You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.02 | জিঞ্জিরা গণহত্যা (কেরানীগঞ্জ, ঢাকা) - সংগ্রামের নোটবুক

জিঞ্জিরা গণহত্যা (কেরানীগঞ্জ, ঢাকা)

জিঞ্জিরা গণহত্যা (কেরানীগঞ্জ, ঢাকা) ২রা এপ্রিল সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ নৃশংস গণহত্যায় সহস্রাধিক নিরপরাধ মানুষ শহীদ হন। ঢাকার আশপাশে হানাদার বাহিনী যেসব পরিকল্পিত গণহত্যা চালায়, জিঞ্জিরা গণহত্যা ছিল তার মধ্যে অন্যতম।
জিঞ্জিরা ঢাকা মহানগরের অতি সন্নিকটে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। হিন্দু অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত এ এলাকাটি ছিল আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরুর পর ঢাকা থেকে অনেক মানুষ নদী বিচ্ছিন্ন কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মী ঘাঁটি স্থাপন করে এখান থেকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কেরানীগঞ্জ থানার অবাঙালি পুলিশদের হত্যা করে সকল অস্ত্র দখল করে নেন। এদিন প্রত্যুষে নেতৃবৃন্দ কেরানীগঞ্জে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ সহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতা ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে ভারতে যান।
পাকিস্তানি বাহিনী এসব খবর জানতে পেরে কেরানীগঞ্জের মানুষের ওপর চরম প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১লা এপ্রিল তারা গানবোটে বুড়িগঙ্গা নদীতে টহল দেয় এবং রাতের মধ্যে সমগ্র কেরানীগঞ্জ ঘিরে ফেলে, যাতে কেউ এখান থেকে পালিয়ে যেতে না পারে। মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং এর পার্শ্ববর্তী মসজিদের ছাদের ওপর থেকে পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা এ পরিকল্পিত গণহত্যা পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ করে। ২রা এপ্রিল ফজরের নামাজের পর ফ্লেয়ার ছুড়ে তারা গণহত্যার সংকেত প্রদান করে। ভোর ৫টা থেকে শুরু করে একটানা ৯ ঘণ্টা তারা এ নারকীয় তাণ্ডব অব্যাহত রাখে। এ গণহত্যা পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার রশিদ। জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী এ তিন ইউনিয়নে সংঘটিত এ গণহত্যায় সহস্রাধিক নিরপরাধ মানুষ শহীদ হন।
কেরানীগঞ্জ পৌঁছেই হানাদার বাহিনী প্রথমে জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজারে গান পাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। তারা প্রাণের ভয়ে দিগ্বিদিক ছুটে যাওয়া নিরীহ মানুষদের যাকে যে অবস্থায় পায় হত্যা করতে থাকে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউই এ গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি। গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুণ্ঠনের পাশাপাশি তারা কলেজ পড়ুয়াসহ বেশ কয়েকজন নারীকে নির্যাতন করে এবং তুলে নিয়ে যায়। মান্দাইল পুকুর পাড়ে ৬০ জন নিরাপরাধ মানুষকে একত্রে দাঁড় করিয়ে তারা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। তারা কালিন্দী গ্রামের এক বাড়িতে ১১ জন নারীকে পাশবিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে। এ নির্মম গণহত্যায় জিঞ্জিরা, মনু বেপারীর ঢাল, নজরগঞ্জ, গোলজারবাগ, মান্দাইল, কুশিয়ারবাগ, বড়িশুর, মাদারীপুর প্রভৃতি এলাকা লাশের স্তূপে পরিণত হয়। গণহত্যার পর স্থানীয়রা গণকবরে শহীদদের সমাহিত করে। নজরগঞ্জের একটি গণকবরে নাম-পরিচয়হীন ৫৪ জনকে সমাহিত করা হয়।
গণহত্যার পর এদিন রাতে পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে ‘বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়’ মর্মে খবর প্রচার করা হয়। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জিঞ্জিরা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে মনু বেপরীর ঢালে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড