ডাইনছড়ি প্রতিরোধযুদ্ধ (মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি)
ডাইনছড়ি প্রতিরোধযুদ্ধ (মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি) সংঘটিত হয় ২৩ ও ২৪শে সেপ্টেম্বর। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ও সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী। যুদ্ধে ১০-১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয় দিন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলে পাকিস্তানি হানাদাররা স্থানীয়দের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সেপ্টেম্বরের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ডাইনছড়িতে একটি ঘাঁটি করেন। তাঁরা ছিলেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ও রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরার নেতৃত্বে রামগড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা দল। সাবরুম থেকে হরিণা ক্যাম্প এবং এ ক্যাম্পের পর থেকে রানীরহাট, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট এবং অন্যদিকে ময়ুরখীল পর্যন্ত এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। চট্টগ্রাম থেকে যত লোক ভারতে যেত আর যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারত থেকে আসতেন তারা সকলেই এ পথ ব্যবহার করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা ডাইনছড়িতে রামগড় হেডম্যানের জামাতা মমকান্ত চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা, প্রিয়জ্যোতি ত্রিপুরা, বাবুল মজুমদার, কালা চাঁদ দেববর্মণ, সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, সন্তোষ, ধীমান বড়ুয়া, রণজিৎ, নীলকান্ত, ভুবন মোহন ত্রিপুরাসহ তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন ৩২ জন। এ দলে সেনাবাহিনী বা পুলিশ-ইপিআর- এর কেউ ছিলেন না।
পাশাপাশি তিনটি পাহাড়। তিন পাহাড়ে ভাগ হয়ে থাকতেন মুক্তিযোদ্ধারা। মমকান্তের বাড়িতে কিছু, পাশের দুই গ্রামেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মোটামুটি কাছাকাছি ছিলেন তাঁরা সকলে। সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মমকান্তের বাড়িতে। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরাসহ অন্যরা ছিলেন পাশের দুই পাহাড়ের বাড়িতে। সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ দুপুর বেলা মুক্তিযোদ্ধাদের গোয়েন্দা মমকান্ত এসে জানান, পাটনাতে মিজোবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী। বেশকিছু সদস্য এসেছে। তারা সংখ্যায় ৭০-৮০ জনের মতো হবে।
শত্রুপক্ষ পাটনা থেকে ডাউনছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ডাইনছড়ি এবং বাটনতলী পাশাপাশি এলাকা হওয়ায় হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা গেরিলা আক্রমণের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন। ডাইনছড়িতে ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা রেখে বাকি সবাই এগিয়ে যান। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুর্ধর্ষ গেরিলাযোদ্ধাদের তৈরি হতে নির্দেশ দেন কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। সঙ্গে নেন ১টি এলএমজি, ১০টি এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড ও গুলি এবং নিজের এসএমজি। উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা প্ৰায় তিন কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে ডাইনছড়ির সেম্পুপাড়ায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে জলবেষ্টিত বড় একটি টিলায় এসে লুকিয়ে শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ও তাঁর সঙ্গীরা। এ টিলার সঙ্গে পায়ে হাঁটার ত্রিমুখী সংযোগ পথ রয়েছে উপজাতীয়দের গ্রাম, মানিকছড়ি থানা ও মং রাজবাড়ির। মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা, পাকিস্তানি বাহিনী পাহাড়ি গ্রাম থেকে এ টিলাপথেই রাজবাড়ি কিংবা থানা অভিমুখে যাবে। অতএব এ সুযোগ সম্পুর্ণ কাজে লাগাতে হবে।
অপেক্ষার পালা যেন শেষই হতে চায় না। বারবার রেকি শেষে পাহাড়ি পথে ক্রলিং করে পজিশন নেন মুক্তিযোদ্ধারা। মিজো ও পাকিস্তানিরা সেখানে অবস্থান না করে ডাইনছড়ির দিকে এগোতে থাকে। বড়-বড় গাছ ছিল পথে-পথে। মাঝপথে একটি স্কুল সেম্পুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি ছিল পাহাড়ের ওপর। পাশেই ধানক্ষেত। বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা দেখেন পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০-৭০ জনের একটি দল জঙ্গল অতিক্রম করে ধানক্ষেত দিয়ে এগিয়ে আসছে। ঐ বাহিনীর কমান্ডার ঘোড়ার পিঠে চড়া। এ দৃশ্য দেখে টিলার পাদদেশের বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নেয়া গেরিলাযোদ্ধারা কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষায় তখন। ৫০ গজ সীমানার মধ্যে আসামাত্রই কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার অটোমেটিক এসএমজি গর্জে ওঠে। মুহূর্তেই সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ছত্রভঙ্গ পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে ভারী অস্ত্র থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি। ইতোমধ্যে ঘোড়ায় চড়া পাকিস্তানি কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চারদিকে তখন আর্তচিৎকার। এর মধ্যে হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা এসে পড়ে কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার সামনে। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। জায়গাটি স্যাঁতসেঁতে হওয়ায় গোলাটির বিস্ফোরণ ঘটেনি। তবে চারদিকে তখন শুধু বিস্ফোরণের শব্দ। দুই থেকে তিন ঘণ্টার মতো যুদ্ধ চলে। সহকারী কমান্ডার সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী ১০-১২ জনকে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ১০-১২ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি।
এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানিরা অবিরাম গুলি ছুড়তেই থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর শত্রুরা মর্টার শেলিং শুরু করে। মর্টার শেলিংয়ের মধ্যে টিকে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তাঁরা আস্তে-আস্তে পিছু হটতে থাকেন। অপরদিকে পাকিস্তানিরা শেলিং করতে-করতে গুইমারার দিকে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এক অংশ তাঁদের অবস্থানের দিকে ফিরে যান। বাকিরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি ভারতে চলে যান।
যুদ্ধের পর ডাইনছড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। লোকজন সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, বাবুল মজুমদার, কালা চাঁদ, রণজিৎসহ ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ডাইনছড়িতে অবস্থান করছিলেন।
ডাইনছড়িতে তখন ভুতুড়ে অবস্থা। শত্রুবাহিনী পুনরায় আসে কি-না এজন্য মুক্তিযোদ্ধারা সারারাত গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের ঘুম ও খাওয়া-দাওয়া ছিল না। পরের দিন সকাল ৯/১০টার দিকে একজন পাহাড়ি লোক এসে জানায় যে, শত্রুরা আসছে। সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তীই দলের কমান্ডারের দায়িত্ব নেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম ও তাঁদের আস্ত্রশস্ত্র সীমিত থাকায় তাঁরা ডাইনছড়ি থেকে বেশকিছুটা দূরে সরে যান। গভীর জঙ্গলে গিয়ে তাঁরা অবস্থান নেন। পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে বড় একটি গাছে একজন মুক্তিযোদ্ধা উঠে পাকিস্তানিদের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকেন। ১০/১১টার দিকে দেখা যায় পাকিস্তানিরা পাহাড় বেয়ে নেমে ধানক্ষেতে জড়ো হচ্ছে। খাকি পোষাক পড়া পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখ্যায় ছিল অনেক। দুদিকের ধানক্ষেত থেকেই পাকিস্তানি ও মিজোরা আসছিল। কিছুক্ষণ পর তারা ডাইনছড়িতে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল সেদিকে আসে। ঐ স্থানে কিছু মাইন জড়ো করা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলো নিয়ে যেতে পারেননি। পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে মাইনগুলো দেখে নিশ্চিত হয় যে, এখানেই মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। তারা বাড়িঘরে ঢুকে যা পেয়েছে নিয়ে নেয়। সেখানে ৮-১০টি বাড়ি ছিল। সব বাড়িঘর তারা জ্বালিয়ে দেয়। দুপুরের দিকে পাকিস্তানিরা চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারাও গভীর জঙ্গলে চলে যান। এক দিন এক রাত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে ছিলেন। তাঁদের না খেয়েই সমস্তটা সময় থাকতে হয়। এরপর রাতের বেলা যে স্থানে যুদ্ধ হয়েছিল, সেখান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে চলে যান। কোনো মুক্তিযোদ্ধা আহত কিংবা নিহত হননি। [ইয়াসিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড