় বেশকিছু যুবককে যুদ্ধকৌশল ও আত্মরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেন। ভাণ্ডারপাড়া ইউনিয়নের বান্দা হাইস্কুল মাঠে রাতের বেলা তিনি এ প্রশিক্ষণ দিতেন। মে মাসে এসব যুবক অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান।
সেখান থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব মুক্তিযোদ্ধারা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে ডুমুরিয়ায় অবস্থান করতে শুরু করেন। শোভনা ইউনিয়নের বারুইকাঠি গ্রামের বিষ্ণুপদ রায়ের বাড়ি ছিল ডুমুরিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ক্যাম্প। ডুমুরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে স্থানীয় সশস্ত্র বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আগে থেকেই সশস্ত্র থাকায় বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীদের লুটপাট ও নির্যাতন প্রতিরোধে সক্ষম হন। বামপন্থীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পুরোটাই স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ও পরিচালিত হয়েছিল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৭শে মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনার দিকে অগ্রসর হলে আড়ংঘাটা গ্রামের মো. রুহুল মোড়লের নেতৃত্বে থুকড়া ও শাহপুর এলাকার ২৫-৩০ জন যুবকের একটি সশস্ত্র দল দৌলতপুরের মহসিন মোড় এলাকায় তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এ ঘটনার কয়েকদিন পর ইপিআর অফিসার ক্যাপ্টেন ডা. আসিফুর রহমানের নেতৃত্বে ডুমুরিয়া থানার অস্ত্র লুট করা হয়। আসিফুর রহমান ছিলেন খুলনা শহরের বানরগাতি এলাকার অধিবাসী। তিনি-সহ কয়েকজন ইপিআর সদস্য কিছু অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে এসে ডুমুরিয়ার কুলটি গ্রামে অবস্থান নেন। ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে এ গ্রামের সুধাংশু ফৌজদার, হীরেন্দ্রনাথ ফৌজদার, কমল রায়সহ ৮-১০ জন দুঃসাহসী যুবক ডুমুরিয়া থানা থেকে অস্ত্র দখলে অংশ নেন।
কৃষক নেতা শেখ আবদুল মজিদ (১৯৩৯-১৯৮৯)-এর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি-এমএল)- এর একটি সশস্ত্র দল স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে শেখ আবদুল মজিদের নামে গড়ে ওঠা মজিদ বাহিনীর সঙ্গে শোভনা ইউনিয়নের গাবতলা বাজারে পাকসেনাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এর ফলে পাকবাহিনী সেখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ প্রতিরোধযুদ্ধে মজিদ বাহিনীর ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মার্চ ও এপ্রিল মাসে নূরুল ইসলাম মানিকের নেতৃত্বে কিছু যুবক স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীদের লুটপাট ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
ডুমুরিয়ায় মজিদ বাহিনীর বেশ প্রভাব ছিল। এ বাহিনীর নেতা শেখ আবদুল মজিদ ইপিসিপি-এমএল-এর খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ইপিসিপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার বিরোধিতা করলেও শেখ আবদুল মজিদ পার্টির নির্দেশ উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। শোভনা গ্রামে তিনি একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধা খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক, মজুর ও ছাত্র ছিলেন। মজিদ বাহিনীর সক্রিয় অন্য নেতাদের মধ্যে নকুল মল্লিক (শোভনা ইউনিয়ন), অনাদী মোহন মণ্ডল (রংপুর ইউনিয়ন), এডভোকেট আবদুল রউফ (ধামালিয়া ইউনিয়ন), খালেদ রশিদ গুরু (অধ্যাপক, খুলনা মহিলা কলেজ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ডুমুরিয়া উপজেলার উত্তরাংশে প্রথম পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করে। দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক ছিল ডুমুরিয়ার উত্তরাংশে। এ সড়ক দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা চলাচল করত। এপ্রিল মাসের শেষার্ধে পাকবাহিনী শোভনা ইউনিয়নের গাবতলা বাজার আক্রমণ করে। পরে তারা রংপুর ইউনিয়নের শলুয়া বাজারের একটি ধান মাড়াই মিলে ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়াও থানার বরুণা বাজার, নেহালপুর, কাঠেঙ্গা গ্রাম, জামিরা বাজার, এনজিসি এন্ড এনজিকে হাইস্কুলের ছাত্রাবাস, মজিদ মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন ভবন ইত্যাদি স্থানে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল।
ডুমুরিয়ায় পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটি গঠিত হয় এপ্রিলে। এখানে রাজাকারদের শক্তিশালী সংগঠন ও ব্যাপক তৎপরতা ছিল। মে মাসে খুলনা শহরে বাংলাদেশের প্রথম যে রাজাকার দল গঠিত হয়, তাতে ডুমুরিয়ার কিছু লোকও ছিল। তারা খুলনা থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ডুমুরিয়ায় ফিরে নিজ-নিজ এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠন করে। সবশেষে গঠিত হয় আলবদর বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডুমুরিয়ায় মানবতাবিরোধী যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূল হোতা ছিল এ তিন বাহিনী।
মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী- এ দুই দলের কর্মী, সমর্থক ও অনুগামীদের নিয়ে এখানকার রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত এদের সঙ্গে মূলত মজিদ বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকে মজিদ বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এদের বেশকিছু সংঘর্ষ হয়। ডুমুরিয়ার হত্যা ও গণহত্যার একটি বিরাট অংশ ডুমুরিয়া রাজাকার বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত হয়। এরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন ও লুটপাট চালায়। মূলত এদের অত্যাচার ও সন্ত্রাসের কারণে এ এলাকার বেশির ভাগ হিন্দু পরিবার শরণার্থী হিসেবে ভারতে যেতে বাধ্য হয়। নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর ক্ষেত্রেও রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির তৎপরতা ছিল।
খুলনা জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আবদুল আহাদ খান ও সেক্রেটারি ছিল মওলা বক্শ গোলদার। উভয়েই ডুমুরিয়া উপজেলার অধিবাসী ছিল।
খুলনা মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিল ডুমুরিয়ার আবদুল লতিফ মল্লিক (উলা, সাহস), ডুমুরিয়া থানার রাজাকার কমান্ডার ছিল শেখ নজরুল ইসলাম (সবুজবাগ, ডুমুরিয়া), থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল হামিদুর রহমান গোলদার (চিংড়া) এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল মাওলানা শেখ আকতার (গুটুদিয়া)। ডুমুরিয়া থানা সদরের রাজাকার কমান্ডার ছিল আকবর শেখ। ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামালউদ্দিন ছিল থানা রাজাকার বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার। খর্নিয়া ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম খান (বাচ্চু রাজাকার), সোহরাব সরদার, জামাল শেখ (মেছাঘোনা) ছিল এ এলাকার কুখ্যাত রাজাকার। শরাফপুর ইউনিয়নের কমান্ডার ছিল তমিজউদ্দিন শেখ। বানিয়াখলি রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার ছিল হাসেম আলি। ধামালিয়া ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার ছিল নওশের আলি বিশ্বাস (টোলনা)। কমলপুর গ্রামের সাজ্জাদ বিশ্বাস, মোকছেদ আলী বিশ্বাস, আখেরাত মোল্লা, ছাত্তার মোড়ল, থুকড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন গাজি, ইজাহার আলী সরদার প্রমুখ ডুমুরিয়া থানার পরিচিত রাজাকার। এছাড়া ডুমুরিয়ার চতুর আলী মোল্লা, থুকড়ার শেখ গোলাম হোসেন, শেখ হবিবুর রহমান (শরাফপুর) প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেয়।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা ডুমুরিয়ায় অনেক হত্যা ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো চুকনগর গণহত্যা। ২০শে মে পাকসেনারা এ গণহত্যা ঘটায়। এ গণহত্যার পর এখান থেকে ১০ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ অপসারণ করা হয়। সম্ভবত এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় গণহত্যা। একদিনে এত লোক হত্যা আর কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। এছাড়া খলশি হত্যাকাণ্ড-এ ৩০ জন এবং আন্দুলিয়া গণহত্যায় ১৭ জন নিহত হয়। এসব ছাড়া ডুমুরিয়াতে আরো অনেক গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেগুলোর মধ্যে রংপুর গণহত্যা, দাসপাড়া গণহত্যা, বাদুড়গাছি গণহত্যা, খর্নিয়া গণহত্যা, পাতিবুনিয়া গণহত্যা, বরুণা বাজার গণহত্যা, চেঁচুড়ি গণহত্যা, কাটেঙ্গা গণহত্যা, শাহপুর গণহত্যা, সাজিয়াড়া হত্যাকাণ্ড, রানাই বকুলতলা গণহত্যা, গণহত্যা, জামিরা
চিংড়া গণহত্যা, মান্দ্রা মাদ্ৰা গণহত্যা, শোলগাতিয়া গণহত্যা, টোলনা গণহত্যা ও থুকড়া বাজার গণহত্যা উল্লেখযোগ্য। সমগ্র ডুমুরিয়ার বিভিন্ন গ্রামে এক-দুজনের হত্যার অনেক ঘটনা ঘটেছে।
ডুমুরিয়ার রেবা রাণী নাথ- মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করেছেন। জুন মাসের শেষের দিকে পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়ে ভারতে যাবার পথে যশোর জেলার পাথরঘাটা নামক স্থানে তিনি পাকবাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন। পাকবাহিনী এদিন পাথরঘাটা থেকে তিন-চারটি গাড়িতে ৫০-৬০ জন নারীকে তুলে নেয়। তাদের সঙ্গে রেবা রাণী পাকসেনাদের ঝাউডাঙ্গা (বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত) ক্যাম্পে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। কিছুদিন পর পাকসেনারা তাকে একজন রাজাকারের হাতে তুলে দিলে সেখানেও তিনি পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।
এছাড়া ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নে রসাজিয়াড়া গ্রামের একজন মহিলাকে খুলনায় তার পৈতৃক বাড়ি থেকে পাকসেনারা অপহরণ করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি মুক্তি পান। শোভনা ইউনিয়নের ভদ্রদিয়া গ্রামের কর্মকার বাড়ির এক তরুণী আত্মীয়াকে খর্নিয়ার রাজাকাররা ধর্ষণ করে। রংপুর গ্রামের জনৈক গৃহবধূকে (রঘুনাথপুর ইউনিয়নের রূপরামপুর গ্রামের মেয়ে) থুকড়ার রাজাকাররা অপহরণ করে ধর্ষণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের শান্তিলতা সাহাকে ডুমুরিয়ার ধামালিয়া রাজাকার ক্যাম্পের নওশের আলি অপহরণ করে। পরে তাকে হত্যা করা হয়। ডুমুরিয়ার প্রায় সব রাজাকার ক্যাম্পে নারীনির্যাতন ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। এর মধ্যে কাপালিডাঙ্গা, খর্নিয়া ও বরুণা বাজার ছিল কুখ্যাত। কমলপুরের রাজাকাররাও নারীধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল। অনেক রাজাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভয়ভীতি দেখিয়ে নারীদের নির্যাতন করত। ভারতে গমনরত শরণার্থীদের মধ্য থেকেও রাজাকাররা মেয়েদের অপহরণ করত। ডুমুরিয়ার রাজাকাররা পাকসেনাদের নারী সরবরাহ করত।
মে মাসের দিকে পাকিস্তানি সেনারা খলসি গ্রামের প্রায় দেড়শত বাড়িতে প্রথমে লুণ্ঠন এবং পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ডুমুরিয়া সদরের খোকন মিয়া, মাগুরখালী ইউনিয়নের মো. ইউসুফ ছিল লুটপাটের প্রধান হোতা। মে মাসে হিন্দু অধ্যুষিত মাগুরখালী ইউনিয়নের সহস্রাধিক বাড়ি লুণ্ঠিত হয়। এছাড়া রংপুর ইউনিয়ন, ভাণ্ডারপাড়া ইউনিয়ন, গুটুদিয়া ইউনিয়ন ও শাহপুর ইউনিয়নের অসংখ্য বাড়ি লুণ্ঠনের শিকার হয়। চুকনগর গণহত্যার দিন নিহতদের সঙ্গে থাকা মূল্যবান সম্পদ লুট করা হয়। এদিন চুকনগর নন্দী বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া শরাফপুর, শোভনা, রংপুর প্রভৃতি গ্রামেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ডুমুরিয়া উপজেলায় বেশকিছু বধ্যভূমি ও কয়েকটি গণকবর রয়েছে। বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে রংপুর বধ্যভূমি, ডুমুরিয়া দাসপাড়া বধ্যভূমি, বাদুড়গাছি বধ্যভূমি, চুকনগর বধ্যভূমি, খর্নিয়া বধ্যভূমি, পাতিবুনিয়া বধ্যভূমি, বরুণা বাজার বধ্যভূমি, চেঁচুড়ি বধ্যভূমি, কাঠেঙ্গা বধ্যভূমি, শাহপুর বধ্যভূমি, রানাই বকুলতলা বধ্যভূমি, আন্দুলিয়া উত্তরপাড়া বধ্যভূমি, শোলগাতিয়া বধ্যভূমি, জামিরা বধ্যভূমি, খলসি বধ্যভূমি, আন্দুলিয়া বধ্যভূমি, থুকড়া বাজার বধ্যভূমি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। চুকনগর বধ্যভূমিতে গণকবর রয়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মজিদ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধ হয়। মজিদ বাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে শোভনা ইউনিয়নের গাবতলা বাজারে (এপ্রিলের শেষের দিকে) ও পাতিবুনিয়া ঝিলেরমুখ নামক স্থানে দুটি যুদ্ধ হয়। ঝিলেরমুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ ডুবে যায়। পাকবাহিনীর সঙ্গে ডুমুরিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ যুদ্ধ হয় ডুমুরিয়া এলাকার বাইরে। ডিসেম্বর মাসে মিত্রবাহিনীর একটি দল ডুমুরিয়ার ভেতর দিয়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হলে ডুমুরিয়ার মুক্তিবাহিনী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৩ই ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম মানিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ডুমুরিয়া থানা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলে থানায় অবস্থানকারী পুলিশ ও মিলিশিয়ারা পালিয়ে যায়। এভাবে ডুমুরিয়া থানা মুক্ত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের শলুয়া বাজার যুদ্ধ-এ মিত্রবাহিনীরর ১৪ জন সৈন্য শহীদ হন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা কাপালিডাঙা ও শরাফপুর রাজাকার ক্যাম্পে দুটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। ১৪ই ডিসেম্বর ডুমুরিয়া হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— এইচ এম আব্দুল গাফ্ফার, বীর উত্তম- (পিতা মোহম্মদ কায়কোবাদ, গুটুদিয়া)।
শোভনার গাবতলা যুদ্ধে মজিদ বাহিনীর দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- খালেদ রশিদ গুরু (অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, খুলনা মহিলা কলেজ, খুলনা) এবং রঞ্জন কর্মকার (দৌলতপুর, খুলনা)। ১৪ই ডিসেম্বর শলুয়া বাজারে মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধে মো. আলাউদ্দিন কুদ্দুস (রাইতুল, কাশিয়ানি, গোপালগঞ্জ) শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ডুমুরিয়া সদরে অবস্থিত মহিলা কলেজের নাম দেয়া হয়েছে শহীদ স্মৃতি মহিলা মহাবিদ্যালয়। উপজেলার সরকারি মিলনায়তনের নাম শহীদ জোবায়েদ আলী মিলনায়তন। রংপুর ইউনিয়নের একটি সড়কের নাম রাখা হয়েছে শহীদ প্রফুল্ল সড়ক। রংপুর গণহত্যায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের উদ্যোগে এ গ্রামে পাঁচটি স্মৃতিস্তম্ভ ও নামফলক তৈরি হয়েছে। চুকনগর গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে, যা চুকনগর স্মৃতিস্তম্ভ নামে পরিচত। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব নামে রংপুর গ্রামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চুকনগর গণহত্যার স্মরণে একটি স্মারক সৌধ নির্মিত হয়েছে। দৌলতপুর-চুকনগর সড়কের পাশে থুকড়া বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি কবরস্থান রয়েছে। এছাড়া ডুমুরিয়া সদরে একটি বহুতলবিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। [দিব্যদ্যুতি সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!