ঝলমলিয়া প্রতিরোধযুদ্ধ (পুঠিয়া, রাজশাহী)
ঝলমলিয়া প্রতিরোধযুদ্ধ (পুঠিয়া, রাজশাহী) সংঘটিত হয় ১২ই এপ্রিল। এদিন ১২ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ক্যাপ্টেন গিয়াস ও ক্যাপ্টেন রশীদের নেতৃত্বে প্রতিরোধযোদ্ধারা ৩১শে মার্চ থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। তাঁরা এ-সময় বিভিন্ন আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। ৩রা এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সেনানিবাসে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ-সময় সেনানিবাস বাদে গোটা রাজশাহী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ অবস্থা কিছুদিন বজায় থাকে। ঢাকা থেকে ২ ডিভিশন পাকিস্তানি সেনা হেলিকপ্টার, ফেরি ও স্টিমার যোগে ১০ই এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাটে এসে পৌঁছায়। এ বাহিনী রাজশাহী শহর দখল করার জন্য মর্টার, কামানসহ বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে রাজশাহীর প্রতিরোধযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তাঁদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন পাবনা থেকে রাজশাহীগামী সেনাদের মোকাবেলা করার জন্য সেনানিবাস এলাকায় যুদ্ধরত ২ কোম্পানি প্রতিরোধযোদ্ধাকে ১১ই এপ্রিল নগরবাড়ির উদ্দেশ্যে পাঠান। কিন্তু সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মুখে তাঁরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করতে থাকেন। পরদিন ১২ই এপ্রিল সোমবার সকালে নিজ বাহিনীর মনোবল অটুট রাখতে ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে পাবনার পথে অগ্রসর হন এবং তাঁর বাকি সৈন্যদের সেনানিবাসের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। তবে তিনি পাবনার পথে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাট থেকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের পর্যুদস্ত করতে- করতে এবং রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর জ্বালাতে-জ্বালাতে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা এদিন দুপুর ২:৩০টা নাগাদ ঝলমলিয়া বাজারে এসে পৌঁছায়। ঝলমলিয়ায় হাটের দিন হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে অনেক ব্যবসায়ী ও ক্রেতা হাটে আসে। পাকিস্তানি বাহিনীকে বহনকারী গাড়ির বহর পূর্ব দিক দিয়ে হাটে প্রবেশ করে। এ- সময় তাদের সামনের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা টানানো ছিল। তা দেখে বাঙালিরা তাদের মুক্তিযোদ্ধা মনে করেছিল। পাকিস্তানিদের এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কিছু সংখ্যক লোক তাদের গাড়ির কাছাকাছি চলে যায়। কিন্তু সৈনিকদের চেহারা দেখে তারা বুঝতে পারে যে, তারা মুক্তিবাহিনী নয়। এ-সময় পাকিস্তানি বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও শেল নিক্ষেপ করে। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। শেলের আঘাতে কারো কারো শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ-সময় আনসার কমান্ডার তৈমুর আলী মুন্সীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জন আনসার ও ইপিআর বাহিনীর সদস্য পুরাতন কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল নিয়ে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি বাহিনীর যাত্রাপথে ঝলমলিয়া সেতুর পশ্চিম পাশে ওঁৎ পেতে থাকেন। কমান্ডার তৈমুর একটি রাইফেল নিয়ে নারকেল গাছের ওপর উঠে শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ করেন। অন্যদের রাস্তার দুপাশে পজিশনে রাখেন। পাকিস্তানি সেনাদের বহর রেঞ্জের মধ্যে এলে তাঁদের রাইফেলগুলো এক সঙ্গে গর্জে ওঠে। তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাণপণে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠেননি। তবে তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর ৮-৯ জন সৈন্যকে এখানে হতাহত করতে সক্ষম হন।
ইপিআর হাবিলদার শফিকুর রহমান ৩রা আগস্ট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে তাহেরপুর ঘাঁটি থেকে পাকিস্তান বাহিনীর ঝলমলিয়াস্থ অগ্রবর্তী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে অগ্রসর হন। তাঁরা ঝলমলিয়া সেতুর নিকট পৌঁছলে এর নিকট অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের চ্যালেঞ্জ করে। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁরা পজিশন নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে পাকিস্তানি সৈনিকদের বন্দুক অকেজো হয়ে যায়। এই ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদে তাহেরপুর ঘাঁটিতে ফিরে যেতে সক্ষম হন।
১২ই এপ্রিল ঝলমলিয়া প্রতিরোধযুদ্ধে ১২ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। তারা হলেন- কৃষ্ণকমল ঘোষ (পিতা পবন চন্দ্ৰ ঘোষ, ঝলমলিয়া), নন্দলাল ঘোষ (পিতা পবন চন্দ্র ঘোষ, ঝলমলিয়া), ভাদন সরদার (পিতা ফকির সরদার, ঝলমলিয়া), রামপদ পাল (পিতা গৌর চন্দ্র পাল, কানাইপাড়া), তৈমুর আলী মুন্সি (পিতা আ. তালেব মুন্সি, কানাইপাড়া), রইস উদ্দিন (পিতা এরফান আলী, জিউপাড়া), রজব আলী (পিতা হুজি প্রমাণিক, ডাঙ্গাপাড়া), আ. রহমান (পিতা আছর উদ্দিন, পাইকপাড়া, নাটোর), উমর আলি প্রমাণিক (পিতা মহিম প্রমাণিক, পাইকপাড়া, নাটোর), ধীরেন চন্দ্র শীল (পিতা টগড় চন্দ্র শীল, পাইকপাড়া, নাটোর), ফয়েজ উদ্দিন মোল্লা (পিতা ফায়জা মোল্লা, ওমর গাছি, বাগাতিপাড়া, নাটোর) এবং আ. মান্নান (পিতা হাবিলদার মনসুর, কদীহগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ)। [মো. ইলিয়াছ উদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড