মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা ১৯৭১ সালে দেশের সর্ব উত্তর প্রান্তের মহকুমা ঠাকুরগাঁও-এর সদর থানার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সদর থেকে মহকুমার ১০টি থানার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতো। এ অঞ্চলের আন্দোলন-সংগ্রামেরও অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল ঠাকুরগাঁও। ৫২-এর ভাষা-আন্দোলন, ৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন-এর ঢেউ ঠাকুরগাঁও থেকে এ অঞ্চলের গ্রামে- গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ১৯৬৯ সালে এক প্রচারাভিযানে ঠাকুরগাঁও-এ আসেন। মহকুমা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি আব্দুল লতিফ মোক্তারের সভাপতিত্বে স্থানীয় নাট্য সমিতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি বক্তৃতা করেন। এ প্রচারাভিযান ও বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার ফলে ঠাকুরগাঁও-এর সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা আন্দোলন এখানকার মানুষকে আরো উজ্জীবিত করে। স্বাধীনতার দাবি- সম্বলিত বিভিন্ন স্লোগানে ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামগঞ্জ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তবে সংগ্রামকে তীব্রতর করে তুলতে ন্যাপ (ওয়ালী খান), ন্যাপ (ভাসানী) ও কমিউনিস্ট পার্টি— সহায়তা করে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও কিছু ইসলামী দল জনতার এ আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। ৬৯- সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও মহকুমা থেকে বিপুল ভোটে মোশাররফ হোসেন চৌধুরী ও আজিজুর রহমান এমএনএ এবং কমর উদ্দিন আহমেদ, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, মো. ফজলুল করিম ও মো. ইকরামুল হক এমপিএ নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করলে ঠাকুরগাঁও-এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে প্রথমে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২রা মার্চ ঠাকুরগাঁও-এর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন ও প্রতিবাদ মিছিল হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ৩রা থেকে ৬ই মার্চ
প্রতিদিন আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পালিত হয়। এক সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে বিভিন্ন স্থানে নিহতদের স্মরণে ঠাকুরগাঁও-এর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন
বাসভবন ও দোকানে কালো পতাকা উত্তোলন এবং কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়। এসবের মাধ্যমে গোটা জনপদ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসমাজ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়। ৬ই মার্চ সারাদিন খণ্ড- খণ্ড মিছিল আর মুহুর্মুহু স্লোগানে গোটা শহর প্রকম্পিত ছিল। সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের হয়। সংগ্রামী মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধের শপথে উজ্জীবিত হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারিত না হওয়ায় ঠাকুরগাঁও-এর মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়। তবে রাত ১০টার মধ্যে আকাশবাণী ও বিবিসি-র খবরে ঐতিহাসিক এ জনসভা ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল বক্তব্য সম্পর্কে মানুষ অবহিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ৮ই মার্চ রেডিওতে প্রচারিত হলে এখানে সকলে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সে ভাষণ শোনে। মুহূর্তেই সকলের মধ্যে উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। ভাষণ শোনা শেষ হতেই মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এক সময় এসব মানুষ এক বিশাল মিছিলে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার জন্য শুরু হওয়া দুর্বার এ মিছিল শহরের পাবলিক ক্লাব মাঠে এসে সমবেত হয়। এখানে বক্তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে সবাইকে আহ্বান জানান।
–
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যারা ঢাকা গিয়েছিলেন তাদের অনেকে ৯ই মার্চ ঠাকুরগাঁও ফিরে আসেন। তাদের কেউ-কেউ ঐতিহাসিক ভাষণের ক্যাসেট নিয়ে আসেন। মাইকে সে ভাষণ ফজলুল করিম এমপিএ-র বাসভবনের সামনে থেকে প্রচার করা হয়। এ ভাষণ এবং এর নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রতিদিনই ঠাকুরগাঁও-এ মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। প্রশাসনের সব কাজ অচল হয়ে যায়। সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ মেনে চলতে স্থানীয় প্রশাসনকে বাধ্য করা হয়। ঢাকা থেকে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী ছাত্রনেতৃবৃন্দ ২৩শে মার্চ মহকুমা প্রশাসকের অফিস ভবনের ছাদে মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলনের সময় নিচে সমবেত ছাত্র-জনতা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। দোকানপাট, বাসাবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। ঢাকা থেকে টেলিফোনে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুযায়ী ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয়। কিন্তু ২৬শে মার্চ ঢাকার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি ২৫শে মার্চের কালরাতে ঢাকার পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর অতর্কিত হামলা ও বর্বর গণহত্যার খবর ঠাকুরগাঁও-এর মানুষ বিদেশী সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার সংবাদে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ ক্ষোভ ও প্রতিরোধ থেকে এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।
ঠাকুরগাঁও-এ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে এগিয়ে আসে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীরা। তারা তাৎক্ষণিক নানা কর্মসূচি পালন করে। মিছিল- মিটিং-এর মাধ্যমে তারা অসহযোগ আন্দোলনকে তীব্রতর করে। পরে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সক্রিয় হয়ে অসহযোগ আন্দোলন ও যুদ্ধ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ন্যাপ (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে কাজ করে। ঠাকুরগাঁও-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- আজিজুর রহমান এমএনএ, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম এমপিএ, মো. ফজলুল করিম এমপিএ, আব্দুল লতিফ মোক্তার, আব্দুর রশীদ মোক্তার, ডা. শেখ ফরিদ, আকবর হোসেন, এডভোকেট আবদুর রউফ, শওকত আলী মোক্তার, এডভোকেট এফ এ মোহাম্মদ হোসেন, এডভোকেট নূরুল হক, বলরাম গুহঠাকুরতা, এডভোকেট কামরুল হোসেন, রেজওয়ানুল হক ওরফে ইদু চৌধুরী, ডা. আবদুল মালেক, এডভোকেট মির্জা রফিকুল ইসলাম, এহসানুল হক চৌধুরী আলা, আবদুল মোমেন, মির্জা তসমিমুল ইসলাম বাবলু, এডভোকেট আবুল হাসেম, হারিদাস গুহঠাকুরতা (বড়), ফণীন্দ্র ভূষণ পালিত, আবদুল জব্বার মুহুরী, আলতাফুর রহমান, খাদেমুল ইসলাম, বাচ্চু দত্ত, কাজী মাজহারুল হুদা, ডা. কুতুবউদ্দিন, শাহ মো. জালাল উদ্দিন (ওয়াপদা), নূরুল হক তাতলিন, আবুল হাসনাত ভোলা, নবগোপাল সামন্ত (পল্টু বাবু), আব্দুল মান্নান (সুলেখা), আব্দুল মান্নান (ব্যবসায়ী), আব্দুল মালেক (ওয়াপদা), মনতোষ কুমার দে, ফালু মিঞা (দর্জি), এস এম আজুিল হক খোকা, জগন্নাথ গুহঠাকুরতা প্রমুখ। অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ছাত্রনেতারা হলেন— এস এম আসগর আলী, বজলুর রহামন, আনোয়ার হোসেন, এ এইচ এম জর্জিসুর রহমান খোকা, আবুল কালাম আজাদ, আনসারুল হক জিন্না, আফাজউদ্দিন আহম্মেদ, মির্জা নূরুল ইসলাম ছুটু, মোহাম্মদ আলী, আনিসুল হক চৌধুরী, জিয়াউল বারী মানিক, মাহবুবুর রহমান বাবুল, রেজাউল হক বাবলু, নকুল চন্দ্র দাস, আমজাদ হোসেন, আবদুল আজিজ, ওয়ালিয়র রহমান মন্টু, আবদুল রউফ, সামসুদ্দোহা, সফিউর রহমান, আবদুল গোফরান, জুলফিকার আলী, নূর ই আক্তার নার্গিস রুবি, শেখ মহিউদ্দিন, বদিউল আলম প্রমুখ।
সাতই মার্চের ভাষণ-এ বঙ্গবন্ধুর দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী ঠাকুরগাঁও-এর মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য লাঠিসোঁটা ও দা-কুড়াল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকেরাও তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে। ১০ই মার্চ শহরের সাউথ সার্কুলার রোড (বর্তমানে শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়ক) সংলগ্ন ফজলুল করিম এমপিএ-র বাসভবনে উৎসুক জনতার ঢল নামে। ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, কেবল মিটিং-মিছিল নয়, যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত হতে হবে। ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ঠাকুরগাঁও হাইস্কুলের শিক্ষক এম ইউসুফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে তাঁকে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এরপর কলেজ থেকে কাঠের ডামি রাইফেলগুলো এনে এম ইউসুফ প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে থাকেন। এ প্রশিক্ষণের আওতায় প্রতিদিন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্র-যুবক ২ থেকে ৩ ঘণ্টা করে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হতো ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল মাঠে। পরে থানার মাঠেও প্রশিক্ষণ পরিচালিত হতো। এভাবে হাইস্কুল, থানা ও পাবলিক ক্লাব মাঠে পরিচালিত প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রতিদিন ঠাকুরগাঁও শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌরাস্তা ও কোর্ট চত্বরে স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে মানুষের মনোবল বৃদ্ধির জন্য ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দিতেন।
দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা অটুট রাখা ও অসহযোগ আন্দোলন এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধু যে ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন, সেগুলো ঠাকুরগাঁও-এ যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কি-না তা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তদারকি করা হতো। পুরো স্থানীয় প্রশাসন তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতো। ঠাকুরগাঁও-এ পাকিস্তানিদের প্রশাসন বলে কিছু ছিল না।
ঢাকায় গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের খবর শোনার পর ২৬শে মার্চ ঠাকুরগাঁও শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় মানুষ ভিড় জমাচ্ছিল ফজলুল করিম এমপিএ-র বাসার সামনের রাস্তায়। এদিকে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ইপিআর ৯ম উইংয়ের হেডকোয়ার্টার্সের অবস্থা জানার জন্য সবাই উদগ্রীব ছিলেন। হেডকোয়ার্টার্সের অধিকাংশ সৈনিক ছিলেন বাঙালি। তবে কমান্ডিং অফিসার মেজর মোহাম্মদ হোসেন এবং সেকেন্ড- ইন-কমান্ড ক্যাপ্টেন নাবিদ আলমসহ বেশকিছু অবাঙালি সৈনিকও ছিল। সবার এ রকম ধারণা ছিল যে, এখানে সংঘর্ষ ও বিদ্রোহ অবধারিত। বাঙালি সৈনিকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য শহরের সকল মিছিল কালীবাড়ি সড়ক দিয়ে ইপিআর ক্যাম্পের দিকে যেত। এসব মিছিল থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ করে জনগণের সংগ্রামে শরিক হতে আহ্বান জানানো হতো। ক্যাম্প থেকে অবাঙালি সৈনিকদের আক্রমণের আশঙ্কায় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে বড়বড় গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হয়। ২৬শে মার্চ জনতা উত্তেজিত হয়ে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে চাইলে নেতৃবৃন্দ তাদের বাধা দিয়ে শহরের দিকে ফিরিয়ে আনেন। এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কালিবাড়ি সড়ক, পাবলিক ক্লাব ও ওয়াপদা কলোনি সংলগ্ন সড়ক বিক্ষুব্ধ মানুষের ভিড়ে এবং স্লোগানে মুখর ছিল। অনেকের হাতে লাঠি ও বল্লম ছিল। কেউ-কেউ লালসবুজ পতাকাও সঙ্গে নিয়ে যায়। সকলের চোখে-মুখে প্রতিরোধ আর দীপ্ত সংকল্প।
এরূপ পরিস্থিতিতে ইপিআর-এর পক্ষ থেকে শহরে কার্টু জারি করা হয়। ইপিআর-এর সৈনিকরা ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তায় টহল দিতে শুরু করে। মেজর মোহাম্মদ হোসেন তার অধীনস্থ ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ও বাঙালি সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনকে নিয়ে জিপে শহর পরিদর্শন করে। তাদের জিপের পেছনে ছিল পিকআপ ভর্তি সশস্ত্র সেনাদল। কার্ফু ও টহলের ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে মোড় নেয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ফজলুল করিম এমপিএ-র বাসায় সভা করেন। সভায় কার্ফু অমান্য, ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। তখন ইপিআর ক্যাম্পে একমাত্র বাঙালি কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন। সকলের প্রত্যাশা ছিল ক্যাম্পে বিদ্রোহ হলে তাঁর নেতৃত্বেই হবে।
২৭শে মার্চ শহরের সব প্রান্ত থেকে জনতার মিছিল চৌরাস্তায় এসে মিলিত হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। বেলা ১২টার দিকে একটি মিছিল কালীবাড়ি হয়ে ইপিআর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলে দক্ষিণ দিক থেকে একটি জিপ ও ইপিআর সৈন্য ভর্তি একটি লরি এসে মিছিলের সামনে অবস্থান নেয়। মিছিলটি তখন কেরামত আলী মোক্তারের বাসার সামনে ছিল। এক সময় লরি থেকে নেমে সৈন্যরা মিছিলের দিকে অস্ত্র তাক করে। মিছিলকারীরা তখনো নির্ভীক স্লোগান দিচ্ছিল। হঠাৎ শ্মশ্রুমণ্ডিত রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী মিছিল থেকে বের হয়ে সামনে এসে একাই ‘জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তখন তার ওপর গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আর্তনাদ করে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি মেজর মোহাম্মদ হোসেনের পিস্তলের গুলিতে নিহত রিকশাচালক মোহাম্মদ আলীর রক্তদানে প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রথম অধ্যায় রঞ্জিত হয়। এ রিকশাচালকই ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম শহীদ।
জনতার আন্দোলন দমন করতে ২৮শে মার্চ শহরে ইপিআর- এর টহল নামে। বাজার পাড়ার কাছ দিয়ে যখন টহল গাড়ি যাচ্ছিল, তখন একটি ছোট ছেলে তাদের জীর্ণ কুঁড়েঘর থেকে ‘জয় বাংলা” স্লোগান দিলে সৈনিকরা সেদিকে গুলি করে। এতে বুলেটবিদ্ধ হয়ে ৭ বছরের নরেশ চৌহান প্রাণ হারায়। এ ঘটনায় সংগ্রামী জনতার ক্ষোভ চরমে পৌঁছে। এদিন রাত ১০টার পর ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁরা ‘জয় বাংলা’, ‘জনতা- ইপিআর ভাই ভাই’ স্লোগান দেন। তাঁরা চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘আমরা রিভোল্ট করেছি’, ‘আপনারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন’। তখনো অবিরাম গুলি চলছিল। এ গুলির মধ্যে ক্যাম্প থেকে ক্রলিং করে সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাঁর পূর্ব-পরিচিত সন্তোষ কুমার দে-র আশ্রমপাড়াস্থ বাসায় পাঠানো হয়। অন্য বাঙালি সৈনিকদের পরিবারের সদস্যরাও শহরের বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নেন। এর মাধ্যমে ইপিআর- এর বাঙালি সৈনিক ও জনতার মধ্যে একটা মৈত্রীর বন্ধন গড়ে ওঠে। জনতার সাহায্যে ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ ঘটিয়ে পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে এক সফল প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনা করেন।
২৮শে মার্চ রাতে ইপিআর ক্যাম্পের বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে প্রথমে সব অস্ত্র দখল করেন। এসব অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা ক্যাম্পের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত ওয়াপদা মেকানিক্যল ওয়ার্কশপে অবস্থান নেন। তখনো ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থান নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও সেকেন্ড-ইন- কমান্ড ক্যাপ্টেন নাবিদ আলমসহ বেশকিছু অবাঙালি পাকিস্তানি সৈনিক। তারা ক্যাম্পের ভেতরের বিভিন্ন বাসভবনে অবস্থান নিয়ে গুলি চালাতে থাকে। বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিকদের পক্ষ থেকেও পাল্টা গুলি চালানো হয়। কিন্তু ভবনের ভেতরে ছিল বলে বাইরে থেকে করা গুলিতে তারা তেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। ২৯শে মার্চ সারাদিন পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙালিদের গুলি বিনিময় হয়। আগের রাতে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন নাবিদ আলম ও তার স্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন নাজির আহমদ পালিয়ে যায়। তারা পায়ে হেঁটে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার পথে পরদিন সকালে খোচাবাড়িতে জনতার হাতে ধরা পড়ে। অন্য একজন অবাঙালি সৈনিকসহ তারা সবাই বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে নিহত হয়। ৩০শে মার্চ এক অভিযানে মেজর মোহাম্মদ হোসেন ও তার স্ত্রী প্রাণ হারায়। এর মাধ্যমে ক্যাম্প সম্পূর্ণভাবে বাঙালিদের দখলে আসে। তবে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করে ক্যাম্পের ওপর বাঙালিদের দখল প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ৩ জন বাঙালি ইপিআর সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়। অবাঙালি অধ্যুষিত সৈয়দপুর এবং সেখানে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট তখন পাকিস্তানিদের দখলে ছিল। প্রচুর অস্ত্র ও গোলা-বারুদ ছিল সেখানে। সে তুলনায় ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে খুবই অল্প অস্ত্র ও গোলা-বারুদ ছিল। কোনো ভারী অস্ত্র ছিল না। তবুও একেবারে সৈয়দপুরের কাছে প্রতিরোধব্যূহ তৈরি করে বাঙালি ইপিআর বিদ্রোহীরা পাকবাহিনীকে বেশ কয়েকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। ১৪ই এপ্রিল পাকসেনারা আধুনিক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে ভাতগাঁ ব্রিজের কাছে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এক সময় বাধ্য হয়ে তাঁদের পিছু হটতে হয়। অবশেষে পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল ঠাকুরগাঁও-এ অনুপ্রবেশ করে। ডাকবাংলো ও ইপিআর ক্যাম্পে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। আরসিও (উন্নয়ন) অফিসে আলবদরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। এসব ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। থানার অন্য কয়েকটি স্থানে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্যাম্প ও ঘাঁটি ছিল।
ঠাকুরগাঁও-এ পাকবাহিনীকে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ- ও ইসলামী ছাত্র সংঘ- সক্রিয় সহযোগিতা করে। এখানে পাকবাহিনীর প্রধান সহযোগীদের মধ্যে ছিল— তমিজউদ্দিন আহম্মদ (জামায়াতে ইসলামীর নেতা, ঠাকুরগাঁও শহর), রসিদুল ইসলাম (মুসলিম লীগের নেতা, ঠাকুরগাঁও শহর), ওমর আলি (মুসলিম লীগের নেতা, নর্থ সার্কুলার রোড, ঠাকুরগাঁও শহর), মশির উদ্দিন আহম্মদ মোক্তার (ঠাকুরগাঁও শহর), কালু চৌধুরী (জামায়েত ইসলামীর নেতা, ঠাকুরগাঁও), শামসুল হক (মুসলিম লীগের নেতা, ঠাকুরগাঁও), আব্বাস আলী (মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কর্মী, ঠাকুরগাঁও), মফিজুল হক তারা মিঞা (শুখানপুখরি), ড. সাইফুর রহমান (জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য, গড়েয়া বাজার), ডা. ইসরাফিল (হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা, গড়েয়া বাজার), ইমামুল হক চৌধুরী মঙ্গলু (জমায়াতে ইসলামীর নেতা), আজিজুল হক চৌধুরী (মুসলিম লীগের নেতা, বালিয়া) প্রমুখ।
তমিজউদ্দিন আহম্মদ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা দান ও হত্যা-নির্যাতন চালানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তার ইঙ্গিতে পাকবাহিনী এখানে অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। রসিদুল ইসলাম শান্তি কমিটি গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিল। পাকবাহিনীর সহযোগীদের মধ্যে ওমর আলির ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। মশির উদ্দিন আহম্মদ মোক্তার কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে সে নানা দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কালু চৌধুরী ঠাকুরগাঁও-এর সবচেয়ে নৃশংস জাঠিভাঙ্গা গণহত্যায় প্ৰত্যক্ষ মদদ দেয়। এখানে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন। শামসুল হক ইসলাম নগর গণহত্যার কুখ্যাত সহযোগী ছিল। তার দেয়া খবরের ভিত্তিতে পাকবাহিনী ৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে আব্বাস আলীর বিশেষ ভূমিকা ছিল। সে সব সময় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাত। মফিজুল হক তারা মিঞাও পাকবাহিনীর জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার অন্যতম সহযোগী ছিল। সে জাঠিভাঙ্গায় শান্তি কমিটি গঠন করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন একত্রিত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে যাওয়ার সময় সে তার সহযোগীদের নিয়ে তাদের আটক করে এবং সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে খবর দেয়। সে পাকবাহিনীর কুখ্যাত দোসর হিসেবে পরিচিত ছিল। ড. সাইফুর রহমান পাকবাহিনীর একজন কুখ্যাত সহযোগী ছিল। সে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সম্পর্কে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে খবর দিত। হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করত। ডা. ইসরাফিল গড়েয়া অঞ্চলে সাধারণ মানুষকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তার কারণে বেশকিছু মানুষকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইমামুল হক চৌধুরী মঙ্গলু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর লুণ্ঠনকারী ছিল। সে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আজিজুল হক চৌধুরী জাঠিভাঙ্গা হত্যাযজ্ঞের অন্যতম মদদদানকারী। সে সেনাবাহিনীকে নিয়ে সেখানে যায় এবং নৃশংস এ গণহত্যা সংগঠনে সহযোগিতা করে।
পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করে আরো যারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তারা হলো- সালাম সরকার (লাউথুতি), বাহার সরকার (জাঠিভাঙ্গা), তবি সরকার (জাঠিভাঙ্গা), মজিবর মোল্লা (পূর্ব শুখানপুখরী), সইমুদ্দিন (পূর্ব শুখানপুখরী), রফিকুল ইসলাম (সাংবাদিক ও আলবদর কমান্ডার), আব্দুল গফুর চেয়ারম্যান, তাজু খান, আব্দুল আজিজ মোক্তার প্রমুখ।
পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল ঠাকুরগাঁও অনুপ্রবেশ করেই নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। প্রথমে তারা রাস্তায় যাকে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। প্রাথমিক তাণ্ডব শেষে তারা স্থানীয় বিহারি ও বাঙালি দালালদের সহায়তায় পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শান্তি কমিটি গঠনের পর তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের প্ররোচনায় বেশকিছু গণহত্যা চালায়। তারা লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনও করে।
পাকবাহিনী ২৩শে এপ্রিল ঠাকুরগাঁও-এর শুখানপুখরী ইউনিয়নের জাঠিভাঙ্গায় এক ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। বর্বর ও নৃশংস এ গণহত্যায় প্রায় ৩ হাজার নারী-পুরুষ নিহত হয়। এখানে কয়েকশ নারী নির্যাতিত হন। জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা- শুধু ঠাকুরগাঁও-এ নয়, সমগ্র দেশের মধ্যে একটি বৃহৎ গণহত্যা। এ গণহত্যায় যারা পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রত্যক্ষ মদদ যুগিয়েছিল এবং হত্যায় অংশ নিয়েছিল, সেই মানবতাবিরোধীদের আজো আইনের আওতায় আনা হয়নি। তখন ঠাকুরগাঁও শহর টাঙ্গন নদের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। টাঙ্গন নদের পশ্চিম প্রান্তে পুরাতন লোহার ব্রিজ সংলগ্ন স্থানটি নির্জন এবং জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। পাকবাহিনী যাদের ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্পে ধরে আনত, তাদের এ স্থানে হত্যা করে মাটিচাপা দিত, যা লোহার ব্রিজ বধ্যভূমি- নামে পরিচিত। এজন্য স্থানটি সকলের কাছে ভীষণ আতঙ্কের ছিল। গণহত্যার এক অভিশপ্ত স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল এটি। ২৪শে মে এখানে গুলি করে ১৫ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। এটি টাঙ্গন নদের পাড় গণহত্যা নামে পরিচিত।
ফারাবাড়ি ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি নিভৃত পল্লী। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এটি ছিল একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা। বিচ্ছিন্ন বলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ই মে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা এ গ্রামে হামলা চালায়। তারা গ্রামের ১৮ জন নিরীহ লোককে গুলি করে হত্যা করে সবার মৃতদেহ একটি কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়। ফারাবাড়ি গণহত্যা-র স্থলে একটি গণকবর রয়েছে, ফারাবাড়ি গণকবর নামে পরিচিত।
ঠাকুরগাঁও-এর রুহিয়া রামনাথ হাটে ফজলুল করিম এমপিএ- র বড়ভাই নূরুল ইসলামের বাড়ি ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা ঠাকুরগাঁও-এ অনুপ্রবেশের পর এ বাড়ির সবাই অন্যত্র চলে যায়। পরিত্যক্ত বাড়িটিতে পাকহানাদাররা আস্তানা গাড়ে। এখান থেকে তারা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালাত। ৮ই আগস্ট তারা নিকটবর্তী কানিকশালগাঁ থেকে ৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে রামনাথ হাটের আস্তানায় নিয়ে আসে। ১০ই আগস্ট পর্যন্ত এখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে এখানেই মাটিচাপা দেয়। এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম আবুল, তাঁর আত্মীয় আজিমউদ্দীন মো. বেলাল (বেলু), মো. জালাল, মো. রেজাউল, দেলোয়ার ও অপর একজন। এরা সবাই ফজলুল করিম এমপিএ-র আত্মীয় ছিলেন বলে নির্মম হত্যার শিকার হন। এলাকার কিছু রাজাকার তাঁদের পরিচয় পাকবাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল 1 বর্তমান পুলিশ লাইনের পূর্বপাশে গড়েয়া রোড সংলগ্ন স্থানে পাকবাহিনী ৬ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঠাকুরগাঁও-এ অনুপ্রবেশের পর শহর একেবারে জনহীন ছিল বলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে যেখানে মানুষের সন্ধান পেয়েছে সেখানেই তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। গড়েয়া সড়ক সংলগ্ন স্থানটিতে তখন বেশ কয়েকটি পরিবারের বসতি ছিল। এখানে একটি মাদ্রাসা ছিল। এপ্রিলের শেষদিকে একদিন পাকবাহিনী এখানে এসে = লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে সমিরউদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, আব্দুস সামাদ, শামসুল ইসলাম ও আমিনুল ইসলামকে হত্যা করে। এ স্থানে কয়েকটি জোড়া কবর রয়েছে।
পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে ২ জনকে হত্যা করে। তাদের একজন গার্ড জহুর হোসেন এবং অন্যজন ইলেক্ট্রিশিয়ান আসগর আলী। সুগার মিলের মূল ফটকের বামপাশে তাদের কবর রয়েছে।
ওয়াপদার মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে পাকবাহিনী অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর এখানে মাটি খুঁড়ে বেশকিছু মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।
পাকবাহিনী গড়েয়া বাজার সংলগ্ন সিন্দিরপিন্দির নাকম স্থানে ৩ জনকে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে সমরেন্দ্র নাথ দাস চৌধুরীকে পুরাতন গড়েয়া বাজারের বাসা থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ঠাকুরগাঁও-এ হত্যা ও নির্যাতনের যে পৈশাচিকতা হানাদার পকিস্তানি বাহিনী চালিয়েছিল, তাতে মানুষকে তারা শুধু গুলি করে কিংবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, জীবন্ত অসহায় মানুষকে হিংস্র ও ক্ষুধার্ত বাঘ দিয়ে খাওয়ানোও হয়। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর ৩টি প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। সেগুলোর একটি ছিল ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স। এখানে বাঘের খাঁচায় মানুষ হত্যা করা হতো। এ কেন্দ্রে লোহার গ্রিল দ্বারা নির্মিত একটি বাঘের খাঁচা ছিল। এতে দুটি পূর্ণবয়স্ক হিংস্র চিতাবাঘ ও দুটি শাবক ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে প্রথমে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। পরে গুলি করে হত্যা করা হতো। আবার অনেককে বাঘের খাঁচায় ফেলে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো হতো। জীবন্ত মানুষ হতো হিংস্র বাঘের খাবার। কমপক্ষে ৫০ জন মানুষকে এভাবে খাঁচায় ঢুকিয়ে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো হয়। এ বাঘের খাঁচা থেকে বিস্ময়করভাবে বেঁচে আসা একজন হলেন শফিকুল আলম চৌধুরী (পিতা সফিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বুয়াগ্রাম, পাঁচপীর, বোদা)। স্থানীয় রাজাকারদের সাহায়তায় এখানে অনেক নারীকেও ধরে আনা হয়েছিল। ধর্ষণের পর তাদের অনেককে হত্যা করা হয়। এসব কাজে স্থানীয় বিহারিরা পাকবাহিনীকে বিশেষ সহায়তা প্রদান করে।
ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সের বাঘের খাঁচায় বোদা থেকে ধরে আনা শফিকুল আলম চৌধুরীকে ৬ বার ঢোকানো হয়েছিল। ৭ই মার্চ থেকে পঞ্চগড় জেলার বোদা থানায়ও অন্যান্য স্থানের মতো মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শফিকুল আলম চৌধুরী বোদা থানার পাঁচপীর, সাকোয়া, মাড়েয়া এবং দেবীগঞ্জ থানার শালডাহঙ্গা ও পামুলী ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। দীর্ঘ ও সুঠাম দেহের অধিকারী শফিকুল আলম চৌধুরী এ অঞ্চলের অত্যন্ত প্রিয়মুখ ছিলেন। তিনি ঠাকুরগাঁও কলেজ ছাত্র সংসদে দুবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তুখোড় এ ছাত্রনেতা মার্চে প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর এজন্য তাঁকে ১লা সেপ্টেম্বর মাড়েয়ার মন্টু চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছ থেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাঁকে নয়াদিঘি ক্যাম্প, বোদা থানা ও বোদা হাইস্কুলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর তাঁকে ভয়াবহ নির্যাতনকেন্দ্র ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে আনা হয়। এখানে তাঁর ওপর চরম শারীরিক নির্যাতন চলে। বাঘ দিয়ে খাইয়ে ফেলার জন্য ঢুকিয়ে দেয়া হয় বাঘের খাঁচায়। খাঁচায় তখন দুটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ ও দুটি শাবক ছিল। একটি বাঘ পাশে আসতেই তিনি ভয়ে চোখ বন্ধ করেন। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখতে পান বাঘটি অন্যপ্রান্তে গিয়ে বসে পড়েছে। বাঘটি তাঁকে আক্রমণ করেনি। এ দৃশ্য দেখে একজন সৈনিক খাঁচার মাঝখানের পার্টিশন বন্ধ করে দেয়। পরদিন খাঁচা থেকে বের করে পাকিস্তানি সেনারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁর ওপর নানা শারীরিক নির্যাতন চালায়। এভাবে তাঁকে বারবার খাঁচা থেকে বের করে এনে নির্যাতন করে আবার খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বাঘ তাঁকে স্পর্শ করেনি। ডিসেম্বরের শুরুতে পাকবাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ যখন তীব্র হতে থাকে, তখন সফিকুর আলম চৌধুরীকে ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স থেকে ঠাকুরাও থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আটক থাকা অবস্থায় ঠাকুরগাঁওয়ের পতন যখন আসন্ন, তখন থানার দারোগাসহ সব পুলিশ পালিয়ে গেলে তাঁর জীবন রক্ষা পায়।
ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ থানার কোসারাগীগঞ্জ ইউনিয়নের কোসাগুলপাড়া গ্রামের যুবক সালাহউদ্দিন (পিতা মোহাম্মদ আলী শাহ) দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। অসীম সাহসী এ যুবক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। যুদ্ধের সময় সালাহউদ্দিন খবর পান যে, রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। ১০ই নভেম্বর গভীর রাতে ক্যাম্পের সহযোদ্ধাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে পায়ে হেঁটে ভোরে তিনি নিজের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেন। তাঁর বাড়ি আসার খবর দ্রুত ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে চলে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে তাঁকে বাড়ি থেকে আটক করে। ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। বুটের লাথি ও চাবুকের ঘায়ে তাঁর সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে। হায়েনারা তাঁর কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ও যুদ্ধ বিষয়ক তথ্যাদি জানতে চায়। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের কাছে কিছুই বলেননি। কথা বের করার জন্য ভয় দেখাতে তাঁরই সামনে গুলি করে মুক্তিযোদ্ধা সেলিমকে তারা হত্যা করে। কিন্তু তবুও তিনি অনড়। এরপর তারা সালাহউদ্দিনের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলে। এরপরও পশুদের নারকীয় তাণ্ডব থামেনি। তারা আরো উন্মত্ত হয়ে সালাহউদ্দিনের কাছে নানা তথ্য জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু সালাহউদ্দিন নির্বিকার থাকায় পরদিন ১২ই নভেম্বর সকাল ১১টায় হানাদাররা তাঁকে নিয়ে যায় বাঘের খাঁচার সামনে। খালি গায়ে ফুলপ্যান্ট পরা পেছনে পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত সালাহউদ্দিনকে যখন সেখানে আনা হয়, তখন বাঘের খাঁচার বাইরে জড়ো হয়েছিল রাজাকার আর শান্তি কমিটির লোকজন। পাকিস্তানি মেজর জামান বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সালাহউদ্দিনকে কোনো তথ্য বা খবর দেবে কি-না শেষবারের মতো তা জানতে চায়। কিন্তু এ বীর যুবক মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বিচলিত হননি। নির্বিকার নিরুত্তর থেকে জানিয়ে দেন তাদের যা খুশি তা করতে। ক্রোধে ফেটে পড়ে মেজর মাহমুদ হাসান বেগ। সে হুকুম দেয়া মাত্র কয়েকজন পাকসেনা পেছনে দুহাত বাঁধা অবস্থায় সালাহউদ্দিনকে বাঘের খাঁচার মধ্যে ছুঁড়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি হিংস্র চিতাবাঘ সালাহউদ্দিনের ওপর থাবা বসিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ক্ষীণ আর্তনাদ ভেসে আসে। তারপর সব শেষ হয়ে যায়। আত্মদানে মহিমান্বিত হয় একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন।
ঠাকুরগাও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স নির্যাতনকেন্দ্রে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র সিরাজদ্দৌলা (পিতা পিয়ার আলী, ঠাকুরগাঁও শহর) অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং চাকরি শেষে অবসর জীবন যাপন করছেন। এদিকে ঠাকুরগাঁও রোড এলাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটিতেও অনেক নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়। আরসিও (উন্নয়ন) অফিস যেটি এখন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা অফিস, সেখানে তখন আলবদর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। এখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য নেয়ার চেষ্টা হতো।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার একটি উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমি হচ্ছে —টাঙ্গন নদের পাড় লোহার ব্রিজ বধ্যভূমি। তখন এ স্থান জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে গুলি করে হত্যা করত। তারপর সকল লাশ মাটিচাপা দিত। ২৪শে মে এখানে একসঙ্গে ১৫ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অন্য সময় আরো প্রায় ৩০ জনকে হত্যা করা হয়। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ফারাবাড়ি গণকবর। ১৫ই মে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানে ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে। হত্যার পর লাশগুলো একটি কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়। পরে হানাদার সৈন্যরা চলে গেলে নিহতদের স্বজনেরা মাটি কেটে কুয়োটি ভরাট করে দেয়। এটি এখন একটি গণকবর হিসেবে পরিচিত
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি কোনো যুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাভিযান শুরু হলে পাকবাহিনী এখান থেকে আগেই পালিয়ে যায়। ৩রা ডিসেম্বর ঠাকুরগাওঁ সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন মো. সইফদ্দীন (পিতা অশরউদ্দীন, দেউগাঁও), মনছুর আলী (পিতা তারাবউদ্দীন, সালন্দর), মো. খোরশেদ আলম (পিতা খজমত আলী, সালন্দর), হাফিজউদ্দীন (পিতা পশের আলী, ডোডাপাড়া), ওবায়দুল হক (পিতা মো. নূরুল হক, জগন্নাথপুর), আব্দুর রশীদ (পিতা কফিলউদ্দীন, হাজিপাড়া, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা), খলিলুর রহমান (পিতা মো, দবিরউদ্দীন, ভেলাজান, চিলারং), মো. শামসুল হক (পিতা আসির উদ্দীন আহাম্মদ, কুজিশহর, রুহিয়া), নেজামউদ্দীন (পিতা কেমাজউদ্দীন, মুজাবর্ণী, দেবীপুর), মো. আ. রশিদ (পিতা মো. আমিরউদ্দীন, সালন্দর), দেবেশ (পিতা শিব প্রসাদ, মলানী), শেখ মো. শহর আলী (পিতা শেখ নওয়াব আলী, সিরাজদ্দৌলা রোড, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা) ও সালাহউদ্দিন (কোসালপাড়া, ইউনিয়ন কোসারাগীগঞ্জ, থানা পীরগঞ্জ)। বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা নির্মম নির্যাতনের পর ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করে বাঘ দিয়ে খাইয়ে হত্যা করে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নায়েব সুবেদার নাজিম উদ্দীন, বীর বিক্রম (পিতা আব্দুর রহিম, হাজিপাড়া, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা), সুবেদার আহাম্মদ হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা মৌলভী আব্দুল মজিদ, নিশ্চিন্তপুর, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা) ও সুবেদার মো. আবুল খায়ের, বীর প্রতীক (পিতা আলী আহাম্মদ, নিশ্চিন্তপুর, ঠাকুরগাঁও পৌরসভা)।
ঠাকুরগাঁও সদরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক রয়েছে। সদর উপজেলার ইএসডিও চত্বরে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ শিরোনামে একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। ঠাকুরগাঁও শহরের টাঙ্গন নদ সংলগ্ন এলাকায় ‘অপরাজেয় ৭১’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ঠাকুরগাঁও-এর প্রথম শহীদ মোহাম্মদ আলীর নামে শহরের একটি প্রধান সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদের মিলনায়তনের সামনে ‘সূর্য সন্তান’ শিরোনামে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরাল স্থাপিত হয়েছে। শহরের পুলিশ লাইনের গড়েয়া রোড সংলগ্ন স্থানে কয়েকটি জোড়াকবর রয়েছে, যা একাত্তরের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি বহন করছে। [মনতোষ কুমার দে]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড