ডাববাগান যুদ্ধ (সাঁথিয়া, পাবনা)
ডাববাগান যুদ্ধ (সাঁথিয়া, পাবনা) সংঘটিত হয় ১৯শে এপ্রিল। এতে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ১২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার অন্তর্গত একটি গ্রামের নাম পাইকরহাটি। নগরবাড়ি থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে এবং বেড়া উপজেলা থেকে নগরবাড়ি অভিমুখী নগরবাড়ি-বগুড়া মহাসড়কের ৮ কিলোমিটার দক্ষিণের সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত গ্রামের পশ্চিমপাড়া ও পূর্বের পুড়ানপাড়া- বিশ্বাসপাড়া ডাববাগান নামে পরিচিত। ৯ই এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী আরিচা থেকে নগরবাড়ি দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা নিয়ে ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নগরবাড়িতে অবস্থিত প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। দ্রুত নগরবাড়ি দখলে নিয়ে তারা সেখানে বড় ধরনের ঘাঁটি স্থাপন করে। এ ঘাঁটির মাধ্যমে তারা সমগ্র উত্তরাঞ্চল নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করে। পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য ডাববাগানে বেড়ার প্রতিরোধযোদ্ধারা শক্তিশালী প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বেড়া হাসপাতালকে হেডকোয়ার্টার্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত অফিসার হুদা ও আলী আকবরের নেতৃত্বে একদল বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনা প্রচুর অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হন। বগুড়ার আতিয়াবাজার ক্যাম্প থেকে ৭৩০ জন ইপিআর সদস্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে ডাববাগান প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আগমন করেন। বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর ও পাবনার পুলিশ, ইপিআর এবং আনসার বাহিনীর সদস্যগণও এতে অংশগ্রহণ করেন। বগুড়া থেকে আগত অফিসার হুদা ও কুষ্টিয়া জেলার শান্তিডাঙ্গার ইপিআর সুবেদার আলী আকবরের নেতৃত্বে পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, শাহজাদপুরের আব্দুর রহমান এমপিএ এবং নগরবাড়ি-রঘুনাথপুরের আবু মো. ফয়জুল্লার সহযোগিতায় ডাববাগানে পাকবাহিনীর জন্য ত্রিমুখী ফাঁদ তৈরি করা হয়।
কাশিনাথপুর বরাটের মীর মো. আলী ওরফে ঠান্ডু মিয়া ছিল জামায়াতের লোক। সে সব সময় নগরবাড়ি পাকসেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। মূলত তার মাধ্যমেই পাকসেনারা ডাববাগানের প্রতিরোধযোদ্ধা ও তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয়। তাই পাকবাহিনী পরিকল্পিত হামলা শুরু করার জন্য প্রায় এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে। ১৯শে এপ্রিল আনুমানিক বেলা সাড়ে এগারটা। বেড়া থেকে জিপযোগে প্রতিরোধযোদ্ধাদের জন্য ডাববাগানে খাবার পৌঁছে গেছে। এ-সময় প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনেকেই বাংকার বা নিজেদের অবস্থান ছেড়ে বিশ্বাসপাড়া ও সমাসনাড়ী ধনি হাজির পুকুরে গোসল করতে যান। অন্যরাও যুদ্ধাবস্থায় প্রস্তুত ছিলেন না। এমন সময় নগরবাড়ি থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিশাল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কনভয় ডাববাগানের দিকে অগ্রসর হয় এবং দুপুর নাগাদ পাকবাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ মূল সড়ক পথে এবং অপর দল গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রতিরোধযোদ্ধাদের পেছন দিক থেকে হামলা চালায়। প্রথম হামলা শুরু করে সড়ক পথের সেনারা। প্রতিরোধযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পেছন দিক থেকে হানাদার বাহিনীর অপর দলটি প্রতিরোধযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। ফলে প্রতিরোধযোদ্ধারা এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যান। প্রতিকূল অবস্থায়ও তাঁরা মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। হানাদারবাহিনীর ভারী অস্ত্রের গুলিবর্ষণ সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে। প্রতিরোধযোদ্ধারা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল এসএমজি, এলএমজি ও গ্রেনেড ছুড়ে যুদ্ধ করেন। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমণে টিকতে না পেরে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। পাকিস্তান বাহিনী মহাসড়কের পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে প্রতিরোধযোদ্ধাদের অবস্থানসহ আশপাশ ঘিরে ফেলে এবং ইপিআর ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ গ্রামের নিরীহ লোকদের ধরে-ধরে গুলি করে হত্যা করে। প্রায় তিন ঘণ্টার প্রতিরোধযুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২ জন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের মধ্যে ২৬ জন ইপিআর, ৫০ জন আনসার, ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী শহীদ হন।
ডাববাগান যুদ্ধে যেসব ইপিআর সদস্য শহীদ হন, তাঁদের কয়েকজন হলেন- হাবিলদার মো. এমদাদ আলী (পাবনা), নায়েক মো. মফিজ উদ্দিন (ঢাকা), নায়েক মো. গোলাম পাঞ্জাতন (কুষ্টিয়া), লে. নায়েক মো. আতিয়ার রহমান (কুষ্টিয়া), লে. নায়েক মো. সালেহ আহমেদ (নোয়াখালি), সিপাহি মো. নূরউদ্দিন (বরিশাল), সিপাহি মো. ইলিয়াছ (রাজশাহী), সিপাহি মো. আবু হোসেন (রাজশাহী), সিপাহি মো. রফিকুল ইসলাম (রাজশাহী), সিপাহি মো. আবুল কাশেম (রাজশাহী), সিপাহি মো. ইদ্রিস (রাজশাহী), সিপাহি মো. নেফারুল হক (রাজশাহী), সিপাহি মো. আমীর হোসেন (রাজশাহী), সিপাহি মো. সাইফুর রহমান (রাজশাহী), সিপাহি মো. গোলাম মোস্তফা (সিলেট), সিপাহি মো. আব্দুর রাজ্জাক (যশোর) ও সিপাহি মো. রমজান আলী (যশোর)। কমান্ডার হাবিলদার মো. আলী আকবর (কুষ্টিয়া) ও হাবিলদার মো. আলী (নোয়াখালী) যুদ্ধে আহত হন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীর শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ স্থানীয়ভাবে পাইকরহাটি ডাববাগান গ্রামের অংশবিশেষের নামকরণ করা হয় শহীদনগর। ডাববাগান প্রতিরোধযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী জনগণ এতটাই প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত ছিল যে, পাকিস্তানি প্রশিক্ষিত সৈন্যদের ভারী মেশিনগান, মর্টার, জঙ্গিবিমান কোনোকিছুই তাদের ভীত করতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে তারা তীর, ধনুক, লাঠিসোঁটা, দা-কুড়াল, ফলা-বল্লম, ঢাল-তলোয়ার, বন্দুক, টু-টুবোর রাইফেলের মতো সাধারণ অস্ত্র নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
ডাববাগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে বেড়ার প্রতিরোধযোদ্ধারা উপলব্ধি করেন যে, সামান্য অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তাই ১৯শে এপ্রিলের পর অবশিষ্ট ইপিআর সদস্যগণ তাঁদের মূল ইউনিটের সঙ্গে যোগ দিতে বেড়া ত্যাগ করেন এবং প্রতিরোধযোদ্ধাদের আত্মগোপনের পরামর্শ দেন। ডাববাগান যুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শহীদনগরে (বর্তমান বাজার সংলগ্ন) ‘বীর বাঙালি’ নামে একটি স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। [আবু সাইয়িদ ও মো. ছাবেদ আলী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড