You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ঝিকরগাছা উপজেলা (যশোর)

ঝিকরগাছা উপজেলা (যশোর) ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গণরায় উপেক্ষা করে ইয়াহিয়া সরকার বাঙালি নিধনের এক নীলনকশা নিয়ে অগ্রসর হয়। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসন-শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ঐ ভাষণ শুনে ঝিকরগাছার মুক্তিকামী মানুষ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং ঝিকরগাছা- মণিরামপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মো. আবুল ইসলাম, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. গোলাম সরোয়ার, মকবুল হোসেন, মোতাচ্ছিম বিল্লাহ, রেজাউল হক, আবদুল আজিজ প্রমুখের নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে উল্লিখিত নেতৃবৃন্দই এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২৩শে মার্চ ঢাকার জয়দেবপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয়, তার খবর ঝিকরগাছায়ও পৌঁছে যায়। ২৬শে মার্চ স্থানীয় জনতা যশোর-বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছা এলাকার বিভিন্ন স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ২৭শে মার্চ যশোরের অপর এক এলাকা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মো. মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্রনেতা রবিউল হক ও ওলিয়ার রহমানসহ কয়েকজন যুবক ভারতে যায়। এরপর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে এলাকার আরো কয়েকজন তরুণ ভারতে গমন করে এবং তারা সকলে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ ও বশিরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ঢাকায় ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট-এর পরপর পাকবাহিনী ঝিকরগাছায় প্রবেশ করে নিরীহ বাঙালিদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। ১০ই এপ্রিল সার্কেল অফিসারের কার্যালয়ে মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য তারা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে ঝিকরগাছা এম এল হাইস্কুলে আরো একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকবাহিনীর সহায়ক হিসেবে জুলাই মাসের প্রথম দিকে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র লোকজন নিয়ে শান্তি কমিটি রাজাকার আলবদর মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়। মুসলিম লীগ নেতা ও ঝিকরগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদের নেতৃত্বে ঝিকরগাছা থানা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ ব্যাপারে তাকে সহায়তা করে মুসলিম লীগ নেতা মাওলা বক্স, মধুখালির মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল আজিজ, কাশীপুরের আইয়ুব হোসেন মেম্বর এবং আঞ্জুমান মহাজেরিনের প্রধান ওয়াজেদ মিয়া। বর্তমান জামায়াত নেতা এডভোকেট আব্দুস সালামের নেতৃত্বে গঠিত হয় যশোর জেলা আলবদর বাহিনী। তার উদ্যোগে ঝিকরগাছায়ও এর শাখা গঠিত হয়। পাকবাহিনী ও এসব রাজাকারআলবদররা ঝিকরগাছার গ্রামে- গ্রামে নারীধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ নানারকম কর্মকাণ্ড চালায়। পাকবাহিনীর সহযোগী আঞ্জুমান মহাজেরিনের কার্যালয় ছিল যশোর- বেনাপোল সড়কের ঝিকরগাছা ব্রিজের কাছে। এখানে নির্যাতন চালিয়ে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করা হতো। এছাড়া শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো এবং কারো ক্ষেত্রে ‘খরচের খাতায়’ এরূপ সাংকেতিক নির্দেশ দেয়া হলে তাকে মাঠে বা অন্যত্র নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হতো। এছাড়া ডা. গোলাম সরোয়ারের পরিত্যক্ত বাড়িটি ছিল পাকবাহিনীর বন্দিশিবির। এখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। ঝিকরগাছা বাজারের কাছে ওয়াপদা মাঠ, গরুহাটা, রেলব্রিজ ও কাটাখালী ছিল এ এলাকার বধ্যভূমি। এসব স্থানে হত্যার পর ওয়াপদা মাঠের পুকুরে শহীদদের লাশ ফেলে দেয়া হতো। বাঁকড়া ইউনিয়নের উজ্জ্বলপুর গ্রামে রয়েছে পাঁচ শহীদের কবর।
ঝিকরগাছা উপজেলায় মুক্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন আব্দুস সাত্তার ও ওলিয়ার রহমান। এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – কাশীপুর যুদ্ধ – ছুটিপুর যুদ্ধ, গোয়ালহাটির যুদ্ধ, দোসতিনা মধুখালির শালবাগান যুদ্ধ এবং যাদবপুর-রাজাপুর যুদ্ধ। ২৭শে জুন কাশীপুরের যুদ্ধে একজন লেফটেন্যান্টসহ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ইপিআর সুবেদার মনিরুজ্জামান শহীদ হন। ৩রা অক্টোবর ছুটিপুর যুদ্ধে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ২৮ জন আহত হয়। ৬ই আগস্ট গোয়ালহাটির প্রথম যুদ্ধে ৪২ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৫ই সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় যুদ্ধে শহীদ হন ইপিআরের ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ। ৭ই সেপ্টেম্বর গঙ্গানন্দপুর যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২১শে সেপ্টেম্বর দোসতিনা-মধুখালির শালবাগান যুদ্ধে ২০-২৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। একই দিন যাদবপুর-রাজাপুর যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২০-২২ জন পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে লাউজানি, হাজিরালি, মধুখালি, বাঁকড়াসহ বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। সেসব যুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। রণাঙ্গনে অসীম সাহসের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় এ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল, বীর প্রতীক- (রকেট জলিল নামে খ্যাত)-এর নাম ব্যাপকভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
৫ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে পাকবাহিনী ঝিকরগাছার ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেলে মুক্তিবাহিনী সমগ্র উপজেলা দখলে নেয়। পরের দিন ৬ই ডিসেম্বর ঝিকরগাছাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ৫ই ডিসেম্বর পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকবাহিনী সড়ক ও রেলব্রিজ ধ্বংস করে এবং তিনটি বাস বোঝাই ১৫০জন যাত্রীকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারে।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আব্দুল জলিল, বীর প্রতীক (পিতা মোহর আলী মোড়ল, পাল্লা)।
ঝিকরগাছা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আব্দুল হামিদ (পিতা সদু মোড়ল, শিমুলিয়া), আনিছুর রহমান (পিতা আব্দুর রাজ্জাক, কৃষ্ণনগর), রফিক মিয়া (পিতা আব্দুল আজিজ, লাউজানি), হাসান আলী হাওলাদার (পিতা ফটিক হাওলাদার, কৃষ্ণনগর), এজাহার আলী (পিতা গোলাম নবী, ফুলবাড়ী), গোলাম মোস্তফা খান (পিতা মোকসেদ আলী খান, মাটিকুমরা), মফিজুর রহমান হেম (পিতা আব্দুর রব সরদার, হাজিরবাগ), ওলিয়ার রহমান (পিতা বশিরউল্লাহ, লক্ষ্মীপুর), কামাল উদ্দীন (পিতা জোনাব আলী সরদার, পৌদাওলিয়া), আরশাদ আলী (পিতা ওমান মোড়ল, শরীফপুর), আবুবরক সিদ্দিক (পিতা আহম্মদ হোসেন, ঝিকরগাছা), আব্দুস সালাম (পিতা কালু দালাল, কুলবাড়ী; পুলিশ) এবং ইসমাইল হোসেন (পিতা কাশেম আলী সরদার, আলীপুর)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ঝিকরগাছা উপজেলায় একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে ঝিকরগাছা বাজারে ‘শহীদ আবুবকর স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯০ সালে হাজিরবাগ ইউনিয়নের মাটিকুমরা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘শহীদ মোস্তফা স্মৃতি সংঘ ও পাঠাগার’। উপজেলা মোড়ে ১৯৯৩ সালে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক স্মৃতিফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৬ সালে বাঁকড়া ইউনিয়নের উজ্জ্বলপুর গ্রামে পাঁচজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘উজ্জ্বলপুর মুক্তিযোদ্ধা দাখিল মাদ্রাসা’। এছাড়া ঝিকরগাছা- বাঁকড়া সড়কটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবুল ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়। [ফখরে আলম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!