You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক টি এম আলী - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক টি এম আলী

টি এম আলী, বীর প্রতীক (১৯২১-১৯৭১) সুবেদার মেজর ও অবাঙালি বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ১৯২১ সালে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম হাশেম আলী তরফদার এবং মাতার নাম মরিয়ম বেগম। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ভারতের মাদ্রাজে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করে বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় শহীদ হন। তাঁর পুরো নাম ছিল তরফদার মোহাম্মদ আলী, তবে সেনাবাহিনীতে তিনি টি এম আলী নামেই পরিচিত ছিলেন। অবশ্য সেনাবাহিনীর রেকর্ড বুকে তাঁর নাম ছিল মোহাম্মদ আলী। পূর্ব পাকিস্তানে এসে টি এম আলী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি যশোর জেলার বারিনগর উপজেলার সাত মাইল বাজারে জমি কিনে সেখানেই বাড়ি নির্মাণ করেন। তাঁর পরিবার-পরিজন সেখানে থাকতেন।
অবাঙালি হলেও বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ তাঁকে বেশ নাড়া দিত। তাই বাঙালিদের যে-কোনো ন্যায্য আন্দোলনে তিনি মনেমনে সমর্থন দিতেন। নিজের অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব তিনি সহযোগিতা করে যেতেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নির্বাচনের রায় নস্যাৎ করতে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এমনি অবস্থায় বাঙালিরা যখন নিজেদের অধিকার আদায়ে আন্দোলনে মুখর, তখন টি এম আলী বাঙালিদের নানাভাবে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বাঙালিদের উদ্দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেয়ার পর যখন সারাদেশের মানুষ চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন টি এম আলীও তাঁর অবস্থান থেকে সতর্কভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐ রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহরে।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, এনসিও-জেসিও এবং সাধারণ সৈনিকরা মেজর —জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন টি এম আলীও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কেউ-কেউ তাঁর এ আগ্রহে সন্দেহ প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দলের অধীনে বাঙালিদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে থাকেন। তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, কালুরঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক প্রতিরোধ শেষে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে কালুরঘাটে সমবেত হন। ৩০শে মার্চ সেনাদের একাংশ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রামগড়ে চলে যায়, একাংশ কালুরঘাটে থাকে। বাকিরা বান্দরবানের কাছাকাছি অবস্থান নেন। টি এম আলীও সে-সময় বান্দরবানে ছিলেন। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
ডিসেম্বর মাসে সুবেদার টি এম আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে বান্দরবানের রাজবিলা হয়ে রোয়াংছড়ির পথ দিয়ে ভারতের দিকে যাচ্ছিলেন। এ-সময় তাঁর সঙ্গে মং শৈ হ্লা চৌধুরী, কবির আহমদ, সুকুমার দাশ, আবু ইসলাম, হাবিলদার জাফর আহমদ প্রমুখসহ ১৪০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শীতের রাত আর দীর্ঘ পাহাড়ি পথ হাঁটার ফলে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। রাতে তাঁরা বাঘমারার কানাইজু পাড়ায় অবস্থান নেন। কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ-সময় কানাইজু পাড়ায় পাকবাহিনী, মিজো বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁদের ঘিরে ফেলে। টি এম আলী তাঁর বাহিনীর সকল যোদ্ধাদের পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। তিনি একটি বড় গাছের গোড়ায় অবস্থান নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে গুলি ছুড়তে থাকেন। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময়ের এক পর্যায়ে শত্রুসৈন্যদের ছোড়া একটি মর্টার শেলের আঘাতে টি এম আলীর শরীর চিহ্নভিন্ন হয়ে যায়। সেখানেই তিনি শহীদ হন। ভোরে সেখানকার বাসিন্দারা টি এম আলীকে কানাইজু পাড়ার কাছে একটি গাছের নিচে দাফন করে। তাঁর সাহসিকতার জন্য সেদিন অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অস্ত্র হাতে লড়াই করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা টি এম আলী। বাঙালি না হয়েও এ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছেন এই মহান মুক্তিযোদ্ধা।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন ও আত্মোৎসর্গ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অবাঙালি এ বন্ধুকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভুষিত করে। তাঁর স্ত্রীর নাম মোছাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। সম্পর্কে ছিলেন ফুফাত বোন। এ দম্পতির ৪ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। [ইয়াছিন রানা সোহেল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড