You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযোদ্ধা দল টি এম আলী বাহিনী (পটিয়া, চট্টগ্রাম)

টি এম আলী বাহিনী (পটিয়া, চট্টগ্রাম) চট্টগ্রাম এলাকার মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একটি মুক্তিযোদ্ধা দল। ২টি এম আলীর নেতৃত্বে এ বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামকে হানাদারমুক্ত করতে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া ও বোয়ালখালী অঞ্চলে অনেক অপারেশন ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে দলনেতা টি এম আলীসহ এ বাহিনীর অনেক সদস্য শহীদ হন।
টি এম আলী মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নন-কমিশন্ড অফিসার ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম এলাকার বিভিন্ন প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। প্রতিরোধ পর্যায়ের পর তিনি ভারতে যান। সেখান থেকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ফিরে এসে পার্বত্যাঞ্চল পটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেন। ভারত থেকে ফেরার সময় পথে রাঙ্গুনিয়ার ইফতেখার হোসেন আক্তারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সঙ্গে টি এম আলীর দেখা হয়। এ দল প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের দেমাগ্রীতে যাচ্ছিল। তিনি ইফতেখার হোসেন আক্তার ও তাঁর দলকে প্রশিক্ষণ প্রদানের আশ্বাস দিয়ে নিজ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে রাঙ্গুনিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া ইউনিয়নের চিপছড়ির দক্ষিণাংশের একটি খামারে, মধ্যাংশের এক হিন্দুবাড়িতে এবং চিপছড়ির উত্তরাংশে তাঁবু দিয়ে স্থাপিত ৩টি ক্যাম্প ছিল টি এম আলী ও তাঁর বাহিনীর। কালিছড়িতে আবদুল গণির খামারে বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিশ্রামস্থল ছিল। বাহিনী যখন রাঙ্গুনিয়ার পার্বত্যাঞ্চলে আসে, তখন এতে ৬ প্লাটুন সৈনিক ছিল। ৬ প্লাটুনের কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার সুজা, হাবিলদার মফিজ, হাবিলদার মালেক, হাবিলদার ইউসুফ, হাবিলদার ফজলুর রহমান ও হাবিলদার ছালামত উল্লাহ। এ বাহিনীর অন্য যেসব সদস্যের নাম পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন- হাবিলদার জাফর, সিপাহি মতলব, হাবিলদার আকতার, ল্যান্স নায়েক সামাদ, সিপাহি বজল, হাবিলদার মোজাফ্ফর, সিপাহি সোলায়মান, সিপাহি নাজির, নায়েক মুছা, সিপাহি আহমদ, হাবিলদার আবদুল হামিদ, সিপাহি মো. ইসমাঈল, সিপাহি মুজিবুর, সিপাহি আলমগীর, সিপাহি আছিয়ুর ও আবদুল খালেক।
টি এম আলী যখন চিপছড়িতে আসেন, তখন কমলাছড়িতে বান্দরবান আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি মোখলেসুর রহমানের একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। মোখলেসুর রহমান এ ক্যাম্পে ‘লাঠি আলম গ্রুপ’ নামে একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ সংগঠিত করেন। টি এম আলী তাঁর বাহিনীর ৪৫ জন সৈনিক নিয়ে কমলাছড়িতে মোখলেসুর রহমানের ক্যাম্পে গেলে লাঠি আলম গ্রুপ তাতে যোগ দেয়। লাঠি আলম গ্রুপটি এম আলী বাহিনীতে যুক্ত হওয়ার পূর্বে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে। তাঁরা প্রধানত অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাঙ্গুনিয়ার শরফভাটায় শান্তি কমিটি-র নেতা সালেহ আহমদের বাড়িসহ আরো কয়েকটি স্থানে অপারেশন পরিচালনা করেন। শান্তি কমিটির নেতা সালেহ আহমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপারেশনে সালেহ আহমদ গুরুতর আহত হয়ে পরে মারা যায়। লাঠি আলম গ্রুপের যেসব মুক্তিযোদ্ধা টি এম আলী বাহিনীতে যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— বাঘা (কমলাছড়ি, পদুয়া, রাঙ্গুনিয়া), আবদুল গণি, মনতাইর বাপ (এ নামে পরিচিত), বদন আলী (উত্তর খরনা, পটিয়া), আবদুল খালেক (পিতা জান বকসু, হাইদগাঁও, পটিয়া), নুরুল হক (বোয়ালখালী), মোস্তাক বিল্লা (সাতগাছিয়া দরবার শরীফ, হাইদগাঁও), কানুনবিল্লা (সাতগাছিয়া দরবার শরীফ, হাইদগাঁও), ইসহাক (পিতা খলিলুর রহমান, গোবিন্দারখীল, পটিয়া; সেনাসদস্য), মাকরান ইসহাক (পিতা আমজু মিয়া, হাইদগাঁও), মাস্টার নূর আহমদ (হাইদগাঁও), শাহ্ আলম (দক্ষিণ শ্রীমাই, পটিয়া), আবদুল নবী (দক্ষিণ শ্রীমাই, পটিয়া), আবু তাহের (পিতা ফজল আহমদ, উত্তর খরনা, পটিয়া), আবুল কালাম, আমির আলী মাস্টার ও ফারুক আহমদ।
টি এম আলী বাহিনী ও লাঠি আলম গ্রুপ একত্রিত হওয়ার পর হাবিলদার সুজা ও হাবিলদার মফিজ আলম গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের ১৮ দিন প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এরপর এ বাহিনী পটিয়া অপারেশন পরিচালনা করে। মোখলেসুর রহমানের সহযোগিতায় হাইদগাঁও ইউনিয়নের পাহাড়ি অঞ্চলে হাজির মাঠে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সাতগাছিয়া দরবার শরিফেও এ বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। টি এম আলী বাহিনী একক ও যৌথভাবে রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া ও বোয়ালখালী অঞ্চলে অনেক অপারেশন ও সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত করে। পটিয়া অপারেশন, রাঙ্গুনিয়া থানা অপারেশ, পটিয়া খরনা স্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, কর্ণফুলী নদীতে পণ্যবাহী বার্জ অপারেশন, পটিয়াস্থ খানমোহনা রেলস্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন, রাঙ্গুনিয়া কলেজ ও ইস্টার্ন কেমিক্যাল আর্মি ক্যাম্প অপারেশন, নাপিতপুকুরিয়া অপারেশন, দালাল আমিন শরীফের বিরুদ্ধে অপারেশন প্রভৃতি এ বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অপারেশন। পটিয়া অপারেশন সংঘটিত হয় ৫ ও ৬ই সেপ্টেম্বর। টি এম আলী বাহিনীর এ অপারেশনে ৬ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৮টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দখল করা হয়। পটিয়া খরনা স্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন পরিচালিত হয় সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। হাবিলদার সুজার নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর এবং সুলতান আহমদ কুসুমপুরী বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক যৌথভাবে পরিচালিত এ অপারেশনে ৯ জন রাজাকার নিহত হয়। এখান থেকে ১৮টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ১ পেটি গুলি (প্রায় ৫০০ রাউন্ড) উদ্ধার করা হয়। এ অপারেশনে টি এম আলী বাহিনীর সদস্য শাহ্ আলম গুলিবিদ্ধ হয়ে পরদিন দুপুরে মারা যান। পটিয়া খানমোহনা রেলস্টেশন রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনও সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পরিচালিত হয়। কমান্ডার সামশুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তাঁর গ্রুপের এবং টি এম আলী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য কর্তৃক যৌথভাবে সংঘটিত এ অপারেশনে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। ৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ৪ বেল্ট গুলি এখান থেকে দখল করা হয়। অক্টোবর মাসে টি এম আলী বাহিনী কর্তৃক এককভাবে নাপিতপুকুরিয়া অপারেশন পরিচালিত হয়। এতে ১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ৪০টি এলএমজি-এসএমজি-এলএলআর- স্টেনগান, ৬টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও ৩ পেটি গুলি উদ্ধার হয়। অক্টোবরের প্রথমদিকে টি এম আলী বাহিনী এককভাবে দালাল আমিন শরীফের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করে। পটিয়ার কচুয়াই ইউনিয়নের পারিগ্রামের মল্লাপাড়ার আমিন শরীফ পাকিস্তানিদের পটিয়া পিটিআই ক্যাম্পে নারী সরবরাহ করত। সেখানে ছাগল, মুরগি ইত্যাদি যোগান দেয়া হতো। এছাড়া রাজাকারদের নিয়ে সে মানুষের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করত। ফলে টি এম আলী বাহিনী তাকে হত্যা করতে অপারেশন পরিচালনা করে। আমিন শরীফ কমলমুন্সির হাটে পানের দোকান চালাত। মুক্তিযোদ্ধারা বিকেল ৪টায় হাটে এসে দোকানে অপারেশন করেন। এতে সে নিহত হয়। এ অপারেশনে লালারখীল (খরনা ইউনিয়ন)- এর আকতার মিয়া (পিতা নূর আহমদ), হোসেন আহমদ (পিতা নূরুল আমিন), ইসহাক মিয়া (পিতা সাইর আহমদ), কালা মিয়া (পিতা রনজু মিয়া) ও ফয়েজ আহমদ (পিতা আলী আকবর) অংশ নেন।
১৬ই নভেম্বর ভোরে টি এম আলী ও তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা কানাইজু পাড়া এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মিজোদের আক্রমণের শিকার হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করে প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা পেরে ওঠেননি। এ-যুদ্ধে টি এম আলী, কানাইজু পাড়া এলাকার অং সাচিং মারমা (পিতা ক্যজাইং প্রু মারমা) ও নায়েক ফয়েজ আহমদ (কাঞ্চনা, সাতকানিয়া উপজেলা)-সহ অর্ধশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও হাবিলদার আবু মো. ইসলামসহ কয়েকজন আহত হন। শহীদ টি এম আলীকে পটিয়ার কানাইজু পাড়ায় সমাধিস্থ করা হয়। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ও মিজোরা কানাইজু পাড়া এলাকায় ব্যাপক লুটপাট ও নারীনির্যাতন চালায়। তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৪০টি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ-যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তবে হাবিলদার আবু মো. ইসলাম কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে দ্রুত সংগঠিত করতে সমর্থ হন। টি এম আলী বাহিনীর প্রত্যেক অপারেশন বা সম্মুখ যুদ্ধ শেষে জনতার মধ্যে চরমপত্র প্রচার করা হতো। চিপছড়ি থেকে সাইক্লোস্টাইল মেশিনের মাধ্যমে তা প্রকাশিত হতো। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!