You dont have javascript enabled! Please enable it!

টগরাইহাট বড়পুল যুদ্ধ (কুড়িগ্রাম সদর)

টগরাইহাট বড়পুল যুদ্ধ (কুড়িগ্রাম সদর) সংঘটিত হয় ১৫ই এপ্রিল। এতে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয়। অপরপক্ষে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
তিস্তা রেলস্টেশন থেকে কুড়িগ্রাম রেলস্টেশন পর্যন্ত রেল ও সড়ক পথের সবচেয়ে বড় ব্রিজ হচ্ছে বোয়ালিয়া ব্রিজ। ব্রিজটি বড় হওয়ার কারণে এটি বড়পুল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রংপুর থেকে রেলপথে কুড়িগ্রামে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করে। ঐদিন তারা কুড়িগ্রাম নতুন রেলস্টেশনে নেমেই এসডিও অফিস, থানা ও জেলখানা এলাকায় অগ্রসর হয়। ছাত্রনেতা এস এম হারুন-অর-রশীদ লালের নেতৃত্বে আমিনুল রহমান আলম, নুরুন্নবী সরকার (পলাশবাড়ী), খলিলগঞ্জের জসিমুদ্দিন, আব্দুল আউয়াল মনু, মতিউল ইসলাম চৌধুরী, পুরাতন শহরের ছাত্রলীগ নেতা রুকুনুদৌলা, নুর ই ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম টুকু, মমিনুল ইসলাম মঞ্জু, আমানুল্লাহ আহমেদ, মোগলবাসার এমদাদুল হক এমদাদ, ছাত্র ইউনিয়ন- (মেনন)-এর মীর আলী আখতার সাজু, মামনুন ইলাহী কাজলসহ বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবক এবং মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে আনসারের আব্দুল করিম মধু, আলাউদ্দিন ওরফে শিয়াল বাচ্চু, আবদার হোসেন, বয়েজ উদ্দিন, ইপিআর সদস্য গণি প্রমুখ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকবাহিনী ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে, তবে প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে তারা নতুন রেলস্টেশনে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পিছু হটে তারা রেলস্টেশনের পাশের গ্রামে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে বেলগাছার জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ছফর উদ্দিন, আলহাজ্ব সজর উদ্দিন, ফেইচকা হাজী, কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা সাহাবুদ্দিন, কুড়িগ্রাম কলেজের ছাত্র আব্দুল লতিফ, পোয়াতু মামুদ, বরিজ উদ্দিন, ভোলানাথসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের খবর কুড়িগ্রাম, খলিলগঞ্জ, ত্রিমোহনী, মুক্তারাম, হরিরাম, জোতগোবর্ধন, টগরাইহাট এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে মানুষ ফুঁসে ওঠে। বিশেষ করে জনপ্রিয় চিকিৎসক ডা. ছফর উদ্দিনের হত্যাকাণ্ড এলাকাবাসীকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে। ফলে টগরাইহাট এলাকার সন্তান ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আব্দুস সালামের নেতৃত্বে নুরুল আমিন সরকার, জয়নাল আবেদিন, আফতাব হোসেন সরকার, আমজাদ হোসেন সরকার, ফজলুল হক-সহ প্রতাপ, জয়দেব হায়াত, কেন্দ্রা, দুধখাওয়া ও জোতগোবর্ধন এলাকার বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবক দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বোয়ালিয়া ব্রিজের দক্ষিণ পাশের বিলে অবস্থান নেয়। বোয়ালিয়া ব্রিজের যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয় ১৫ই এপ্রিল সকালবেলা। এ-সময় পাকিস্তানি সৈন্যবাহী একটি ট্রেন কুড়িগ্রাম যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ছিল ফেরার পথে ট্রেনটিকে আক্রমণ করবেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে কুড়িগ্রাম নতুন রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার শব্দ পেয়েই সমবেত ছাত্র- জনতা বোয়ালিয়া ব্রিজের একেবারে কাছে এসে পজিশন নেয়। ট্রেনটি যখন ব্রিজের ওপর ওঠে তখনই আব্দুস সালামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-জনতা ট্রেনটিতে সম্মিলিত আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই অতর্কিত আক্রমণের মুখে পাকসেনারা ট্রেনটি থামিয়ে পাল্টা গুলি বর্ষণ শুরু করে। ইতোমধ্যে রাত হয়ে এলে পাকসেনারা অন্ধকারে সামনের দিকে আর অগ্রসর হয়নি। পাকিস্তানিরা বড়পুলের পাড়ে আটকা পড়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে কুড়িগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আলাউদ্দিন ওরফে শিয়াল বাচ্চু, ঈসমাইল হোসেন, আলম, মজিবর রহমান, কালু, হবিবর রহমান, আবদার রহমান, নজরুল ইসলাম, আবদার হোসেন প্রমুখ আনসার সদস্য, ছাত্রনেতা হারুন অর রশীদ লালের নেতৃত্বে খলিলগঞ্জ এলাকার আমিনুর রহমান আলম, নুরুন্নবী সরকার, জসিমুদ্দিন সরকার, রুহুল আমিন, আব্দুল আউয়াল মনুসহ খলিলগঞ্জ, কালে, পলাশবাড়ী, হরিরাম, মুক্তারাম, জোতগোবর্ধন, ত্রিমোহনী এলাকার বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবক বড়পুলের পাড়ে গিয়ে প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এভাবে আনসার বাহিনীর সদস্য ও ছাত্র-যুবকরা এসে যোগ দিলে পরিস্থিতি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অনুকূলে আসে। তারা সারারাত ইট-পাটকেল ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ট্রেনে উপর্যুপরি আক্রমণ করে ট্রেনটিকে ঝাঁঝরা করে দেন। ১৬ই এপ্রিল ভোরবেলা কাউয়াহাগা ঘাট দিয়ে ধরলা নদী অতিক্রম করে ইপিআর-এর সুবেদার মেজর আরব আলীর নেতৃত্বে একটি প্রশিক্ষিত টিম ভারী অস্ত্রসহ হানাদারদের বিরুদ্ধে বোয়ালিয়ার যুদ্ধে অংশ নিতে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাদের পৌঁছার পূর্বেই পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল বদল করেন। সেই সুযোগে পাকসেনারা রেললাইনের ঢালু অংশ ধরে দেড় কিলোমিটার দূরে নাওডারা বিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে করে তিস্তার দিকে পালিয়ে যায়। বোয়ালিয়ার যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয়। জয়নাল, আমজাদ হোসেনসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং আনসার সদস্য আলাউদ্দিন ওরফে শিয়াল বাচ্চু কণ্ঠনালীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পাকসেনাদের কুড়িগ্রাম শহর দখল করার পূর্বে রংপুর জেলায় নিরস্ত্র জনতার সম্মিলিত শক্তির সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল বোয়ালিয়ার যুদ্ধ বা বড়পুলের যুদ্ধ। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!