You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.25 | ঝুনাহার প্রতিরোধযুদ্ধ (বরিশাল সদর) - সংগ্রামের নোটবুক

ঝুনাহার প্রতিরোধযুদ্ধ (বরিশাল সদর)

ঝুনাহার প্রতিরোধযুদ্ধ (বরিশাল সদর) সংঘটিত হয় ২৫শে এপ্রিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এ-যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন এবং হানাদার বাহিনী বরিশাল শহর দখল করে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের প্রতিটি জেলা ও থানায় জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৫শে মার্চ হানাদার বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে সংগ্রাম কমিটি জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান, পুলিশ সুপার ফকরুদ্দিন আহমেদ, এসআই বাদশা মিয়া, হাবিলদার আকবরসহ অন্য পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় এদিন গভীর রাতে বরিশাল পুলিশ লাইন্স অস্ত্রাগারে রক্ষিত সকল অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ হস্তগত করেন। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর এদিন সকাল ১০টায় পুলিশ সুপারের বাসভবনে এখানকার নেতৃবৃন্দ এবং জেলা প্রশাসনের সকল বিভাগের প্রধানদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত সকলেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের অঙ্গীকার করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে দক্ষিণ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, যা দক্ষিণ বাংলা স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ নামে পরিচিত। বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এ পরিষদের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরিষদের সভায় জরুরিভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন এবং পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ-র নেতৃত্বে ঝুনাহারের নিকটস্থ তালতলী আমিন বাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মেহেদী আল ইমামসহ মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী তালতলী এলাকার ঝুনাহার ভারানীর পাড়ে ট্রেঞ্চ খনন করে অবস্থান নেন। তাঁরা এখানে পাকিস্তানি জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ঝুনাহারের পশ্চিম পাড়ে হবিনগর গ্রামের ওয়াজেদ হাওলাদারের বাড়ি, পূর্বপাড়ে রাজাপুর, দক্ষিণ পাড়ে ফোটকার চর, অপর একটি গ্রুপ নাজির বাড়ি স্কুল এবং বেলতলায় অবস্থান নেন। তাঁরা আইডব্লিউটিসি-র প্যাসেঞ্জার প্যাডেল জাহাজ ‘মাজবী’ এবং ‘ইরানী’ এ দুটিকে ঝুনাহারের নদীমুখে নোঙর করিয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ১৭ই এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় বেলস্ পার্কে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী প্রায় ২৫ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে একজন পাকিস্তানি গোয়েন্দাকে গুলি করে হত্যা করেন।
হানাদারদের প্রতিরোধে সংগ্রাম কমিটি গঠন, জেলা পুলিশ লাইন্সের সকল অস্ত্র সংগ্রহ, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, প্রকাশ্যে একজন পাকিস্তানি চরকে গুলি করে হত্যা করা এসব কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর ধারণা জন্মায় যে, বরিশালে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই সংগঠিত এবং শক্তিশালী। এজন্য প্রচুর শক্তি সঞ্চয় করে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রায় এক মাস পর তারা বরিশালে অভিযান চালায়। ১৮ই এপ্রিল হানাদার বাহিনীর জঙ্গি বিমান প্রথমে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালায়।
২৫শে এপ্রিল ভোররাতে মুলাদী পিসিও থেকে ট্রাঙ্কলের মাধ্যমে মুলাদীর একজন মুক্তিযোদ্ধা বরিশালের উদ্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর মুলাদীর নন্দীর বাজার অতিক্রমের খবর বরিশালের নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেন। এদিনই প্রত্যুষে পিরোজপুর থেকে টিএন্ডটি কলের মাধ্যমে খবর আসে যে, পাকিস্তানি গানবোট পিএনএস যশোর বরিশাল অভিমুখে রওনা হয়েছে। এ খবর পেয়ে স্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের বেসামরিক বিভাগের প্রধান নূরল ইসলাম মঞ্জু এমএনএ, মেজর কামাল উদ্দিন ফিরু, সরদার জালাল, ওবায়দুর রহমান মোস্তফা, মীর মোস্তাক হোসেন সেন্টু, নূরুল আলম ফরিদ প্রমুখ কন্ট্রোল রুমে একত্রিত হন। তাঁরা মাইকযোগে শহরের সাধারণ লোকজনকে শহর ত্যাগ করে গ্রামে-গঞ্জে আশ্রয় নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেন। হানাদার বাহিনী নৌ, সড়ক ও আকাশ পথে একযোগে বরিশালের দিকে অগ্রসর হয়। ২৫শে এপ্রিল হানাদার বাহিনীর ৩টি গানবোট বরিশালের উদ্দেশে ঝুনাহার অতিক্রমকালে ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ ও ক্যাপ্টেন মেহেদী আল ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর পেয়ে নূরল ইসলাম মঞ্জু এমএনএ, মেজর কামাল উদ্দিন ফিরু, লেফটেন্যান্ট নাসির ও মুজিবুর রহমান কাঞ্চন এ-যুদ্ধে অংশ নেন। হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে তাঁরা বেশি সময় টিকতে পারেননি। তাদের গোলাবর্ষণে ‘মাজবী’ এবং ‘ইরানী’ জাহাজ দুটি ডুবে যায়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব আকন্দ (ইছাকাঠী) ও সিপাহি সিরাজুল ইসলাম (স্যারাল, গৌরনদী) শহীদ এবং মেজর কামাল উদ্দিন ফিরু আহত হন। দুপুরের দিকে হানাদার বাহিনী জঙ্গি বিমানের সাহায্যে ঝুনাহারের নিকট চরবাড়িয়া এলাকায় ছত্রীসেনা অবতরণ করায় এবং গণহত্যা চালায়। অপরদিকে হানাদার বাহিনীর অপর একটি দল একই দিন সড়ক পথে বরিশালে অনুপ্রবেশ করে। এ-সময় গৌরনদীর কটকস্থলে তাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধযুদ্ধ হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড