মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু জ্যোতিঃপাল মহাথের
জ্যোতিঃপাল মহাথের (১৯১৪-২০০২) বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। বৌদ্ধদের দশম সংঘরাজ পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথেরোর জন্ম ১৯১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার বরইগাঁওয়ের কেমতলীতে। মাতা দ্রৌপদীবালা সিংহ ও পিতা চন্দ্রমণি সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র জ্যোতিঃপাল মহাথেরোর পারিবারিক প্রদত্ত নাম দ্বারিকামোহন সিংহ।
১৯৩৩ সালে ১৯ বছর বয়সে তিনি আগারিক জীবন থেকে অনাগারিক জীবনে পদার্পণ করেন। তখন তাঁর নাম রাখা হয় জ্যোতিঃপাল শ্রমণ। অতঃপর তিনি ১৯৩৮ সালের ১৪ই জুলাই শুভ উপসম্পদা লাভ করে জ্যোতিঃপাল ভিক্ষু নাম ধারণ করেন। বৌদ্ধধর্মে তিনি সুত্ত, বিনয় ও উপাধি ডিগ্রি নেন।
মহামানব গৌতম বুদ্ধের পথনির্দেশিত ‘অহিংসা পরম ধর্ম” – এই মর্মবাণী আত্মস্থ করেও যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিরলসভাবে কাজ করা যায়, তার অনন্য দৃষ্টান্ত জ্যোতিঃপাল মহাথের। বাংলাদেশের ‘বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ’-এর অন্যতম সংগঠক এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত সংগঠনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ১৫ই এপ্রিলের পর লাকসামে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের বীভৎস রূপ দেখে তিনি আগরতলায় আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস-নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির অপরিহার্যতা বিবেচনা করে ২২শে এপ্রিল প্রাচ্যবিদ্যা বিহারে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালি ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ তথা বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের বর্বরতার সচিত্র বিবরণ তুলে ধরেন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগের নেতৃবৃন্দ জহুর আহমেদ চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান, মাহবুব আলম চাষী, এইচ টি ইমাম, আকবর আলী খান প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা এবং সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যা-নির্যাতন-নিপীড়ন, বৌদ্ধবিহার ধ্বংস, ভিক্ষুহত্যা ও লুণ্ঠনের ঘটনা বিশ্বব্যাপী সচিত্র প্রচারার্থে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ইউ থান্ট এবং শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, ব্যাংককস্থ বিশ্ব বৌদ্ধ ফেলোশিপের সভানেত্রী রাজকুমারী পুন পিসমাই ও সাধারণ সম্পাদক আইয়েম সংঘবাসীসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘের আঞ্চলিক শাখা ও বৌদ্ধ সমিতিগুলোর নিকট বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানিদের অমানবিক হত্যা- নির্যাতন-নিপীড়নের দৃশ্যপট তুলে ধরেন এবং তা বন্ধে চাপ সৃষ্টির আবেদন জানান। এদিকে মুজিবনগর সরকার- ও ভারত এশীয় বৌদ্ধ দেশগুলোতে প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জ্যোতিঃপাল মুজিবনগরে উপনীত হয়ে বিদেশ যাত্রার পূর্বে দিকনির্দেশনা নেন। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি আগরতলা থেকে কলকাতা আসেন এবং পরে নয়াদিল্লিতে জগৎজ্যোতি বিহারের অধ্যক্ষ ধর্মবীরিয় মহাথেরোর সহায়তায় ভারতের বৌদ্ধ নেতা ও সংসদ সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২৯শে জুলাই তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীসহ নিরীহ বাঙালি জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানিদের বর্বরতার বর্ণনা দেন। ৭ই আগস্ট এডভোকেট ফকির সাহাবুদ্দিনসহ তিনি শ্রীলঙ্কায় যান। সেখানে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য শ্রীলঙ্কার আকাশপথ বন্ধ করে দেয়ার নিমিত্ত পাঁচ মন্ত্রীর স্বাক্ষরসহ তৎকালীন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন থেকে কলম্বো বিমানবন্দর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের ভোগ্যপণ্য ও যুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আনয়ন বন্ধ হয়। এরপর জ্যোতিঃপাল মহাথের ও এডভোকেট সাহাবুদ্দিন ১১ই আগস্ট থাইল্যান্ড ও ১৬ই আগস্ট জাপানে গিয়ে একই কাজ করেন। ২২শে আগস্ট হংকং হয়ে তিনি নয়াদিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি সেপ্টেম্বর মাসের ১৮-২০ তারিখে নয়াদিল্লিতে তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে ৩১টি দেশের যে-সকল প্রতিনিধি যোগদান করেন, তাঁদের সম্মুখে তিনি পাকিস্তানি জান্তাদের বর্বরতম রূপটি সবিস্তার তুলে ধরেন। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, নেপাল, ভুটান, সিকিম প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সংগঠনে, বিশেষ করে বহির্বিশ্বে বৌদ্ধ রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন আদায়ে বিশেষ অবদান রাখেন।
বৌদ্ধ ধর্মবেত্তা জ্যোতিঃপাল মহাথের শুধু মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকই ছিলেন না, তিনি একাধারে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, বহুভাষাবিদ, সাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজকৰ্মী, সমাজসংস্করক, লেখক-গবেষক, কর্মবীর ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কুমিল্লার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জন্য স্কুল, কলেজ, অনাথালয়; গবেষণাকেন্দ্র, সমবায় সমিতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বৌদ্ধ সংঘরাজ এই ধর্মগুরু বিভিন্ন সময়ে তাঁর কর্মতৎপরতা ও অবদানের জন্য নানা উপাধি, পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘ত্রিপিটক বিশারদ’ উপাধির পাশাপাশি মায়ানমার সরকার কর্তৃক ‘অমহাসদ্ধম্মজ্যোতি কাধ্বজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা সংস্কৃতি ও পালি বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত ‘অভিধর্ম’ উপাধি পরীক্ষায় তিনি স্বর্ণপদক পান। বিশ্বশান্তি, মানবতা ও নিরস্ত্রীকরণে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ তাঁকে ‘বিশ্ব নাগরিক’ উপাধি দেয়। ২০১০ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদক পান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০২ সালের ১২ই এপ্রিল জ্যোতিঃপাল মহাথেরোর মহাপ্রয়াণ ঘটে। [ইমন সালাউদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড