মুক্তিযুদ্ধে জৈন্তাপুর উপজেলা (সিলেট)
জৈন্তাপুর উপজেলা (সিলেট) সিলেটের পূর্বে ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা জৈন্তাপুর। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ- নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় অর্জন করলে এদেশের বাঙালিরা আশা করেছিল এবার তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। পাক সামরিক সরকার বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে, আশ্রয় নেয় গভীর ষড়যন্ত্রের। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জৈন্তাপুরেও তার প্রভাব পড়ে। এখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। জৈন্তাপুরের মানুষও এর জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট-এর পর ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সারা দেশের মতো জৈন্তাপুরের মানুষও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখায় এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। জুন মাসের প্রথম দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছার জেলার ডাউকিতে এক বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএনএ (সাবেক মন্ত্রী), হাবিবুর রহমান এমপিএ, মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম, আব্দুল হান্নান, ইব্রাহীম আলী (বর্তমান সভাপতি, গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগ), কয়েছ আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। এ বৈঠকের পর জৈন্তাপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেঘালয় ও ইকোয়ানে পাঠানো হয়। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
জৈন্তাপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- কয়েছ আহমদ চৌধুরী, আব্দুল হান্নান, মেজর সি আর দত্ত, সিদ্দিকুর রহমান (জৈন্তা), আবু তাহের,সিরাজ উদ্দিন, আব্দুল গফুর, সুরুজ মিয়া (কেন্দ্রী), মহসিন মিয়া, তেরা মিয়া, আব্দুল জলিল, রশীদ হাওলাদার (খারুবিল), আব্দুস শুকুর (জৈন্তাপুর, সাবেক চেয়ারম্যান), কালা মিয়া (নিজপাট), মজিবুর রহমান প্ৰমুখ।
পাকবাহিনী ২৭শে মে জৈন্তাপুরে প্রবেশ করে এবং জৈন্তাপুর রাজবাড়িতে প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। হেমুগ্রামেও তাদের একটি ক্যাম্প ছিল।
পাকবাহিনী জৈন্তাপুরে প্রবেশ করলে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়রা হলো- টুনু হাজী (বাউরবাগ), আব্দুর রশীদ (লামনী), কটু মিয়া (নিজপাট), বশারত আলী (আসামপাড়া), রশীদ মেম্বার (শানগ্রাম), আম্বিয়া চৌধুরী (নিজপাট), কামাল উদ্দিন, কবির খান, আব্দুল লতিফ চৌধুরী, আবুল হাসনাত চৌধুরী, আব্দুল ন মালেক চৌধুরী, মনির উদ্দিন খন্দকার, শামসুল নূর খন্দকার, গোলাম মোস্তফা, আফতাব উদ্দিন, মৌলবী হাবিব উল্লাহ, মৌলবী উছমান আলী, আয়ুব আলী, তৈয়ব আলী, হাজী সাদেক আলী, রমজান আলী প্রমুখ। এরা লক্ষ্মীপুরের ডা. আব্দুস শহীদের বাড়িতে বসে শান্তি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির সহায়তায় পরে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী।
এই রাজাকাররা পাকসেনাদের সঙ্গে মিলে মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের আত্মীয়-স্বজন ও সাধারণ মানুষদের হত্যা এবং তাদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
ডা. আব্দুস শহীদের বাড়ি এবং জৈন্তাপুর রাজবাড়ি ছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। হরিপুর গ্যাস ফিল্ডের মধ্যেও একটি বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতো। পাকসেনাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজাকাররা নারীদের ধরে আনত এবং রাতভর তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো।
জৈন্তাপুরে একটি গণকবর আছে তামাবিল গণকবর। তামাবিলে পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়ে যেসব মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, তাঁদের এখানে কবর দেয়া হয়। জৈন্তাপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি যুদ্ধ হয়
জৈন্তাপুর রাজবাড়ি যুদ্ধ, হেমুগ্রাম যুদ্ধ এবং বড়গাঙ্গের যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা ৮ই জুলাই রাজবাড়িতে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে ১০-১৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। হেমুগ্রাম যুদ্ধ সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের শেষদিকে। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কর্নেল ভি এন রাও এবং ৫নং সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে সংঘটিত এ-যুদ্ধে কয়েকজন হানাদার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। তাদের কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। অপরপক্ষে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ১০ জন আহত হন। বড়গাঙ্গের যুদ্ধে দুজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১০- ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ১০ই ডিসেম্বর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
জৈন্তাপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ইসমাইল আলী (পিতা মাহমুদ আলী, ডৌডিক), নূর ইসলাম (পিতা আসরাফ আলী, নিজপাট), জাহাঙ্গীর আলম (পিতা হাজী কেরামত আলী, ১নং লক্ষ্মীপুর), ফুল মিয়া (পিতা সুন্দর আলী, ২নং লক্ষ্মীপুর), আব্দুল হালিম (পিতা রুসমত আলী, আসামপাড়া), আব্দুল হামিদ (পিতা আব্দুল খালিক, হাজারী সেন), বাচ্চু মিয়া (পিতা কদম আলী, সেওলার টুক), মনা মিয়া (পিতা কালা গাজী, আসামপাড়া), নূর মিয়া (পিতা মনু মিয়া, গৌরীশংকর), রহমত আলী (পিতা জয়াদ আলী, কেন্দ্ৰী), চম্পক বড়াইক (পিতা চুনীলাল বড়াইক, খান চা- বাগান) এবং মালু মিয়া (পিতা রুশন আলী, আসামপাড়া)। [মৃত্যুঞ্জয় দাস]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড