You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে ঝালকাঠি সদর উপজেলা

ঝালকাঠি সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের শুরুর মাসেই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এক ঐতিহাসিক ভাষণ রাখেন। তাঁর এ ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির সুস্পষ্ট নির্দেশনা। তাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ঝালকাঠি মহকুমা আওয়ামী লীগ-এর নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন মো. আবদুল বারেক এমএনএ, আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. রফিক আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী খান। পাশাপাশি ছাত্রলীগ সভাপতি শামসুল হক আক্কাসকে আহ্বায়ক করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই দুই পরিষদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় স্টেডিয়ামে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ।
ঝালকাঠিসহ সমগ্র বরিশাল জেলায় আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বরিশালে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ- এর বাসায় ১১ই মার্চ একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। সেখান থেকে প্রথম দিকে ঝালকাঠি এলাকার আন্দোলন ও যুদ্ধ- প্রস্তুতি নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ২৩শে মার্চ ঝালকাঠি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ঐদিন থেকেই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঝালকাঠির প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার
তারবার্তা স্থানীয় টেলিগ্রাম অফিস মারফত ঐদিন ভোরবেলা ঝালকাঠিতে পৌঁছানোর সঙ্গে-সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা শামসুল হুদা তারা ও মোস্তফা কামাল খান তা মাইকযোগে প্রচার করেন। এর পরপরই ঝালকাঠির বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রসংগ্রহ ও মুক্তিবাহিনী গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বরিশাল থেকে পাঠানো স্বল্প সংখ্যক ৩০৩ রাইফেল এবং বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰ স্থাপন করা হয়। সেখানে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ঝালকাঠি সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯নং সেক্টরের অধীন বরিশাল সাব-সেক্টরের আওতাধীন ছিল। ৯নং সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম এ জলিল এবং বরিশাল সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, বীর উত্তম-। উপজেলার প্রতিটি থানার দায়িত্ব একজন সামরিক অফিসার বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে দেয়া হয়। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে একজন সহ-অধিনায়ক, প্রত্যেক অঞ্চল ও থানায় একজন সিভিল চিফ, পলিটিক্যাল মোটিভেটর এবং প্রচারক নিয়োগ করা হয়। ঝালকাঠির থানা কমান্ডার ছিলেন সুলতান মাস্টার এবং মজিবুল হক সরদার। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আরো যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, তাঁরা হলেন— এডভোকেট আবদুল বারী, এ বি এম মর্তুজ আলী, ইউসুফ হাওলাদার, ফজলুল হক তালুকদার, শাহজাহান আশ্রাফ, বেলায়েত হোসেন প্রমুখ।
ঝালকাঠি এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল। তার মধ্যে মানিক বাহিনী – বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেশাইনখান গ্রামে ছিল এর প্রধান ঘাঁটি। স্থানীয়ভাবে সংঘটিত যুদ্ধে এ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
২৬শে এপ্রিল পর্যন্ত ঝালকাঠি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২৭শে এপ্রিল বিকেলে হেলিকপ্টার ও গানশিপের সাহায্য নিয়ে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনী ঝালকাঠি শহর দখল করে। এরপর শুরু হয় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, নারীনির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ। পাক হানাদারদের দোসর মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র কর্মীদের উদ্যোগে গঠিত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী তাদের এসব কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে। ঝালকাঠি সদর উপজেলায় পাকবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় সহযোগী ছিল তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার আখতার হোসেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্যান্যদের মধ্যে ছিল ঝালকাঠি শহরের ব্যবসায়ী সলিম উদ্দিন, আদম আলী, মোবারক হোসেন, পোনাবালিয়ার আবদুল আজিজ, চেয়ারম্যান আলী হোসেন, কীর্তিপাশার আবদুর রব মিয়া প্রমুখ।
২৭শে এপ্রিল বিকেলে হানাদার বাহিনী ঝালকাঠি শহরে অগ্নিসংযোগ করে। দুই-তিন দিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা বহুদূর থেকে দেখা যেত। এরপর থেকে ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে বর্বর পাকবাহিনী অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। ঝালকাঠির সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হলো সুগন্ধাতীর বধ্যভূমি। ঝালকাঠি পৌরসভার সম্মুখস্থ সুগন্ধাতীরের এই স্থানে বহুসংখ্যক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। এছাড়া আরেকটি বধ্যভূমি হলো পালবাড়ি বধ্যভূমি। ঝালকাঠি শহরের এ এলাকায় ছিল একটি খাদ্যগুদাম। তার কিছু উত্তরে একটি দ্বিতল ভবনে ছিল পাকসেনাদের নির্যাতনকেন্দ্র। যুদ্ধের ৯ মাস ধরে এখানে বহু লোককে হত্যা করা হয়।
২৩শে মে পাকবাহিনী রমানাথপুর শরীফবাড়ি মসজিদ থেকে নামাজ আদায়রত ১৭ জন মুসল্লিকে ধরে এনে নিকটস্থ পুকুরপাড়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা রমানাথপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। ৪ঠা জুন সকালে পাকবাহিনী রাজাকার ও আলবদরদের নিয়ে পাঁজিপুথিপাড়া গ্রামে হানা দেয় এবং সেখানে ডা. নীহার রঞ্জন শীলসহ ৬০-৭০ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনা পাঁজিপুথিপাড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। ৮ই জুন পাবাহিনী তাদের দোসরদের সহায়তায় ভীমরুলী গ্রামে একটি গণহত্যা চালায়, যাতে ২৮ জন নারী- পুরুষ ও শিশু শহীদ হয়। হত্যার এ ঘটনা ভীমরুলী গণহত্যা নামে পরিচিত। ২০শে জুন পাকবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় বেশাইনখান এলাকায় আরেকটি গণহত্যা চালায়। এতে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং শতাধিক সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এ ঘটনা বেশাইনখান গণহত্যা- নামে পরিচিত। এছাড়া পালবাড়ি গোডাউন ঘাট, খাজুরা খালপাড়, বাউকাঠি, রামচন্দ্রপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়। রাজাকারআলবদরদের সহায়তায় বিভিন্ন এলাকা থেকে নারীদের ধরে এনে শহরের বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে দিনের পর দিন পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
ঝালকাঠিতে যেসব বুদ্ধিজীবী পাক হানাদারদের হাতে নিহত হন, তাঁদের মধ্যে কীর্তিপাশা গ্রামের যতীন্দ্রনাথ কর্মকার, বাদলকাঠি গ্রামের ডা. ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী, শেখের হাটের এডভোকেট মহিউদ্দিন খান, সাংবাদিক শশাংক পাল (মানিক), আবদুল মন্নান হাওলাদার, রমারঞ্জন ভট্টাচার্য, ডা. নীহার রঞ্জন শীল, সন্তোষ কুমার আচার্য, জ্যোতিষ চন্দ্র রায়, কেশব লাল মিস্ত্রীসহ আরো অনেক শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা ছিলেন।
এ এলাকায় পাকবাহিনী ও সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মাদ্রার যুদ্ধ ভীমরুলীর যুদ্ধ ও পেয়ারা বাগানের যুদ্ধ। মাদ্রার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই মে। ঝালকাঠি সদর থেকে পাকবাহিনীর ৪৫ জনের একটি দল লঞ্চযোগে মাদ্রা আসে। এ খবর পেয়ে রেজায়ে সাত্তার ফারুকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন।
উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এতে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ভীত-সন্ত্রস্ত পাকবাহিনী তাদের একজনকে ফেলে রেখেই লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে বন্দি করেন। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কয়েকদিন পরে পাকবাহিনী এখানে গণহত্যা, নারীধর্ষণ ও অগ্নিকাণ্ড চালায়।
ভীমরুলীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় জুন মাসের প্রথমদিকে পাকবাহিনী ঝালকাঠি থেকে এখানে এসে হত্যা ও লুটপাট শুরু করে। এ খবর জানতে পেরে সিরাজ সিকদারের নির্দেশে ফারুক, সেলিম, শাহনেওয়াজ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা তাদের আক্রমণ করলে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। পেয়ারা বাগানের যুদ্ধ হয় জুন মাসে। দু-দফার এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি স্পিডবোট দখল করে নেন। ৭ই ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠি শহরে কারফিউ জারি করে হানাদাররা পালিয়ে যায়। পরের দিন ৮ই ডিসেম্বর সকালে স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে ঝালকাঠি হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- কে এস এ মহিউদ্দিন মানিক, বীর প্রতীক- (পিতা কাজী মনোয়ার হোসেন বীরসেনা, নবগ্রাম), মাজহারুল হক, বীর প্রতীক (পিতা আফছার আলী খান, পারকিপাইকনগর), আব্দুল ওয়াজেদ, বীর প্রতীক- (পিতা ইয়াছিন উদ্দিন হাওলাদার, বিষ্ণুদিয়া, বিনয়কাঠি) ও এ কে এম জয়নাল আবেদীন খান, বীর প্রতীক- (পিতা ছোমেদ আলী খান, ধারাখানা)। মুক্তিযুদ্ধে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁদের মধ্যে মুজিবুল হক মেহেদী-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতনের পরও ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেন। এছাড়া অন্যান্য যাঁরা শহীদ হন, হলেন— রেজাউল করিম আজাদ মানিক (পিতা এ বি এম হাতেম আলী, মানিক নগর; মানিক বাহিনীর প্রধান), মো. এনায়েত হোসেন (পিতা নূর মোহম্মদ, বেশাইনখান), মো. আইয়ুব আলী মিঞা (পিতা আবদুল করিম মিঞা, বাসন্ডা), মো. হারুন-অর-রশিদ (পিতা আবদুল আজিজ হাওলাদার, মির্জাপুর), আবদুর রহিম মোল্লা (পিতা আলিমুদ্দিন মোল্লা, বেশাইনখান), এ কে এম সালাউদ্দিন (পিতা আমজাদ হোসেন মোল্লা, বেশাইনখান), মো. শামসুল আলম (পিতা এ কে এম ওয়াজেদ আলী, পশ্চিম ঝালকাঠি), সাইদুল করিম রতন (পিতা এ বি এম হাতেম আলী, মানিক নগর), এ কে এম শাহজাহান (পিতা শামসুদ্দিন আহমেদ, তেরআনা), হোসেন আলী খান (পিতা মৌজে আলী খান, খাদৈক্ষিরা), হাবিবুর রহমান (পিতা মৌলভী আজাহার আলী মোল্লা, বেশাইনখান), মোবারক আলী (ইপিআর, পার্বতীপুরে শহীদ), দেলোয়ার হোসেন (বেশাইনখান, ইপিআর), মুজিবর রহমান (কমলাপুর; সিপাহি, কুমিল্লার যুদ্ধে শহীদ), মোহাম্মদ মাসুম তালুকদার (পরমহল ; ইপিআর ল্যান্স নায়েক, ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ), সুলতান আহমেদ (বিমান বাহিনীর সদস্য), মোস্তফা কামাল মঞ্জু (পিতা সৈয়দ আবেদ আলী, চাচৈর; ৮ই সেপ্টেম্বর বাউকাঠিতে রাজাকারদের হাতে শহীদ), আনসার আলী খান (পিতা আফতাব আলী খান, মির্জাপুর; নায়েক সুবেদার, ২৭শে নভেম্বর শর্ষিনার যুদ্ধে শহীদ), আবদুস সাত্তার (তারপাশা) এবং মানিক মোল্লা (বেশাইনখান)।
ঝালকাঠি সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেসবের মধ্যে রয়েছে সুগন্ধা নদীর তীর বধ্যভূমিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঝালকাঠি সিটি পার্কে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ‘৭১ এবং রমানাথপুর স্মৃতিফলক। এছাড়া রেজাউল করিম আজাদ মানিকের নামানুসারে বেশাইন খান গ্রামের নাম মানিক নগর, মুজিবুল হক মেহেদীর নামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মেহেদী সড়ক এবং সুগন্ধা বধ্যভূমিতে যাওয়ার রাস্তার নাম শহীদ সরণি রাখা হয়েছে। ঝালকাঠি সদরে সরকারি উদ্যোগে নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা রয়েছে। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!