You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা

টাঙ্গাইল এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা ছিল। পরে স্বতন্ত্র জেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের অবদান অবিস্মরণীয়। ঐতিহাসিক অনেক রাজনৈতিক ঘটনা ও প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধারা গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন।
অবিভক্ত বাংলার বহু রাজনৈতিক ঘটনা ও আন্দোলনের জন্মভূমি টাঙ্গাইল। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী – ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক দুজনেই ছিলেন টাঙ্গাইলের সন্তান। আওয়ামী লীগের প্রথম মেনিফেস্টো রচনায় শামসুল হকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা- আন্দোলন-এ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, আবদুল মান্নান, তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে টাঙ্গাইলের ছাত্রসমাজ বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে প্রতিবাদ সভা করে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ছাত্রসভায় টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। এ-সময় সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। টাঙ্গাইলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রায়ই মিছিল ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হতো। টাঙ্গাইল শহরের ছাত্ররা বিশাল মিছিল ও শোভাযাত্রা বের করে শহর প্রদিক্ষণ করত। ১৭ই সেপ্টেম্বর সরকারের নির্যাতন ও কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের ব্যাপারে অনমনীয় মনোভাবের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের ছাত্রসমাজ একটি বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি করটিয়া সা’দত কলেজ থেকে টাঙ্গাইল শহরে আসে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন ফজলুর রহমান খান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু, গোলাম সরোয়ার প্রমুখ। ঊষা সাহার নেতৃত্বে এদিন কুমুদিনী কলেজ থেকে ছাত্রীদের একটি মিছিল বের হয়। সে মিছিলে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে সরকার হুলিয়া জারি করে। সৈয়দ আবদুল মতিনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯৬৪ সালের ৩০শে মার্চ টাঙ্গাইলের ছাত্রসমাজ সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করে। এ-সময় টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক দমননীতির শিকার হন। ছাত্রনেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান খান ফারুক, ফজলুল করিম মিঠু, আতিকুর রহমান সালু ও এস এম রেজাকে করটিয়া কলেজ
থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর কিছুদিন পর ছাত্ররা শহরের সকল অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আইয়ুব খানের ছবি নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। টাঙ্গাইল শহরের নিরালার মোড়ে আইয়ুব খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এ ঘটনায় নেতৃত্বদানের জন্য ছাত্রনেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান খান ফারুক, বুলবুল খান মাহবুব, মওদুদ খান মজনু ও মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দুর্বার গণআন্দোলনে টাঙ্গাইলে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ছাত্রনেতারা হলেন- আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবু মোহাম্মদ এনয়েত করিম, আলমগীর খান মেনু, মোয়াজ্জেম হোসেন খান, আনোয়ার উল আলম শহীদ, কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম, আলী আজগর খান দাউদ, খন্দকার আবদুল বাতেন, আনোয়ার বক্স, শামীম আল মামুন, মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী, আফতাবউজ্জামান খান ফিরোজ, হামিদুল হক, বুলবুল খান মাহবুব প্রমুখ।
১৯৭০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে আওয়ামী লীগের এক নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্য টাঙ্গাইলবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে টাঙ্গাইলের সব আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
৭১-এর ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করলে ঐদিনই টাঙ্গাইল শহরে তীব্র প্রতিবাদ হয়। ছাত্রনেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্যারাডাইস পাড়ার লুৎফর রহমানের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের এক গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকে ‘জয় বাংলা বিপ্লবী বাহিনী’ গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সদস্যদের আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শপথবাক্য পাঠ করান। পরদিন থেকে কাগমারী এম এম আলী কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ দেন জয়নাল আবেদীন। এম এম আলী কলেজের অধ্যাপক আবদুল কাদের কলেজের ক্যাডেট কোরের ১৩০টি ডামি রাইফেল দিয়ে সহযোগিতা করেন। প্রত্যেক দিন ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলত। কয়েকদিন পর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কলেজ থেকে টাঙ্গাইল মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়। একদিকে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অন্যদিকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, সৈয়দ আবদুল মতিন, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, সোহরাওয়ার্দী, কাদের সিদ্দিকী প্রমুখের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা চলে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চ ভাষণ এর পর থেকে টাঙ্গাইল মিছিলের শহরে পরিণত হয়। সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মাঠে নেমে আসেন। ২৩শে মার্চ বিন্দুবাসিনী হাইস্কুলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও আলমগীর খান মেনু।
২৬শে মার্চ পূর্ব আদালত পাড়ার নূরুল ইসলাম এডভোকেটের বাসায় এক সর্বদলীয় সভা হয়। সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি হাইকমান্ড গঠিত হয়। এ কমান্ডের নাম দেয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ’। হাইকমান্ডের উপদেষ্টা ও চেয়ারম্যান ছিলেন যথাক্রমে খন্দকার আসাদুজ্জামান (পাকিস্তান সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব) ও বদিউজ্জামান খান এমপিএ। কমান্ডের আহ্বায়ক ও সর্বাধিনায়ক ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপিএ। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- আব্দুল মান্নান এমএনএ, শামছুর রহমান খান শাজাহান এমএনএ, ফজলুর রহমান খান ফারুক, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, মির্জা তোফাজ্জেল হোসেন মুকুল, হাবিবর রহমান খান (শ্রমিকনেতা), আলমগীর খান মেনু, কাদের সিদ্দিকী, আলী আজগর খান দাউদ, খন্দকার আব্দুল বাতেন, সৈয়দ আবদুল মতিন (শ্রমিকনেতা), নূরুল ইসলাম এডভোকেট, নঈম উদ্দিন মোক্তার, আল মুজাহিদী, আলী আকবর খান খোকা, বীরেন সাহা (ব্যবসায়ী), সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, পুলক সরকার, এন এ খান আজাদ, আবুল কালাম আজাদ, আবদুস সবুর খান প্রমুখ। হাইকমান্ডের সহযোগিতায় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে অবস্থানরত বাঙালি সেনা সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেন। এরপর সার্কিট হাউজ থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন বিকেলে জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে মেজর কে এম সফিউল্লাহ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বেশকিছু জওয়ান নিয়ে বেরিয়ে আসেন। তিনি টাঙ্গাইলের হাইকমান্ডেরর সঙ্গে বৈঠক করেন। ২৯শে মার্চ টাঙ্গাইল হাইকমান্ডের উপদেষ্টা খন্দকার আসাদুজ্জামানের সহযোগিতায় টাঙ্গাইল ট্রেজারি ভবনের মালখানা থেকে ৪৫০টি অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখলে আনা হয়। সেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ কাদের সিদ্দিকী ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় সংগঠকরা হলেন— আবদুল মান্নান এমএনএ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপিএ, খন্দকার আসাদুজ্জামান (যুগ্মসচিব), ফজলুর রহমান খান ফারুক এমপিএ, শামছুর রহমান খান শাজাহান এমএনএ, বদিউজ্জামান খান এমপিএ, আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম, আনোয়ার উল আলম শহীদ, মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল এমপিএ, হবিবুর রহমান খান, আলমগীর খান মেনু, কাদের সিদ্দিকী, আলী আজগর খান দাউদ, খন্দকার আবদুল বাতেন, নঈম উদ্দিন মোক্তার, সৈয়দ আবদুল মতিন, বীরেন সাহা, আল মুজাহিদী, নূরুল ইসলাম, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, পুলক সরকার, এন এ খান আজাদ, আবুল কালাম আজাদ, আলী আকবর খান, আবদুস সবুর খান প্রমুখ। হাইকমান্ডের সহযোগিতায় ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের বিভিন্ন স্থানে বড়বড় গাছ কেটে পাকিস্তানি বাহিনীর টাঙ্গাইল প্রবেশে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা হয়। ৩রা এপ্রিল মির্জাপুরের গোড়ান- সাটিয়াচড়াতে হাইকমান্ডের নির্দেশে ইপিআর ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার তৈরি করে প্রতিরোধের চেষ্টা চালান। গোড়ান-সাটিয়াচড়াতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইলে অনুপ্রবেশ করে।
৩রা এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী টাঙ্গাইলে অনুপ্রবেশ করে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ ও করটিয়া সা’দত কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকহানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দানে পাকিস্তানপন্থী দালালদের উদ্যোগে ৪ঠা এপ্রিল টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির চেয়ারম্যান ও আহ্বায়ক করা হয় যথাক্রমে হেকিম হাবিবুর রহমান ও প্রফেসর আবদুল খালেককে। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল বাছেত, ডা. এইচ আর খান, এমদাদ দারোগা, আব্দুল্লাহেল ওয়াসেক, বাঁকা মিয়া, খোকা (রাজাকার কমান্ডার) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষ ব্যক্তিরা হলো- মেহেদী খান পন্নী (করটিয়া), হেকিম হাবিবুর রহমান (সদর), আমিনুল ইসলাম খোকা (সদর), নায়েব আলী (সাকরাইল), আবদুল্লাহ (সাকরাইল), হারেস আলী (ডিডরাইটার), সোহরাব আলী (কাগমারী কলেজ), মির্জা ইসমাইল (দিঘুলিয়া), মিজানুর রহমান (সন্তোষ), অধ্যাপক আবদুল হাকিম (নেজামে ইসলামী), আফজাল চৌধুরী (সদর), সামাদ বিএসসি (টাঙ্গাইাল সদর), টিপু মির্জা (শিবনাথ স্কুল), সাইদ দারোগা (সদর), সিরাজ গুণ্ডা (বেতকা), মতি ড্রাইভার (সন্তোষ), বিজু মিয়া (টাঙ্গাইাল সদর), খন্দকার আবদুর রহিম (কাগমারী কলেজ), লেবু মিয়া (রওশন টকিজ), নবাব আলী মাস্টার (করটিয়া), আফাজ উদ্দিন (সাকরাইল), মতি চেয়ারম্যান (সন্তোষ), আইন উদ্দিন (সদর), ইসহাক আলী (সদর), আ ন ম শহিদুল্লাহ (বেতকা) প্রমুখ।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী – রাজাকার – ও দালালদের সহযোগিতায় টাঙ্গাইল শহরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। যেসব স্বাধীনতাবিরোধীর সহয়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তাদের মধ্যে বিজু মিয়া, হেকিম হাবিবুর রহমান, খালেক প্রফেসর, আশরাফ মির্জা, পটু হাফেজ, ভাদু দারোগা, সাইদ দারোগা ও বাঁকা মিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য। তারা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ-এর হাইকমান্ডের উপদেষ্টা খন্দকার আসাদুজ্জামান ও হাইকমান্ডের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খানের বাড়ি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
এপ্রিলে গোড়ান-সাটিয়াচড়ার প্রতিরোধব্যূহ ভেদ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল ৩রা এপ্রিল করটিয়া বাজারে এসে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়, যা করটিয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। করটিয়া গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন- সুকানি (করটিয়া বাজার), বিশ্বনাথ রুদ্রপাল ওরফে পাইক্যা রুদ্রপাল (পিতা শ্রীমন্ত রুদ্রপাল, কর্মকার পাড়া), মধুসূদন সাহা (পিতা নেধুলাল সাহা, করাতিপাড়া), ফণীন্দ্র মোহন সাহা (পিতা বিপিন বিহারী সাহা, করাতিপাড়া), হরিপদ সাহা (পিতা মতিলাল সাহা, করাতিপাড়া), কনজ কুমার সাহা রায় ওরফে লিটু (পিতা মণীন্দ্র মোহন সাহা রায়, করাতিপাড়া), নেধু চরণ পাল (করটিয়া বাজার), নগেন্দ্র মোহন পাল (পালপাড়া), জ্ঞানেন্দ্র মোহন পাল (পালপাড়া), লিচু মোহন পাল (পালপাড়া), রসিক কর্মকার (পালপাড়া), মফিল কারিগর (পিতা আব্বাস আলী কারিগর, কারিগর পাড়া), প্রাণেশ্বরী সাহা (স্বামী রাইমোহন সাহা, মধ্য সাহাপাড়া), হাছেন আলী শিকদার (পিতা আছর উদ্দিন শিকদার, গড়াসিন), সুরেশ চন্দ্র কর্মকার (করটিয়া), শাহাজাহানুর রহমান (করটিয়া), কলিম উদ্দিন (করটিয়া), সেফাত আলী (পিতা সবেদ আলী, করটিয়া), গিরিবালা কর্মকার (স্বামী কালাচাঁদ কর্মকার, করটিয়া), পূর্ণলতা কর্মকার (পিতা কালাচাঁদ কর্মকার, করটিয়া) ও কালাচাঁদ কর্মকার (পিতা যাদব চন্দ্র কর্মকার, করটিয়া)।
আলবদর বাহিনীর সহায়তায় তারাটিয়ার ভাতকুড়াতে এক হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হয়। ভাতকুড়া গণহত্যা নামে পরিচিত এ হত্যাকাণ্ডে ১৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। নিহতদের ভাতকুড়া গ্রামে গণকবর দেয়া হয়।
টাঙ্গাইলে বিভিন্ন সময়ে যারা শহীদ হন, তারা হলেন- বীরেশ গোবিন্দ মজুমদার (পিতা নিপেস গোবিন্দ মজুমদার, ঘারিন্দা), শম্ভু গোবিন্দ মজুমদার (পিতা বীরেশ গোবিন্দ মজুমদার, ঘারিন্দা), ভোলা রাজবংশী (ঘারিন্দা), প্রদীপ চন্দ্র বসাক (পিতা রাজবিহারী বসাক, ঘারিন্দা), আরফান আলী (পিতা তাজের বেপারী, চকদই), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা জয়েন উদ্দিন, চৌরা কবরা), চিত্তরঞ্জন সাহা (রাঘব করা), বসাক মিয়া (পিতা তোমেজ উদ্দিন, শিবপুর), জয়েন উদ্দিন (পিতা কমল সরকার, নন্দনবালা), সেকিম উদ্দিন (পিতা জসীম উদ্দিন, শিবপুর), বল্টু সাহা (পিতা মাখন লাল সাহা, শিবপুর) ও বিমল ভৌমিক (শিবপুর)।
টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের কোয়ার্টার্সগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হানাদাররা বিভিন্ন স্থান থেকে নিরপরাধ লোকদের এখানে আটক রেখে নির্যাতন ও হত্যা করত। টাঙ্গাইল ডিস্ট্রিক কোয়ার্টার্সে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে।
করটিয়া সা’দত কলেজে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ১৪০ জন রাজাকার এবং শতাধিক পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছিল। ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাদেরিয়া বাহিনী-র সর্বাধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী এ ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। তাঁর সঙ্গে মর্টার প্লাটুনে ছিলেন সামাদ গামা। মাঠের মাঝখান দিয়ে বেনু, ভোম্বল, দুর্মুজ খাঁ, জাহাঙ্গীর, আজহার, বাম দিক থেকে মান্নান, আব্দুল্লাহ, মালেক, মকবুল, কাশেম, তমছের আলী এবং রাস্তার ওপর দিয়ে ফজলুল হক, দুলাল, শামছু, বজলু, পিন্টু ও বাবলু গুলি ছুড়তে-ছুড়তে অগ্রসর হন। ক্যাম্পের কাছাকাছি যেতেই উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে গ্রামের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যায়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা শতাধিক রাজাকারকে আটক করেন। ১২০টি অস্ত্র ও প্রচুর গোলাবারুল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ- যুদ্ধের পর করটিয়া হানাদারমুক্ত হয়।
১০ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কোদালিয়া ও মিল্কভিটার পাশে অবস্থান নেন। পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইল জেলা সদরের পানির ট্যাংকের ওপর বালির বস্তা রেখে তার ওপর মর্টার বসিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল কোথা থেকে গুলি আসছে। কাদের সিদ্দিকী মিল্কভিটার পাশের দেয়ালের নিচে এবং তাঁর সহযোদ্ধারা ৮-১০ ফুট উঁচু রাস্তার আড়ালে অবস্থান নিয়েও শত্রুসেনার দৃষ্টির আড়াল হতে পারেননি। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সবুর খান প্রথম লক্ষ করেন পাকিস্তানি সেনারা কোথায় থেকে এমন অবিশ্রান্ত ধারায় গুলি করছে। হানাদারদের অবস্থান জানার পর তিনটি আরআর, থ্রি-ইঞ্চি- মর্টার, ৭টি ব্লান্ডার সাইট ও রকেট ল্যান্সারসহ কমান্ডার হাকিম মিল্কভিটার দেয়ালের নিচ থকে দেওলা হয়ে কোদালিয়ায় আসেন। কাদের সিদ্দিকী কমান্ডার হাকিমকে শত্রুদের অবস্থান দেখিয়ে দেন। এরপর তিনি কোদালিয়া গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে মর্টার বসিয়ে পাকসেনাদের পানির ট্যাংকের ওপর বসানো মর্টার লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। তাঁর মর্টারের গোলার আঘাতে বালির বস্তা উড়ে যায় এবং পাকিস্তানি সেনারা নিচে পড়ে যায়। কমান্ডার হাকিম পাকসেনাদের লক্ষ করে অবিশ্রান্ত গুলি ছুড়তে থাকেন। এ সময় ঘারিন্দা থেকে কমান্ডার লোকমান হোসেন তাঁর মর্টার প্লাটুন নিয়ে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। সবাই একত্রিত হওয়ার পর সন্ধ্যায় ডিস্ট্রিক গেটের সামনে এসে অবস্থান নেন। সেখানে পূর্বেই মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপ ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি সেনাকে আটক করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। জেলা সদরে তখন প্রায় ৩ শত হানাদার সৈন্য ছিল। ১১ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন মনোয়ারসহ সকল পাকিস্তানি সেনাসদস্য কাদের সিদ্দিকীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১১ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল সদর হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবুল কালাম আজাদ, বীর বিক্রম- (পিতা কাসেমউদ্দিন সরকার, পার দিঘুলিয়া), ফয়জুর রহমান ফুল, বীর প্রতীক- (পিতা হাজী মনসুর আহমদ, দিঘুলিয়া)।
টাঙ্গাইলের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আজাহার আলী সিদ্দিকী (পিতা ওয়াজেদ আলী, করটিয়া; ল্যান্স নায়েক), আবদুর সবুর মিয়া (পিতা মৌ. আবদুল আজিজ, কাতুলী; হাবিলদার), মিজানুর রহমান (পিতা আহমেদ হোসেন সিদ্দিকী, আশেকপুর; হাবিলদার), মোহাম্মদ শফিউদ্দিন (পিতা তারা মিয়া, দিঘুলিয়া, সিপাহি), আব্দুল লতিফ (পিতা শেখ বশির উদ্দিন, আদি টাঙ্গাইল; সিপাহি), এ রফিক মিয়া (টাঙ্গাইল; বিবি, এমই-১), শেখ সেলিম উদ্দিন (পিতা শেখ মিয়াচান, বিশ্বাসবেতকা; নায়েক), রইচ উদ্দিন (পিতা বাবর আলী সরকার, বেড়াডোমা; সিপাহি), বাকু (পিতা মৌ. সিরাজউদ্দিন আহমেদ, পারদিঘুলিয়া), মজিবর রহমান (পিতা গণি মিয়া, আদি টাঙ্গাইল), জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার (পিতা হাবিবুর রহমান তালুকদার, বেড়াডোমা), ইব্রাহীম খলিল (পিতা আশেক আলী, আকুরটাকুরপাড়া), অজিত কুমার চক্রবর্তী (পিতা অক্ষয় কুমার চক্রবর্তী, বিশ্বাসবেতকা), এস এম আ. লতিফ (পিতা আবদুল বছির, আদি টাঙ্গাইল), এস এম মোজাফ্ফর (পিতা এস এম আবদুল বাসেদ, সুরুজ), সেকান্দার আলী মিয়া (পিতা কোরবান আলী মিয়া, টেলি করটিয়া), সোহরাব আলী (পিতা দুইখা শেখ, পাইক মুরিল), ফজলুল হক (পিতা আহম্মদ আলী বেপারী, পারবহুলী), মির্জা সুলতান (পিতা মির্জা আ. হামিদ, উত্তর তারটিয়া), নূর মোহাম্মদ বেপারী (পিতা বাবর আলী বেপারী, কাশীনগর), মোজাম্মেল হোসেন (পিতা মৌ. নূর মোহাম্মদ, কোদালিয়া), আবদুল বাছেদ (পিতা মানিক মোল্লা, আলোকদিয়া), আব্দুল আজিজ (পিতা বছির উদ্দিন, খাকজানা), প্রফেসর হযরত আলী (পিতা আবদুল হাকিম সরকার, আকুরটাকুরপাড়া), ছাইদ মিয়া (পিতা রছুল মিয়া, ঝিনাই), সালাউদ্দিন (পিতা আইন উদ্দিন, আদি টাঙ্গাইল), আশান আলী (পিতা জমশের আলী সরকার, পার দিঘুলিয়া), মিজানুর রহমান (পিতা আলহাজ মনছুর রহমান, দিঘুলিয়া), সেফাদালী (পিতা ছবে শেখ, টেলি করটিয়া), আবুল কাশেম খান (পিতা আবু আহাম্মদ খান, ভাতকুড়া), মকিম উদ্দিন (পিতা জসিম উদ্দিন, রামদেবপুর) ও আবদুল হাই মিয়া (পিতা ছোহরাব আলী মিয়া, বরুহা)।
টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে যেসব প্রতিষ্ঠান ও স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, সেগুলো হলো- টাঙ্গাইল সদরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ (সন্তোষ), ভাসানী হল, শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব মহিলা কলেজ, শহীদ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইছাপুরী লজ; শহীদ জাহাঙ্গীর উচ্চ বিদ্যাল Savedডামা), শহীদ মিজান উচ্চ বিদ্যালয় (দিঘুলিয়া), শামসুল হক তোরণ (টাঙ্গাইল), জাহাঙ্গীর স্মৃতি সেবাশ্রম (টাঙ্গাইল) ও আবদুল মান্নান স্মরণি (নগর জলফৈ) ইত্যাদি। [ফাতেমা জোহরা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!