You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা (গোপালগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা (গোপালগঞ্জ)

টুঙ্গিপাড়া উপজেলা (গোপালগঞ্জ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মস্থান ও স্মৃতিধন্য ভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত সদর উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের একটি গ্রাম ছিল। ১৯৭২ সালে কোটালীপাড়া উপজেলার ২টি (গোপালপুর ও ডুমুরিয়া) এবং গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ৩টি (পাটগাতি, কুশলী ও বর্নি এই ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে টুঙ্গিপাড়া থানায় পরিণত হয়। ১৯৮৫ সালে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর অসহযোগ আন্দোলন-এর উত্তাল দিনগুলোতেই টুঙ্গিপাড়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়। পাটগাতি ইউনিয়নের একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান লায়েক আলী বিশ্বাস, সিরাজুল হক বিশ্বাস (পান্না বিশ্বাস), যুদ্ধকালীন কমান্ডার ফায়েকুজ্জামান, শেখ আবদুল হালিম, আবুল খায়ের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (ডুমুরিয়া), বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরিরত কাজী রাছেক প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠিত করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করতে থাকেন। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের মতো টুঙ্গিপাড়ায়ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতে থাকে।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে জাতির উদ্দেশে ইপিআর-এর ওয়ারলসের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে ঘোষণা সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, তাঁর সেই ঘোষণা গোপালগঞ্জ মহকুমা সদরে ডা. ফরিদ আহমেদ, কামরুল ইসলাম রইচ, আক্তার মোক্তার প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার কাছে পৌঁছায় এবং সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিকট তা পৌঁছে দেন। তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু হয়।
এ-সময় স্থানীয় জি টি স্কুল মাঠ, কেড়াইলকোপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, গোপালপুর স্কুল মাঠ, বাঁশবাড়িয়া প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এপ্রিল মাসের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল এবং ভাগ্নে শেখ শহীদুল ইসলাম ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় আসেন। শেখ কামাল ছিলেন ইউওটিসি-র ট্রেনিংপ্রাপ্ত। উভয়ে এখানে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা ট্রেনিং কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহী ছাত্র-যুবকদের কাঠের ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এছাড়া টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ির খেলার মাঠে ১০-১২টি দেশীয় বন্দুক দিয়ে স্থানীয় যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া হয়। এ প্রশিক্ষণ ১৫ থেকে ২০ দিনের মতো স্থায়ী হয়। টুঙ্গিপাড়ার কাজী বাড়ির কাজী রাছেক বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ২ মাসের ছুটি নিয়ে তিনি বাড়িতে আসেন। তিনিও প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। টুঙ্গিপাড়ায় যুবকদের প্রশিক্ষণের খবর ক্রমেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হানাদার বাহিনী ৩০শে এপ্রিল গোপালগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপনের পর তাদের দোসর মাওলানা আক্কেল আলী ও পারকুশলী গ্রামের রাজাকার রেজাউল কারি টুঙ্গিপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের খবর হানাদারদের কাছে পৌঁছে দেয় ৷ পাকহানাদার বাহিনী এসে আক্রমণ করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ভেঙ্গে দেয়। এদিকে ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর) জিয়াউদ্দিন (পিরোজপুর) কয়েকজন সঙ্গীসহ টুঙ্গিপাড়ায় শেখ বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব-কে তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং দুই পুত্র শেখ জামাল ও শেখ রাসেলসহ ঢাকার মগবাজার এলাকার এক বাসা থেকে বন্দি করে ১৮ নম্বর ধানমন্ডির এক বাসায় পাকিস্তানি সেনা প্রহরায় মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র সময় অন্তরীণ করে রাখা হয়। সেখান থেকে শেখ জামাল পালিয়ে ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে শেখ কামাল ও শেখ শহীদুল ইসলাম মাদারীপুরের শিবচরের দত্তপাড়া হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন আসাম দিয়ে ভারতে গমন করেন। শেখ শহীদুল ইসলাম দেরাদুনের টান্ডুয়া ক্যাম্পে মুজিব বাহিনী র ট্রেনিং এবং শেখ কামাল আসামের মুর্তি ক্যাম্পে নিয়মিত সেনাবাহিনীর ট্রেনিং গ্রহণ করেন। এরপর শেখ কামাল প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে ৮নং থিয়েটার রোডের অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ জামাল গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। শেখ ফজলুল হক মনির সহোদর ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল করিম সেলিম ভারতে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে শেখ শহীদুল ইসলাম ট্রেনিং শেষে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালে টুঙ্গিপাড়া ছিল ৯নং সেক্টরের অধীন। এ সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর এম এ জলিল। টুঙ্গিপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন সেনাসদস্য ফায়েকুজ্জামান ফায়েক। এছাড়া সালাউদ্দিন শেখ, ফকরুল ইসলাম, লায়েক আলী বিশ্বাস, শহীদুল ইসলাম শেখ, সিরাজুল হক পান্না বিশ্বাস, আবুল খায়ের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (ডুমুরিয়া), স্বরূপ হালদার, শেখ আবদুল হালিম, ফিলিপ মজুমদার, জগদানন্দ ঠাকুর, বৈকুণ্ঠ সরকার, সিরাজুল হক খান (বর্নি), আবুল বশর (বাঁশবাড়িয়া), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পাটগাতি), নরেশ বিশ্বাস (ন্যাপ নেতা), শেখ দেলোয়ার হোসেন দিলু প্রমুখ এ এলাকার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে টুঙ্গিপাড়ায় স্থানীয় বিশেষ বাহিনী হিসেবে হেমায়েত বাহিনী তৎপর ছিল। অত্র অঞ্চলের অসংখ্য যুদ্ধের পাশাপাশি টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ি তথা পাটগাতির যুদ্ধে এ বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম নেতৃত্ব দেন। এছাড়া এ বাহিনীর অন্যতম দুই সেনানী ইপিআর সদস্য মকবুল (ভুরঘাটা, বরিশাল) এবং সেনাসদস্য আবদুস সালাম (পিতা জাফর আলী, ডাসার, কালকিনী, মাদারীপুর) এ-যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর টুঙ্গিপাড়ার সাহসী যুবকরা জাতির পিতার বাড়ি ও অন্যান্য বাড়িঘর রক্ষায় পাহারা জোরদার করেন। তাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের মধ্যে টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শাহজাহান শেখের ছেলে মিন্টু শেখ, নজির শেখের ছেলে ধলা মিয়া শেখ, ইসমাইল শেখের ছেলে আরশাদ শেখ, মানিক কাজীর ছেলে তোরাব আলী, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গৃহকর্মী ইকু (সাতক্ষীরা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯শে মে দেড় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে লঞ্চযোগে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এসে আক্রমণ চালায়। তারা পূর্বোল্লিখিত যুবকদের যাঁকে যেখানে পেয়েছে রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাঁদের ওপর আঘাত করে নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে।
১৯শে মে পাকিস্তানি বাহিনী গোপালগঞ্জ সদর থানা সংলগ্ন জয়বাংলা পুকুরপাড়ের পাকিস্তানি মিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে লঞ্চযোগে টুঙ্গিপাড়া অনুপ্রবেশ করে এবং টুঙ্গিপাড়ায় তাণ্ডব চালিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় ও গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী টুঙ্গিপাড়ায় কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি পরবর্তী সময়ে শান্তি কমিটি – চেয়ারম্যান নুরু মিয়ার নেতৃতে পাটগাতি বাজারে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
পূর্ব থেকেই পাঁচকাহিনিয়ার মাওলানা আক্কেল আলী এবং পারকুশলীর রেজাউল কারি পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ও গোপন সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করে আসছিল। এদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা ধীরে-ধীরে টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি, লেবুতলা, কুশলী, ডুমুরিয়া, বাঁশবাড়িয়া, গোপালপুর, তারাইল, জোয়ারিয়া ভৈরবনগর, গুয়াদানা প্রমুখ স্থানে প্রসারিত হতে থাকে। জুন মাসের মাঝামাঝি পাটগাতি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান শেখ নুরুল হক (নুরু মিয়া)-এর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। বর্নি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল সাহাবুদ্দিন মোল্লা (বর্নি)। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলো- মুকসুদুল হক (রাজাকার কমান্ডার), হেমায়েত উদ্দিন শেখ, আমজাদ হোসেন খান, বজলার রহমান খান, ফরমান মুন্সী (বর্নি), আক্কেল আলী (পাঁচকাহনিয়া), রেজাউল হক কারি (পারকুশালী), জাফর (পাটগাতি) প্রমুখ। এছাড়া গহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও গিমাডাঙ্গা মাদ্রাসার অনেকে পাকহানাদার বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার হাফেজ ওমরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য যে, গিমাডাঙ্গা মাদ্রাসা পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা এ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতা করে। তাদের নেতৃত্বে ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার মতো জঘন্য কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। তাদের অত্যাচারে এলাকার অনেক বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ শান্তিকামী মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়। শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের বর্বরতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে।
কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী নূরুল হক, রাজাকার মাওলানা আক্কেল আলী, রেজাউল কারি ও নুরুজ্জামান মাহমুদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশক্তির নেতা ও মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডু মিয়ার ভাই ফায়েকুজ্জামানের জ্যেষ্ঠ পুত্র, গোপালগঞ্জ) পাকিস্তানি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে ১৯শে মে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে আসে। হানাদার বাহিনী এখানে অনুপ্রবেশের পর হত্যা, লুটপাট, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি তাণ্ডব লীলা চালায়।
এ-সময় পাকিস্তানি হানাদাররা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতা বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা ঘর থকে বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে। তাদের একজন বঙ্গবন্ধুর বৃদ্ধ পিতাকে মুক্তিফৌজের সন্ধান দিতে বলে, অন্যথায় ১০ মিনিট পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে বলে সতর্ক করে দেয়। পাকিস্তানি সেনাটি তখন তাঁকে বলে, “তু এয়াজিদ হ্যায় আউর তেরা লেড়কা চোহগালখোর হ্যায়, তামাম দুনিয়ামে আগ লাগা দোতা হয়।’ তিনি তাদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকেন। পাকিস্তানি সৈন্যটি তখন বলতে থাকে, ‘তুছিধে হোক খাড়া হো’। তখন তিনি বুক ফুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। পাকিস্তানি সেনাদের একজন দলপতি বেতার যন্ত্রের সাহায্যে ঊর্ধ্বতন কারো সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধুর পিতাকে গুলি করা থেকে নিবৃত হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধুর পিতা ও মাতা পাকসেনাদের মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। হানাদাররা তখন বঙ্গবন্ধুর ছবি পা দিয়ে মাড়াতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর পিতার ঘরে প্রবেশ করে লোহার সিন্ধুক ও স্টিলের আলমিরা ভেঙ্গে সোনাদানা ও নগদ টাকা লুট করে নেয়। এরপর গান পাউডার ছিটিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সঙ্গে তারা শেখ মুসা হোসেন (বঙ্গবন্ধুর ভায়রা ও শেখ শহিদুল ইসলামের পিতা)-এর ঘরেও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। আগুন ধরিয়ে দেয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পিতার ঘর থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র বের করে হানাদাররা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গৃহকর্মী আরশাদের মারফৎ সব কিছু লঞ্চে তুলে নেয়। মালামাল লঞ্চে ওঠানোর পর তারা আরশাদকে গুলি করে হত্যা করে। টুঙ্গিপাড়া থেকে লঞ্চে গোপালগঞ্জ ফেরার পথে পাকিস্তানি বাহিনী লেবুতলা, ডুমুরিয়া প্রভৃতি হিন্দু গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পথে তারা উত্তর পাকুরতিয়া, তারাইল, ঘাঘর প্রভৃতি গ্রামেও হামলা চালায়। তারা হিন্দুপ্রধান তারাইল গ্রাম ও তারাইল বাজারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। মে মাসের শেষের দিকে নূরু মিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদাররা খান সাহেব শেখ মোশারফ হোসেন (বঙ্গবন্ধুর চাচা)-এর গোলাঘরসহ অন্যান্য বাড়িঘরে লুটতরাজ করে এবং আগুন দেয়। তারা লেবুতলা, জোয়ারিয়া, পাথরঘাটা, গোপালপুর, ভৈরব নগর, তারাইল প্রভৃতি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামেও লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে বর্নি ইউনিয়নের বর্নি গ্রামের নুরুল হক শেখের পুত্র আর্মিতে চাকরিরত অবস্থায় একটি রাইফেল নিয়ে পালিয়ে বাড়িতে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বিষয়টি বর্নি ইউনিয়নের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন মোল্লা জেনে যায়। শান্তি কমিটির সদস্য মুকসুদুল হক জমাদার, হেমায়েত উদ্দিন শেখ, আমজাদ হোসেন খান, বজলার রহমান এবং ফরমান মুন্সী তাঁকে ধরে গোপালগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী অকথ্য নির্যাতন শেষে তাঁকে গুলি করে হত্যার পর জয়বাংলা পুকুর বধ্যভূমিতে কবর দেয়। একইভাবে ঐসব দালাল বাঁশুড়িয়া গ্রামের রঙ্গু মিয়ার ছেলে সাহাবুদ্দিন, জনৈক আশ্রাফ আলী এবং বয়োবৃদ্ধ হাসেম মোল্লা (পিতা আবদুল লতিফ)-কে ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এ ৩ জনকেও পাকিস্তানি হানাদাররা নিমর্মভাবে হত্যা করে।
টুঙ্গিপাড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর কোনো স্থায়ী নির্যাতনকেন্দ্ৰ বা বন্দিশিবির ছিল না। পাটগাতি বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্পটি ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন জয়বাংলা পুকুর পাড়ে অবস্থিত হানাদারদের মিনি ক্যান্টনমেন্টে স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ লোকজনদের ধরে নিয়ে নিয়মিত নির্যাতন চালানো হতো। এখানে একটি বন্দিশিবিরও ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি, বাঁশবাড়িয়া, লেবুতলা, ডুমুরিয়া, ভৈরবনগর, তারাইল প্রভৃতি স্থানে লঞ্চযোগে প্রায়শই অভিযান চালাত এবং নিরীহ লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এখানকার বন্দিশিবিরে নির্যাতন চালাত ও গুলি করে হত্যা করত।
টুঙ্গিপাড়ায় কোনো বধ্যভূমি বা গণকবর নেই। পাকহানাদার বাহিনী টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি করে হত্যা করে গোপালগঞ্জের জয়বাংলা পুকুরপাড় বধ্যভূমিতে হত্যা করত এবং গণকবরে কবর দিত। প্রতিরোধপর্বে নিহত মুক্তিযোদ্ধা মিন্টু শেখ, ধলা মিয়া, শেখ আরশাদ, তোরাব আলী প্রমুখের লাশ গ্রামবাসীর সহায়তায় বিচ্ছিন্নভাবে কবর দেয়া হয়।
১১ই জুলাই পাকবাহিনীর সঙ্গে হেমায়েত বাহিনীর টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়ি তথা পাটগাতিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী টুঙ্গিপাড়া থেকে পালিয়ে যায়। হেমায়েত বাহিনীর সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতাকে তাঁদের পারিবারিক নৌকাযোগে ঐদিনই শিবচর থানার এমপিএ ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী (বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে)-র বাড়িতে পৌঁছে দিতে সহায়তা করেন। পরের দিন হেমায়েত বাহিনী পাটগাতির রাজাকার শেখ নূরুল হক (নুরু মিয়া) চেয়ারম্যানের বাড়ি অপারেশন করে। এতে নেতৃত্ব দেন হেমায়েত বাহিনীর বীর যোদ্ধা ইপিআর সদস্য মকবুল (ভুরঘাটা, বরিশাল) এবং মাদারীপুরের ডাসার গ্রামের জাফর আলীর পুত্র সেনাসদস্য আবদুস সালাম। এ-সময় একজন রাজাকার নিহত হয় এবং রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নুরু মিয়া পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
১৪ই অক্টোবর হেমায়েত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা থেকে ঢাকাগামী একটি স্টিমারের ওপর অপারেশন চালান। এটি ছিল টুঙ্গিপাড়ায় মুক্তিফৌজের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশে সারেং রকেটটি ঘাটে থামাতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যাত্রীদের ছেড়ে দিয়ে কয়েকজন পাকিস্তানি দাদালকে আটক করে তাঁদের ক্যাম্পে নিয়ে যান। গোপালগঞ্জ শহর মুক্ত হয় ৭ই ডিসেম্বর। একই দিনে টুঙ্গিপাড়া হানাদারমুক্ত হয়। ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় গোপালগঞ্জ সদর থানা সংলগ্ন মিনি ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং পরের দিন ৭ই ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের পূর্বেই তারা গোপালগঞ্জ শহর থেকে পালিয়ে যায়। একই সঙ্গে পাটগাতি বাজারের রাজাকার ক্যাম্পেরও পতন ঘটে এবং রাজাকাররা পালিয়ে আত্মগোপন করে।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— এ জে এম আমিনুল হক, বীর উত্তম (পিতা মাওলানা নুরুল হক, বাঁশবাড়িয়া) ও মো. রেজাউল হক, বীর প্রতীক- (পিতা ছহির উদ্দিন, বর্নি)।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- বেলায়েত হোসেন শেখ (পিতা আলতাফ হোসেন শেখ, শ্রীরামকান্দি, পাটগাতি), মো. সেরাজুল হক মুন্সি (পিতা আবদুর রশীদ মুন্সি, শ্রীরামকান্দি, পাটগাতি), আবুল বাসার তালুকদার (পিতা মিনহাজউদ্দিন তালুকদার, বাঁশবাড়িয়া, ডুমুরিয়া), আবুল হাশেম মোল্লা (পিতা ইউছুব মোল্লা, বাশুরিয়া, গিয়াডাঙ্গা) এবং জামাল উদ্দিন মিন্টু (পিতা শাহজাহান)। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য এ জে এম আমিনুল হক (বাঁশবাড়িয়া, টুঙ্গিপাড়া)-কে ‘বীর উত্তম’ এবং মোহাম্মদ রেজাউল হক (বর্নি, টুঙ্গিপাড়া)-কে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। এ জে এম আমিনুল হক ১নং সেক্টরের জেড ফোর্সের অধীনে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মোহাম্মদ রেজাউল হক মুক্তিযুদ্ধকালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। তিনি রৌমারীতে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন এবং কোদালকাটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ (বর্তমানে সরকারি) ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান কলেজের মাঠে বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ কামাল স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামালের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ জামাল যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের (বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা)-এর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ত্রিপল্লী শেখ আবু নাসের উচ্চ বিদ্যালয়। টুঙ্গিপাড়ার যুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম (কালকিনি)-এর নাম কোটালীপাড়ায় নির্মিত হেমায়েত বাহিনীর স্মৃতিফলকে খোদিত আছে। [শেখ শহীদুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড