টঙ্গী গণহত্যা (গাজীপুর সদর)
টঙ্গী গণহত্যা (গাজীপুর সদর) ৫ই মার্চ থেকে শুরু হয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে একাধিকবার সংঘটিত হয়। এতে শতাধিক মানুষ শহীদ হয়।
৫ই মার্চ টঙ্গীতে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের দমন- পীড়নের প্রতিবাদে কাজী মোজাম্মেল হক, হাসান উদ্দিন সরকার এবং আহসানউল্লাহ মাস্টারের নেতৃত্বে এক শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে হানাদারদের সহযোগী বাহিনীর গুলিতে মেঘনা টেক্সটাইল মিলের মোতালেব, রইচউদ্দিন, ইস্রাফিলসহ চারজন শ্রমিক শহীদ হন, যা ছিল হানাদার বাহিনী দ্বারা এ অঞ্চলের প্রথম হত্যাকাণ্ড। ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর পাকিস্তানি বাহিনীর গাজীপুর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টঙ্গীতে এলাকাবাসী বেড়িকেড দেয়। তারা তুরাগ নদীর ওপর কাঠের ব্রিজ পুড়িয়ে ফেলে এবং কনক্রিটের ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। ২৭শে মার্চ হানাদার বাহিনী প্রথমে টঙ্গী দখল করে টেলিফোন শিল্প সংস্থায় ঢাকা উত্তর জোনের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করে। টঙ্গীতে হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক ছিল মেজর আরিফ। এ হেডকোয়ার্টার্স থেকে তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা, জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকায় কার্যক্রম চালাত। তুরাগ নদী পার হয়ে তারা প্রথমেই টঙ্গী বাজার এবং বাজার সংলগ্ন পেট্রোল পাম্পে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাদের গুলিবর্ষণে অনেকে আহত হয়। এ সময় হানাদারদের আক্রমণে ২০- ২৫ জন শ্রমিক প্রাণভয়ে দৌড়ে রেল স্টেশনের পূর্বদিকে বিসিক শিল্প এলাকায় নির্মাণাধীন পেসোসকার ফ্যাক্টরির দিকে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি ছুড়তে-ছুড়তে সামনের দিকে এগুতে থাকলে শ্রমিকরা উক্ত ফ্যাক্টরির প্লটে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের নিচে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা ট্রাকটি ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ করে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এতে প্রায় ২০ জন মানুষ শহীদ হন। পরবর্তীতে শহীদদের বিসিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এদিনের গণহত্যায় শহীদ কয়েকজনের নাম জানা যায়। তারা হলেন- মো. আবদুল মান্নান, মো. আল আমিন, মো. আবদুল হান্নান ও মো. হাবিবুল্লাহ। গণহত্যার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করলে স্থানীয়রা শহীদদের লাশ বিসিক কবরস্থানে সমাহিত করে। একই দিন হানাদার বাহিনী টেলিফোন শিল্প সংস্থার মো. বদিউল আলম ও বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের মো. মোশাররফ হোসেনকে হত্যা করে। বিকেলের দিকে তারা টঙ্গী বাজার ও আবদুল্লাহপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ করে। ১৭ই এপ্রিল হানাদার বাহিনী আরিচপুরে গণহত্যা চালিয়ে ৩০ জনের মতো মানুষকে হত্যা করে (দেখুন -আরিচপুর গণহত্যা)। ২৫শে এপ্রিল টঙ্গী জুট মিলস-এর চিকিৎসক ডা. সুলেমান খানকে স্থানীয় মুসলিম লীগের ভাড়াটে গুণ্ডারা নিজবাড়ি চাঁদপুরে নির্মমভাবে হত্যা করে। টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি স্কুল প্রাঙ্গণের তালতলায় এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ২ রা মে হানাদার বাহিনী পগারে সৈয়দ সরওয়ার হুম্মান হায়দার ও তার দুই বোনের জামাই শহীদুল হক এবং মোজাহার আসহান চৌধুরীকে নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৬শে সেপ্টম্বর পিপলস সিরামিকসের চিকিৎসক ডা. আতিকুর রহমানকে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। ৪ঠা ডিসেম্বর বাটা সু কোম্পানিতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে গোলাম কিবরিয়া ও আবদুস সোবহান শহীদ হন। সব মিলিয়ে টঙ্গীতে শতাধিক মানুষ শহীদ হন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড