You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে টেকনাফ উপজেলা (কক্সবাজার)

টেকনাফ উপজেলা (কক্সবাজার) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সুস্পষ্ট ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ টেকনাফবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে টেকনাফ, উখিয়া ও রামু আসন থেকে নির্বাচিত এমএনএ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী তাঁর নির্বাচনি এলাকায় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ২৩শে মার্চ টেকনাফ ইউনিয়নের ডেইলপাড়ায় রশিদ আহমদ চৌধুরীর বাড়িতে বসে সাত সদস্যবিশিষ্ট টেকনাফ থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে হাজি আবেদীন সওদাগর ও হাজি আবদুল করিম (সাবরাং)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- হাজি আবদুল গণি (সাবেক সংসদ সদস্য), রশিদ আহমদ চৌধুরী (সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান), এম আবদুস শুক্কুর, আমিনুজ্জামান ও সুলতান আহমদ সওদাগর। টেকনাফ ডাকবাংলোতে কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করা হয়।
২৪শে মার্চ সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে টেকনাফ শহরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলে সর্বস্তরের মানুষ দা, বল্লম, লাঠিসোটা, বন্দুক প্রভৃতি নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বিভিন্ন সড়ক ও বাজার এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
ছাত্রলীগের সভাপতি সলিম উল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মিছিলশেষে টেকনাফ ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কক্সবাজার থেকে নির্বাচিত এমএনএ এডভোকেট নুর আহমদ যে-কোনো পরিস্থিতির জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। এছাড়া সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে, থানা সংগ্রাম কমিটির কার্যালয় থেকে যে ঘোষণা দেয়া হবে, টেকনাফবাসী তা মেনে চলবে।
২৬শে মার্চ সকালে এডভোকেট নুর আহমদের নেতৃত্বে টেকনাফ থানায় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রলীগের সভাপতি সলিম উল্লাহ, সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, সদস্য কামাল ও থানার ওসি আবদুর রহমান সম্মিলিতভাবে পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর এডভোকেট নুর আহমদ সরকারি কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করে থানা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হারুনের নেতৃত্বে একটি দল টেকনাফে আসেন এখানকার মুক্তিকামী জনতাকে সংগঠিত করতে। তাঁরা হোয়াইক্যং-এর জমিদার আলী মিয়া চৌধুরী ও হ্নীলার অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীসহ ছয়জনকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে যান। তাঁরা অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, আয়ুব বাঙালী, নুরুল আমিন, সিরাজুল হক, সিরাজুল কবির ও মাস্টার জুলফিকারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করেন। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের সাতজন সদস্য টেকনাফ হাইস্কুল ও হ্নীলার সিএন্ডবি (সড়ক ও জনপথ বিভাগ) বাংলোয় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ আহমদের নিকট প্রশিক্ষণ নেন। উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ টেকনাফ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
২৫শে এপ্রিল ৮৫টি সাজোয়া গাড়ির বহর নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কক্সবাজার থেকে টেকনাফে প্রবেশ করে এবং টেকনাফ থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তখন স্থানীয় রাজাকাররা তাদের স্বাগত জানায় এবং উল্লাস প্রকাশ করে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের খতম করার ঘোষণা দেয়। সেদিন রাজাকারদের ইঙ্গিতে হানাদার বাহিনী প্রথমে এডভোকেট নুর আহমদ, হাজি মকবুল আহমদ, রশিদ আহমদ চৌধুরী ও এম আবদুস শুক্কুরের শ্বশুর হাজি আবুল হোসাইন সওদাগরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা জালিয়াপাড়ার আলী আহমদ (ছাত্রলীগ সভাপতি সলিম উল্লাহর চাচা), সাবরাং এলাকার হাজি আবদুল করিম, হাজি আমির হামজা ও মার্কিন মিয়ার (শফিক মিয়ার পিতা) বাড়িসহ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ২০-২৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। টেকনাফ উপজেলায় পাকবাহিনীকে সহায়তার জন্য রাজাকার বাহিনী ছাড়া শান্তি কমিটি ও গঠন করা হয়। টেকনাফ সদর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল হাজি ছোট কালা মিয়া এবং হ্নীলার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল আব্দুল গফুর চৌধুরী (সাবেক সংসদ সদস্য)। সাবরাং ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল হাজি নজির আহমদ (শাহপরীর দ্বীপের নজির চেয়ারম্যান)। তার ভয়ে ভীত হয়ে এ এলাকার বহু লোক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়। তার নির্দেশে রাজাকাররা এখানকার সংগ্রাম কমিটি এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। টেকনাফে সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘরে আগুন দেয় গোদারবিলের রাজাকার হোছন আহমদ, টেকনাফ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজি ছোট কালা মিয়া, সদস্য মাওলানা ইব্রাহিম এবং নোয়াপাড়ার মৌলভী এজাহারসহ মাদ্রাসার কিছু ছাত্র। এ উপজেলায় তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়ি চিনিয়ে দিত রাজাকার ও মাদ্রাসার ছাত্ররা। তারা বিলের গরু-ছাগল ও বাড়ি-ঘরের হাঁস-মুরগি ধরে পাকিস্তানি সৈন্যদের যোগান দিত এবং এলাকার মেয়েদের খবর তাদেরকে পৌঁছে দিত। তাদের সহযোগিতায় পাকসেনারা মুক্তিবাহিনী খোঁজার নামে ঘরে ঢুকে নারীদের ধর্ষণ করত।
টেকনাফে পাকবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ধনসম্পদ লুট করে। কুলালপাড়ার শমশু হাজি মুক্তিবাহিনীর সমর্থক ছিলেন বিধায় তারা তাঁর গরু-ছাগল লুট করে নিয়ে যায়। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল, জালিয়াপাড়া মুক্তিবাহিনীর সমর্থকদের ঘাঁটি। তাই তারা এ পাড়াতেই বেশি অত্যাচার ও ব্যভিচার চালায়। বহু নারী তাদের অত্যাচার ও লালসার শিকার হন। এপ্রিলের শেষদিকে পাকবাহিনী শীলবুনিয়া পাড়ার বিলে এক পাগল ব্যক্তিকে গুপ্তচর সন্দেহে গুলি করে হত্যা করে। নীলার অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ভেবে তারা অপর এক মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করে। কুলালপাড়ার নুর মোহাম্মদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করায় নজির চেয়ারম্যান তাকে ধরে এনে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকবাহিনী তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দেয়।
পাকবাহিনীর অব্যাহত অত্যাচার-নির্যাতনে টিকতে না পেরে তখন এতদঞ্চলের (টেকনাফসহ কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকার) সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্যসহ বহু মানুষ বার্মায় আশ্রয় নেয়। এ-সময় হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে কক্সবাজারের তিন হাজারেরও বেশি হিন্দু বার্মায় পালিয়ে যায়। বার্মার মংডু শহরের চার মাইল নামক স্থানে কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গে আশ্রয় নেন এডভোকেট নুর আহমদ, কক্সবাজারের কামাল হোসেন চৌধুরী, ছাত্রনেতা সলিম উল্লাহ, ছুরত আলম ও কালুরঘাট যুদ্ধে গুলিতে আহত ক্যাপ্টেন হারুন। মংডুর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে পায়ের গুলি বের করার পর ক্যাপ্টেন হারুনকে বলীবাজার সীমান্ত দিয়ে কক্সবাজারের দিকে পাঠানো হয়। বার্মার নাকপুরা এলাকায় আশ্রয় নেন হ্নীলার অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, আয়ুব বাঙালী, নুরুল আমিন, সিরাজুল হক, সিরাজুল কবির, মাস্টার জুলফিকারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এ সময় ক্যাপ্টেন হারুন ও ক্যাপ্টেন ছোবহানের উদ্যোগে বার্মার ঢেকুবনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হন। বার্মায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেন জালিয়াপাড়ার এজাহার মিয়া কোম্পানি (বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির পিতা)। তিনি বার্মা থেকে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিঠিপত্র টেকনাফে নিয়ে আসতেন এবং টেকনাফে পাকবাহিনীর অবস্থান, কার্যক্রম ও গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে বার্মায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে-ভেতরে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের মধ্যে রাখাইন সম্প্রদায়ের উ প্রিণচা খেঁ-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। টেকনাফে চাঁদার টাকায় কেনা চাল ও শুঁটকি ট্রাকে করে কক্সবাজার, সাতকানিয়া ও আমিরাবাদে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জন্য পাঠানো হতো। বার্মায় অবস্থানরত টেকনাফের মুক্তিকামী যুবকরা মাঝে-মধ্যে টেকনাফে এসে অপারেশন চালাতেন। এপ্রিলের শেষেদিকে তাঁরা ৯ জন পাঠানকে ধরে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেন এবং এক সপ্তাহ পর সারিঅং ঢালা নামক স্থানে তাদের হত্যা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে বার্মার ঢেকুবনিয়া থেকে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যাত্রাপথে ঈদগাঁও, ঈদগড় ও আলীকদমে রাজাকারদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি সৈন্যদের টেকনাফ থেকে বার্মার দিকে অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে বার্মায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে প্রতিহত করতে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্রথমে কক্সবাজার এবং পরে নীলা হয়ে তারা টেকনাফে প্রবেশ করে টেকনাফ থানা দখল করেন। ১২ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা টেকনাফ থানা দখল করেন এবং এদিনই এ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
টেকনাফ উপজেলায় দুটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন বধ্যভূমি ও গণকবর এবং পল্লানপাড়া বধ্যভূমি গণকবর। পাকসেনারা কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে হত্যা করে এখানকার একটি গর্তে ফেলে দিত। টেকনাফ পুরাতন হাসপাতাল সংলগ্ন মাঠে গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [আব্দুল কুদ্দুস রানা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!