You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.07 | টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) - সংগ্রামের নোটবুক

টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা)

টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ (দেবহাটা, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ৭ই জুন। ৭১-এ সাতক্ষীরা মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে এটি একটি। এতে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
দেবহাটা থানার পাশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে ইছামতি নদী প্রবাহিত। নদীতীরবর্তী একটি গ্রামের নাম টাউন শ্রীপুর। ১৮৬৭ সালে দেবহাটাকে পৌরসভা করার পর এর মূল কর্মকাণ্ড শ্রীপুর থেকেই পরিচালিত হতো। সে সময় উন্নত রাস্তা, আলো ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থাসহ নগর জীবনের অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকায় এ জনপদের নাম হয় টাউন শ্রীপুর। টাউন শ্রীপুর সংলগ্ন ইছামতি নদীর অপর পাড়ে পশ্চিম বাংলার টাকি পৌরসভা। এখানে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার (মোহাম্মদ শাহজাহান)-এর নেতৃত্বে একটি বড় অপারেশন ক্যাম্প গড়ে ওঠে। নবম সেক্টরের অধিকাংশ অপারেশন এ ক্যাম্প থেকে পরিচালিত হয়।
শাহজাহান মাস্টারের বাড়ি টাউন শ্রীপুর গ্রামে। তিনি টাউন শ্রীপুর শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সে কারণে এলাকার বহু তরুণ ছিল তার ছাত্র। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তিনি সকলকে সংগঠিত করে নবম সেক্টরের অধীনে একটি সাব-সেক্টর গড়ে তোলেন। তিনি জানতে পারেন পাকবাহিনী প্রায়ই দেবহাটা থেকে টাউন শ্রীপুরে এসে নানারকম অত্যাচার করে এবং জনসাধারণের গরু, ছাগল ইত্যাদি ধরে নিয়ে যায়। এতে গ্রামবাসীরা খুবই অতীষ্ঠ হয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে তিনি সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলের সঙ্গে আলাপ করেন। সিদ্ধান্ত হয় একদিন রাতে দেবহাটায় অবস্থিত পাকসেনাদের বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপসহ স্টেনগান ও এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ার করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়, যার দলনেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার এবং তাঁর সহকারী ছিলেন স ম বাবর আলী। তাঁদের সঙ্গে আরো ছিল লুৎফর রহমান সরদার, এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী (হাবলু), নাজমুল আরেফিন, শামসুজ্জোহা খান কাজল, আব্দুর রশিদ, আব্দুল হামিদ, আব্দুল গণি, আবুল কাশেম, হাফিজুর রহমান, শেখ আব্দুল জলিলসহ ৩০-৩৫ জনের একটি দল।
৬ই জুন রাতে টাকি থেকে তিনটি দল পৃথক-পৃথক দায়িত্ব নিয়ে ইছামতি নদী পার হয় এবং তিন দিকে যাত্রা করে। টাউন শ্রীপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলটি সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন সকালে তারা পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাবে। এজন্য রাতের মধ্যেই রেকি সম্পন্ন করে তারা ইছামতি নদীর তীরবর্তী কেদার মাঠের পশ্চিমে অবস্থিত আহম্মদ আলি মিস্ত্রির পরিত্যক্ত বাড়ির তিনটি ঘরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পাকবাহিনী তাদের গুপ্তচর মারফত মুক্তিবাহিনীর আগমন, অবস্থান ও পরিকল্পনার কথা জেনে যায়।
৭ই জুন ভোরবেলা। সকলে তখনো নিদ্রাচ্ছন্ন। শুধু জেগে আছেন দলনেতা শাহজাহান মাস্টার, স ম বাবর আলী ও লুৎফর রহমান সরদার। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁরা দেখতে পান দুজন সৈন্য বাড়িতে প্রবেশ করছে। তাদের পেছনে ৫০-৬০ জনের মতো সশস্ত্র পাকসেনা সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে। এ দৃশ্য দেখে তাঁরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তাঁরা সবাইকে জাগাবার চেষ্টা করেন এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।
হঠাৎ একটি ঘর থেকে পরপর কয়েকটি গুলি এসে উঠানে দাঁড়ানো এক পাকসেনার গায়ে লাগে। সে লুটিয়ে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয় উভয়পক্ষের গোলাগুলি। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে-করতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ঘরের বাইরে এসে বড়-বড় গাছের আড়ালে, ডোবার মধ্যে ও জলাশয়ের ধারে পজিশন নেন এবং গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার, লুৎফর রহমান সরদার ও স ম বাবর আলীও বেরিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। উভয়পক্ষই ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। শত্রু-মিত্র যেন মিশে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধের কোনো কৌশলই কাজে লাগেনি। স্ব-স্ব অবস্থান থেকে যে যার মতো যুদ্ধ করে যায়। দু-পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে জানতে পেরে ইছামতি নদীর ওপারে ভারতের টাকি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অপর মুক্তিযোদ্ধারা কামান থেকে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। তবে এ আক্রমণ সেমসাইড হয়ে যেতে পারে ভেবে বন্ধ রাখা হয়।
টাউন শ্রীপুর যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তন্মধ্যে সাতক্ষীরা শহরের নাজমুল আরেফিন খোকন, শামসুজ্জোহা খান কাজল, আবুল কালাম ইঞ্জিনিয়ার, পাইকগাছা-র নারায়ণ চন্দ্র ধর ছিলেন। সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল গ্রামের এরশাদ হোসেন খান চৌধুরী (হাবলু) এ-যুদ্ধে আহত হন। তাঁর পেটে কয়েকটি গুলি লাগে। তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ-যুদ্ধে ২০ জনের মতো খানসেনা নিহত হয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা মহকুমার বিভিন্ন থানায়। খুলনার পাইকগাছা থানারও দু-একজন ছিলেন। [সিরাজুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড