মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইগাতী উপজেলা (শেরপুর)
ঝিনাইগাতী উপজেলা (শেরপুর) ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী। এটি নদী ও প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সমৃদ্ধ এলাকা। এখানে দীর্ঘকাল থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, গারো, কোচ ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় ও নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ডাকে ১৯৭১ সালের মার্চে দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঝিনাইগাতীর সাধারণ মানুষও পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন-এ যোগ দেয়। ২৫শে মার্চ বর্বর পাকহানাদার বাহিনী ঢাকার পিলখানায় ইপিআর এবং রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেরপুর এলাকার কৃষক, শ্রমিক, যুবক এবং ছাত্র-জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ঝিনাইগাতী ১১ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত ছিল। এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল আবু তাহের।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত একটি ওয়ারলেস বার্তা ২৬শে মার্চ বিকেলে ঝিনাইগাতীর ছাত্রনেতা ফকির মো. আব্দুল মান্নান-এর কাছে পৌঁছে। তিনি এ বার্তার সংবাদ প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম উদ্দিন আহমেদ এমপিএ-কে জানান। পরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর নেতাকর্মীদের এ বার্তা পাঠ করে শোনান। ২৭শে মার্চ মো. আনিছুর রহমান এমএনএ এবং এডভোকেট মো. আব্দুল হালিম এমপিএ এ বার্তা নিয়ে ভারতের পুরাকাশিয়া বিএসএফ ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য ফকির মো. আব্দুল মান্নানকে দায়িত্ব দেন। ২৮শে মার্চ তিনি এ বিষয়ে পুরাকাশিয়া বিএসএফ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। ২৯শে মার্চ আনিসুর রহমান এমএনএ, এডভোকেট আব্দুল হালিম এমপিএ, সুবেদার আ. হাকিম এবং ফকির মো. আব্দুল মান্নান বিএসএফ-এর সিচিংপাড়া ক্যাম্পে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা প্রাপ্তির বিষয়ে কথা বলেন।
ঝিনাইগাতী অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে ছাত্রনেতা ফকির মো. আব্দুল মান্নান উপজেলার ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে তরুণরা ভারতের সীমান্তবর্তী প্রদেশে প্রশিক্ষণার্থে যান। অনেকে ভারতের মেঘালয় প্রদেশে আশ্রয় নিয়ে সেখানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তাঁরা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ঝিনাইগাতীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকরা হলেন- আনিসুর রহমান এমএনএ, এডভোকেট আব্দুল হালিম এমপিএ, সুবেদার আ. হাকিম, ফকির মো. আব্দুল মান্নান (বন্দভাটপাড়া), মকবুল হোসেন মাস্টার (খৈলকুড়া, আহম্মদনগর), আব্দুর রশিদ মাস্টার (আহম্মদনগর), মো. রমিজ উদ্দিন মাস্টার (খৈলকুড়া) এবং আবুল ফজল মাস্টার (মানিককুড়া)।
৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী জামালপুরের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদ অতিক্রম করে ঝিনাইগাতীর দিকে অগ্রসর হয়। ঝিনাইগাতী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ভারতে যান।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ার পর পাকবাহিনী জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলের সহযোগিতা নিয়ে ঝিনাইগাতী থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা উপজেলার (কয়েরোড) জুলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় ও পাগলারমুখে ক্যাম্প স্থাপন করে। উপজেলার আহম্মদনগরে একটি ও প্রত্যেক বিওপিতে একটি করে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এগুলোর মধ্যে হাতিপাগার ক্যাম্প, বারোয়ামারী ও ধানোয়া কামালপুর ক্যাম্প বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।
ঝিনাইগাতী থানায় স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকায় অনেকে সক্রিয় ছিল। তাদের মধ্যে সেকান্দর আলী (জরাকুড়া), হোসেন আলী মুন্সি (খৈলকুড়া), গুজরত আলী (ভারুয়া), আব্দুর রহমান (ফাকরাবাদ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ইউনিয়নভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা হলো- ঝিনাইগাতী ইউনিয়ন: মাওলানা সুরুজ্জামান (দিঘীর পাড়; শান্তি কমিটি-র সদস্য), সুফি আক্কেল আলী (দিঘীর পাড়; শান্তি কমিটির সদস্য), আশরাফ আলী খলিফা (ঝিনাইগাতী; রাজাকার কমান্ডার), উসমান আলী (ঝিনাইগাতী; আলবদর- রাজাকার), আ. হক মাস্টার (ঝিনাইগাতী; রাজাকার), হাজী আব্দুল আলী (ঝিনাইগাতী ব্রিজপাড়; রাজাকার), আজিজুর রহমান মেম্বার (সালধা; শান্তি কমিটির সদস্য), কারী আনোয়ার হোসেন (ঝিনাইগাতী বাজার; শান্তি কমিটির সদস্য), হোসেন আলী মুন্সি (বন্ধভাটপাড়া; শান্তি কমিটির সদস্য), সুরত আলী (বন্ধভাটপাড়া; রাজাকার), খোরশেদ আলী (বনকালি; রাজাকার), ছলিম উদ্দিন (ঝিনাইগাতী; শান্তি কমিটির সদস্য), আফাজ উদ্দিন (কালিনগর; শান্তি কমিটির সদস্য), সামছুল আলম (সালধা; শান্তি কমিটির সদস্য), আলু সমদ আলী মেম্বার (রামনগর; শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি), আ. সামাদ মোল্লা (ঝিনাইগাতী; শান্তি কমিটির সদস্য), সেকান্দর আলী (জড়াকুড়া; রাজাকার), অছিম উদ্দিন (কালিনগর; রাজাকার কমান্ডার), জাহের আলী রামনগর; রাজাকার কমান্ডার), ফজল হক (খৈলকুড়া; আলবদর বাহিনী), নুরুল হক (পিতা কেরামত আলী, খৈলকুড়া; আলবদর বাহিনী), আ. হাকিম (প্রতাবনগর; আলবদর), মো. বদর হোসেন (নয়াগাঁও; শান্তি কমিটির সদস্য), এস এম তামিজ উদ্দিন ওরফে আরফান আলী (ঝিনাইগাতী বাজার; রাজাকার), জয়নাল আবেদিন খান (ঝিনাইগাতী বাজার; আলবদর সদস্য), তমসের আলী খান (ঝিনাইগাতী বাজার; আলবদর সদস্য), আশরাফ আলী খোকা (ঝিনাইগাতী বাজার; রাজাকার), খলিলুর রহমান অনু (পিতা সমছ উদ্দিন সহকার, ঝিনাইগাতী বাজার; রাজাকার), আহম্মদ মুন্সী (পিতা সমছ উদ্দিন সহকার, জড়াকুড়া; শান্তি কমিটির সদস্য), সৈয়দ জামান (পিতা সমছ উদ্দিন সহকার, পাইকুড়া; শান্তি কমিটির সদস্য); কাংশা ইউনিয়ন: আ. রহমান (পানবর; আলবদর বাহিনীর সদস্য), হাফিজুর রহমান (আয়নাপুর; শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), আ. সামাদ (আয়নাপুর; রাজাকার বাহিনীর সদস্য), হযরত আলী (দুপুরিয়া; শান্তি কমিটির সদস্য), ঈমান আলী (দুপুরিয়া; শান্তি কমিটির সদস্য), আ. রহমান (বাকাকুড়া; রাজাকার), নুরুল হক (বাকাকুড়া; রাজাকার), আফছার আলী (বাকাকুড়া; রাজাকার), আবুল হোসেন কমান্ডার (বাকাকুড়া; রাজাকার বাহিনী), আ. হক (গান্দিগাও; শান্তি কমিটির সদস্য), আ. মজিদ মুন্সি (দুধনই; শান্তি কমিটির সদস্য), তোফাজ্জল হক পদু (কুচনীপাড়া; শান্তি কমিটির সদস্য), আশ্রাব আলী (গান্দিগাঁও; শান্তি কমিটির সদস্য), আ. খালেক (তাওয়াকুচা; আলবদর বাহিনী), হযরত আলী (তাওয়াকুচা; রাজাকার); নলকুড়া ইউনিয়ন: আ. ছালাম (শালচূড়া; আলবদর সদস্য), হযরত আলী মেম্বার (শালচূড়া; রাজাকার কমান্ডার), প্রতাব আলী খা (নলকুড়া; রাজাকার), মৌলভী মোহাম্মদ আলী (হলদীগ্রাম; শান্তি কমিটির সদস্য), আবুল কাসেম (রাংটিয়া; রাজাকার), আ. রহমান (ফাকরাবাদ; রাজাকার), গুজরত আলী (ভারুয়া, রাজাকার); গৌরিপুর ইউনিয়ন: মৌলভী আ. হক (গজারীকুড়া; শান্তি কমিটির সদস্য), আ. আজিজ (বনগাও; আলবদর), মো. মোহাম্মদ আলী (হলদী বাটা; কুখ্যাত খুনি); হাতিবান্দা ইউনিয়ন: হাছেন আলী (হাতীবান্দা; রাজাকার), জমসেদ আলী (হাতীবান্দা; রাজাকার); মালিঝিকান্দা ইউনিয়ন : আবুল কাসেম (রাংগামাটিয়া; রাজাকার), মো. জালাল উদ্দিন (রাংগামাটিয়া, খাটুয়াপাড়া; রাজাকার), আব্দুল হক (রাংগামাটিয়া, খাটুয়াপাড়া; রাজাকার সদস্য) এবং ধানশাইল ইউনিয়ন: মমিন উদ্দিন মুন্সি (উত্তর দাড়িয়ার পাড়; শান্তি কমিটির সদস্য), ছলিম উদ্দিন খা (উত্তর দাড়িয়ার পাড়; রাজাকার)।
পাকবাহিনী ঝিনাইগাতীতে ক্যাম্প স্থাপন করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য পাকবাহিনীর কাছে সরবরাহ করত। গ্রামের নারীদের জোরপূর্বক পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যেত। তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে খাবার সংগ্রহ করে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। তাছাড়া গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি সাধারণ মানুষের বাড়ি থেকে নিয়ে হানাদারদের ক্যাম্পে দেয়া এদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ ছিল।
পাকবাহিনী রাজাকার, আলবদর ও জামায়াতে ইসলামীর দালালদের সহযোগিতা নিয়ে এলাকায় গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনসহ নানা অমানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের ১২ বছরের কিশোর পুত্র আব্দুল খালেককে রাজাকাররা ধরে আহম্মদনগর ক্যাম্পে নির্যাতনের পর হত্যা করে। এছাড়া রাজাকাররা ছুটি মণ্ডলকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে ধরে নিয়ে একই ক্যাম্পে প্রথমে অমানুষিক নির্যাতন এবং পরে হত্যা করে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ- পশ্চিমে অবস্থিত একটি নিভৃত গ্রাম জগৎপুর। রাজাকার কমান্ডার সেকান্দর আলীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী ৩০শে এপ্রিল এ গ্রামের হিন্দুপাড়ায় অতর্কিতে হামলা করে। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৫৮ জন লোককে হত্যা করে।জগৎপুর গণহত্যা- শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধে একটি আলোচিত ঘটনা। গণহত্যার পর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা হিন্দুপাড়ায় ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। শেরপুর শহর থেকে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে আশ্রয়গ্রহণকারী অনেক হরিজন একইদিন পাকবাহিনীর হামলার শিকার হয়। পাকবাহিনী এখানে গুলি করে ৪ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
রাঙ্গামাটির খাটুয়াপাড়া গ্রামের ছকিনা খাতুন এবং রাবেয়া খাতুন ও তার স্বামীকে ধরে নিয়ে এসে কয়েরোড জুলগাঁও নামক স্থানে নির্যাতন করে। পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে লাশ জুলগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্বে মাটিচাপা দেয়। ঝিনাইগাতী সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে পুরুষ উত্তমখিলা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হাজীর বাড়িতে রাজাকার ও পাকবাহিনী অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। জগতপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় অগ্নিসংযোগ করে পুরো পাড়া জ্বালিয়ে দেয়।
ঝিনাইগাতী থানার অন্তর্গত জুলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। ঝিনাইগাতী বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত সিএম রোডসংলগ্ন আহম্মদনগরেও নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল।
ঝিনাইগাতীতে কাদেরিয়া বাহিনী-র কিছু সদস্য ছিলেন, যেমন— নকান্ত সাংমা (বনকালি), দুই সহোদর আলবার্ট সাংমা ও নরবার্ট সাংমা (মরিয়মনগর), মোজাম্মেল হক (গজারিকুড়া), রবীন্দ্র মারাক (মরিয়মনগর), কনডেড সাংমা (মরিয়মনগর) এবং ভিসাং সাংমা (মরিয়মনগর)। ঝিনাইগাতী থেকে ১০ কিমি দক্ষিণে রয়েছে জুলগাঁও বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমি সরকারিভাবে চিহ্নিত। আহম্মদনগর পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের দক্ষিণ ও উত্তর পার্শ্বে গণকবর আছে। জুলগাঁও ক্যাম্পের পূর্ব পার্শ্বে অনেক মানুষের লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর এসবের সন্ধান পাওয়া যায়।
কমান্ডার সুবেদার আব্দুল হাকিম ও নায়েব সুবেদার মালেকের নেতৃত্বে ঝিনাইগাতী থানার নকশি বিওপি আক্রমণ করা হয়। পাকবাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে আব্দুর রাজ্জাক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এ-যুদ্ধ পরিচালিত হয়।
৫ই জুলাই রাতে কমান্ডার নাজমূল আহসানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কাটাখালী ব্রিজ ধ্বংস করেন। এ-সময় পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গামাটি গ্রামের হাসান আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। রাজাকার জালাল মিস্ত্রীর সহায়তায় ৬ই জুলাই পাকবাহিনীর প্রায় ২০০ সদস্য ও রাজাকাররা রাঙ্গামাটি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। রাঙ্গামাটি যুদ্ধ-এ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী আলী হাসান, বাদশা মিয়া, আব্বাস উদ্দিন, ফজলু হুদি ও আইতুল্লাসহ অনেকে নিহত হন। এ-যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে নাজমূল আহসান- (কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)-সহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
৩রা আগস্ট নকশি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। এটি ছিল শেরপুর জেলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ। ৪ঠা ডিসেম্বর ঝিনাইগাতী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
ঝিনাইগাতী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সাইফুর রহমান (নাচন মুহরী), রফিকুল ইসলাম (শমসচোরা), আলফাজ উদ্দিন (জগতপুর), নূর মোহাম্মদ (ধানশাইল), পরিমল চন্দ্র দে, মোফাজ্জল হোসেন এবং আব্দুর রাজ্জাক। ঝিনাইগাতী উপজেলা থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে মেঘালয় সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে (গজনী অবকাশের উত্তর পাশে) মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। জুলগাঁও বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদ চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি নামফলক রয়েছে। [ছালমা আক্তার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড