ঠাটমারী ব্রিজ বধ্যভূমি (রাজারহাট, কুড়িগ্রাম)
ঠাটমারী ব্রিজ বধ্যভূমি (রাজারহাট, কুড়িগ্রাম) রাজারহাট উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিমে কুড়িগ্রাম অভিমুখী রেললাইন ও সড়কে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত সল্লা বিলের ড্রেনের পাশে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বহু মানুষকে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়।
মার্চ-এপ্রিল মাসে তিস্তা প্রতিরোধযুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ভয়ে ব্রিজ ও রেলপথ রক্ষার জন্য তিস্তা থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত রেল লাইনের প্রায় সকল ব্রিজে ক্যাম্প স্থাপন করে বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা করে। এ ক্যাম্পগুলোর আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে তারা খাবারের জন্য গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস ও মুরগি ধরে নিয়ে যেত, মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ শেষে হত্যা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে তারা গ্রামে তল্লাশি চলিয়ে অগ্নিসংযোগ করত এবং গণহত্যা চালাত। ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ঠাঁটমারী ব্রিজ বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্র উল্লেখযোগ্য। নারীধর্ষণ ও গণহত্যার জন্য এটি ছিল স্থানীয়দের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা। ১৫ থেকে ২৫ জন হানাদার সেনাসদস্য এখানে সবসময় অবস্থান করত। রাজাকারদের সহায়তায় তারা গ্রামের সাধারণ মানুষদের এ ক্যাম্পে ধরে এনে নানাভাবে নির্যাতন শেষে হত্যা করে লাশ সল্লার ড্রেনের তীব্র স্রোতে ভাসিয়ে দিত। দুধখাওয়া, বিশ্বকর্মার মাল্লী ও বাজেমুজরাইসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলো থেকে শতাধিক নারীকে ধরে এনে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। মসজিদে নামাজের সময় সেখান থেকে উঠিয়ে একাধিক মুসলমানকে এ ক্যাম্পে এনে হত্যা করে তাদের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়। পাকসেনা ও রাজাকাররা ঠাঁটমারী ব্রিজ বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্রের আশপাশের এলাকাকে এক বিরান ভূমিতে পরিণত করে।
পাকিস্তানি সেনারা কুড়িগ্রাম অনুপ্রবেশের দিন ঠাঁটমারীতে রাজকুমার ও গোপালকে হত্যা করে। তারা খুলিয়াতারী গ্রামের আজির উদ্দিন, পাঠানপাড়া গ্রামের দুই সহোদর আয়নাল ও জয়নালকে গুলি করে হত্যা করে। এলাকার রাজাকারদালালদের প্ররোচনায় তারা এ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা দেলওয়ার হোসেনকে নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা ঠাঁটমারী ক্যাম্পের কদমগাছের নীচে জয়দেব হায়াৎ গ্রামের মতিয়ার রহমান এবং কয়রুদ্দিকে গুলি করে হত্যা করে। পালিয়ে যাওয়ার দিন তারা ঠাঁটমারী ক্যাম্পের নিকটবর্তী কেন্দ্রা মৌজার ছাদ্দিবুড়ার মহির উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী ভানুর ভিটা গ্রামে তারা গুলি করে সামাদ, মন্তাজসহ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ১৬ই ডিসেম্বরের পর ঠাঁটমারীর পাকসেনা ক্যাম্প সংলগ্ন বাংলার দোলায় (বিল) আরো ৭ জন মানুষের মাথার খুলি পাওয়া যায়। হানাদাররা মো. আজিমুদ্দিন (পিতা মো. কেতাব উদ্দিন, খুলিয়াতারী)-সহ ৮-১০টি এবং চাকিরপশার কানুয়া মৌজায় অনেকগুলো বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। যুদ্ধের শেষের দিকে ঠাঁটমারী ক্যাম্প থেকে ১০-১২ জন পাকিস্তানি সেনা ও কয়েকজন রাজাকার ২-৩ কিলোমিটার দূরে দেবালয় গ্রামে এসে ৬-৭টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা বিদ্যানন্দ গ্রামের আবুল হাশেমকে ধরে এনে নির্যাতন শেষে দশ হাজার টাকার বিনিমিয়ে মুক্তি দেয়। কেরামত আলীর পুত্র ছহির উদ্দিনকে ৩ দিন এ ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন শেষে তিস্তা ব্রিজের নিচে পানিতে ফেলে দেয়। ঘটনাক্রমে তিনি বেঁচে যান। তারা খুলিয়াতারী গ্রামের হালিমা বেগম হালি (১৩) (পিতা আমিরুদ্দিন)-কে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এবং টরটরিয়া গ্রামের মামুদের স্ত্রীকে (২৫) বাড়িতে গিয়ে ধর্ষণ করে। মে মাসে এ ক্যাম্পের ৯ জন আর্মি বামনের ডারা দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ধুমালের বাড়িতে প্রবেশ করে পূজার সময় ২০ জন হিন্দু এবং পাশের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চারায়। তাদের কাছ থেকে জবরদস্তি তথ্য আদায় করে এলাকায় আশ্রিত কুড়িগ্রামের পাগলা গাড়িয়ালের পরিবারের কন্যা, পুত্রবধূ ও ভাতিজিসহ চারজন মহিলাকে খুঁজে বের করে এবং ধর্ষণ করে। এ ঘটনার ৩-৪ দিন পর ঐ ক্যাম্পের ৭-৮ জন পাকসেনা পাশের ছাটমাধাই গ্রামের হাজী পানাউল্লা মণ্ডলের কবরের পাশে কয়েকজনকে শারীরিক নির্যাতন করে তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করে। অপর একদিন এ গ্রামে প্রবেশ করে তারা শামসুদ্দিন মণ্ডলের মাথা ফাটিয়ে দেয়। তারা দেবালয়ের করিম বক্সের ১৪ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে। তারা রাজাকারদের সহায়তায় কিসামত পাইকপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন বসুনীয়া ও নজরুল ইসলাম বসুনীয়াকে গুলি হত্যা করে এবং তাঁদের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি এবং পশ্চিমপাড়ার নিজাম, আব্বাস ও মকবুলসহ অনেকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা অনেক হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাট করে ও আগুন দেয়।
শ্রাবণ মাসের শেষদিকে ঠাঁটমারী ক্যাম্পের ৮ জন হানাদার সদস্য চাইনিজ রাইফেলসহ তালতলার স্কুল মাঠে যায়। এ- সময় মুক্তিযোদ্ধা এস এম হারুন-অর-রশীদ লাল সহযোগী শেলুসহ পাকসেনাদের অবস্থান র্যাকি করতে গিয়ে তাদের সামনে পড়ে যান। তাঁরা দৌড়ে প্বার্শবর্তী জঙ্গলের দিকে গেলে হানাদাররা তাঁদের ধাওয়া করে। এ- সময় জীবন ও সম্ভ্রমের ভয়ে কয়েকজন নারী সল্লা বিলের দিকে দৌড় দিলে পাকসনারা তাদের পিছু নেয়। তারা রাইফেল থেকে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ফাঁকা জমিতে তাদের ধরে ধর্ষণের চেষ্টা করে। অদূরে জমিতে হাল চাষরত চাষি পনের উদ্দিন এবং অছি মামুদ মেয়েদের চিৎকার শুনে ধর্ষক পাকসেনাদের প্রতিরোধ করতে গেলে তারা পনের উদ্দিন ও অছি মামুদকে গুলি করে হত্যা করে। এ-সময় তারা কাঞ্চন বালা ওরফে সরলা বালাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তার দুটি শিশুসন্তানের সামনে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তারা রাজারহাটের মেহেরন নেছাকে ঠাঁটমারী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে একাধিক দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে। [জ্যোতি আহমদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড