মুক্তিযুদ্ধে জীবননগর উপজেলা (চুয়াডাঙ্গা)
জীবননগর উপজেলা (চুয়াডাঙ্গা) চুয়াডাঙ্গা জেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত ছোট ও সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা। এ উপজেলার উত্তরে দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা ও হাউলি ইউনিয়ন, দক্ষিণে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা, পূর্বে কোটচাঁদপুর উপজেলা ও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা। ভৈরব নদী এ উপজেলার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। ইছামতি নদী ভারতের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ করেছে। জীবননগর উপজেলা সদর ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত।
জীবননগরের পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে ধোপাখালী, চ্যাংখালী, হরিহর নগর, বেণীপুরসহ আরো কয়েকটি সীমান্ত চৌকি থাকায় যুদ্ধের সময় এ থানার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। সীমান্ত থেকে অনতিদূরে ভারতের বানপুর, মাজদিয়া, ডোমপুকুরসহ আরো কয়েকটি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অনেক শরণার্থী এ থানার ওপর দিয়ে ভারতে যায়। জীবনগর সদর ছাড়া পাথিলা- দত্তনগর, হাসাদহ, উথলি, আন্দুলবাড়িয়া এ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
১৯৪৭-এর দেশভাগের এক দশক পরও জীবননগর থানায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। এলাকার সচেতন মানুষ চুয়াডাঙ্গা ভি জে স্কুল, দর্শনা মেমনগর ও কোটচাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাত। এজন্য পাকিস্তানের প্রথমদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের যোগাযোগ কম ছিল। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে জীবননগরের ছাত্র মুন্সি আব্দুস সাত্তার ১৯৫৩ সালে ভাষা-আন্দোলন-এর প্রথম শহীদ দিবস পালন উপলক্ষে ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে পাবনা শহরে একটি র্যালি বের করেন। এজন্য তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হতে গেলে বহিষ্কৃত ছাত্র বলে তার ভর্তির আবেদন বাতিল হয়। ফলে তার উচ্চশিক্ষা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৭ সালে জীবননগর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬১ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে এ স্কুলে যোগদান করেন। এ বছরই তিনি ছাত্র-জনতাকে নিয়ে আইয়ুব খানের সামরিক আইন ভঙ্গ করে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য র্যালি নিয়ে জীবননগর বাজার প্রদক্ষিণ করার সময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এটা ছিল জীবননগরের গণমানুষের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক আন্দোলন।
মুন্সি আব্দুস সাত্তার এলাকায় ভাষাসৈনিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। থানার আন্দুলবাড়িয়া, উথলি, হাসাদহ প্রভৃতি জায়গায় মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ-সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্ৰ করে ছাত্র-জনতা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬৪ সালে জীবননগরে প্রথম আওয়ামী লীগ-এর কমিটি গঠিত হয়। জীবননগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এডভোকেট ইউনুস আলী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশেম মোক্তার। পরে ইউনুস আলী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে জীবননগর বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আফছার আলী মিয়া (মিনাজপুর, বাকা ইউনিয়ন) জীবনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। ১৯৬৪ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন কাউন্সিল চত্বরে আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি গঠিত হয়। সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মীর আনোয়ার আলী পটল ও শেখ আবদার রহমান (নিশ্চিন্তপুর)। সদস্য হন মো. জয়নাল আবেদীন (আন্দুলবাড়িয়া বাজার), আবুল হোসেন মিয়া (নিধিকুণ্ড), বোরহান উদ্দীন (পাকা), বদরউদ্দীন (নিশ্চিন্তিপুর) প্রমুখ। এ কমিটি জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সকল আন্দোলন পরিচালনা করত। অসহযোগ আন্দোলন-এর সময় মীর আনোয়ার আলী পটলকে সভাপতি ও জয়নাল আবেদীনকে সম্পাদক করে আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর সময় আফছার মিয়া ও আবুল হাশেম মোক্তার জীবননগরের জনতা ও ছাত্র- শিক্ষকদের সংগঠিত করেন।
জীবননগর উপজেলায় ৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ছাড়া ভাসানী ন্যাপ, মোজাফ্ফর ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি রও সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল। থানার পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বেশকিছু জলাশয় ও বিল নিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরোধ ছিল। প্রতিক্রিয়াশীলরা জলাশয় ও বিলগুলো দখল করে। এরা প্রশাসনের কাছাকাছি ও রাজনৈতিকভাবে আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার সরকার এবং সামরিক জান্তার সমর্থক ছিল। অন্যদিকে জনতার পক্ষে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ, মোজাফ্ফর ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা- কর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিক্রিয়াশীলরা শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিল ও জলাশয় দখলকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি হিসেবে এলাকা মূলত দুভাগে বিভক্ত ছিল।
৭০-এর নির্বাচনে জীবনগরের মানুষ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। এখান থেকে ব্যারিস্টার আবু আহম্মদ আফজালুর রশিদ (বাদল রশিদ) এমএনএ এবং ইউনুস আলী এমপিএ নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে ২রা মার্চ ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। এদিন জীবননগরের রাস্তায়ও মানুষের ঢল নামে এবং সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের পর জীবননগরের মানুষ বিরাট মিছিল বের করে। জীবননগরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আফছার আলী মিয়া (সভাপতি, জীবননগর থানা আওয়ামী লীগ) ও আব্দুল হামিদ (গ্রাম বাকা)। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন- সামসুল হক (বাকা মাঠপাড়া), মো. সামসুজ্জোহা (হাসাদহ), লুৎফর রহমান (জীবননগর), আশরাফ উদ্দীন (মানিকপুর), রাহেন মিয়া, হোসেন দপ্তরি (মানিকপুর), নুর ইসলাম (মাধবখালী), সামসুদ্দিন (উথলি ইউপি চেয়ারম্যান), আবু তাহের (জীবননগর) প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির অফিস ছিল জীবননগর জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর একটি কক্ষে।
জীবননগর আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ভারতে পৌঁছে ভজন ঘাট, মাঝদিয়া প্রভৃতি জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য যুব অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলেন। ভজন ঘাটের দায়িত্ব নেন আফসার আলী মিয়া এবং মাঝদিয়া ক্যাম্পের পরিচালক নিযুক্ত হন হাশেম আলী মোকতার। জীবননগরের বামপন্থীরা নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলেন। কৃষ্ণগঞ্জ ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন রওশন আলী (কুষ্টিয়া)। তাঁকে সহায়তা করেন এডভোকেট শহিদুল ইসলাম (দর্শনা), আব্দার রহমান জোয়াৰ্দ্দার (চুয়াডাঙ্গা), মতিউর রহমান, কৃষ্ণা রহমান প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দীন (মানিকপুর)-সহ অনেকে রানাঘাট রিক্রুটিং ক্যাম্পে ভর্তি হয়ে বিভিএসসি (বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার্স সার্ভিস কোর)-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১০ই এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির সন্নিকটে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা থেকে ক্যাসেট করা বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশে প্রচারিত হয়। ভাষণ প্রচারের সার্বিক ব্যবস্থা ও দায়িত্ব পালন করেন ভারতের বিএসএফ-এর আঞ্চলিক অধিনায়ক গোলক মজুমদার।
সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে ১৪ই এপ্রিল মুক্ত এলাকা চুয়াডাঙ্গায়। সংবাদটি গোপন রাখার কথা ছিল। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার ডা. আসাবুল হক এমপিএ বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য প্রকাশ করে ফেললে পাকসেনারা যশোর সেনানিবাস থেকে এসে ১৩ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বোম্বিং করে। নিরাপত্তার কারণে অনুষ্ঠানটি ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার (বর্তমান মুজিবনগর) আম্রকাননে অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে জীবননগর থেকে আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক মীর আনোয়ার আলী, পটল ও মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন উপস্থিত ছিলেন।
২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারাদেশের মতো জীবননগর-চুয়াডাঙ্গার মানুষও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। দলে-দলে মানুষ সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে যা হাতে পায় তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সবার তখন একটিই দাবি ছিল – পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করা। এর আগে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনের সময় চুয়াডাঙ্গা ইপিআর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীসহ প্রশাসনের সকল স্তরের কর্মচারী-কর্মকর্তারা ব্যারিস্টার বাদল রশিদ, ডাক্তার আসাবুল হক এমপিএ, এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ প্রমুখ নেতার সঙ্গে স্বাধীনতার পক্ষে কাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।
২৬শে মার্চ জীবননগর মিছিলের শহরে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষ লাঠি, ফালা, দা, বল্লম ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ মিছিলে অংশ নেয়। এ-সময় চুয়াডাঙ্গা সংগ্রাম কমিটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ শ্ৰীমন্ত টাউন হল থেকে কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধে যাওয়ার জন্য বার্তা আসে। জীবননগর থানায় তখন অনেক মুজাহিদ- ও আনসার সদস্য ছিলেন। তাদের কেউ-কেউ চুয়াডাঙ্গা থেকে কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধে যান। আবার অনেকে ঝিনাইদহ হয়ে বিষয়খালীতে প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেন। কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এমএনএ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ ঢাকা থেকে রাজবাড়ী-মাগুরা-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা হয়ে ভারতে যাওয়ার সময় মুক্ত এলাকা চুয়াডাঙ্গায় একদিনের যাত্রাবিরতি করেন। তাঁরা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তৌফিক এলাহী চৌধুরী, ব্যারিস্টার বাদল রশিদ এমএনএ, ডাক্তার আসাবুল হক এমপিএ, এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ ও স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে পরপর ৩টি বৈঠক করেন। প্রথম বৈঠকে চুয়াডাঙ্গার প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দ্বিতীয় বৈঠকে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিসহ সামরিক অফিসারগণ এবং তৃতীয় বৈঠকে শুধু তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। প্রথম বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলার প্রথম অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করেন। তিনি নির্মাণাধীন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অংশবিশেষ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
৩০শে মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম চ্যাংখালী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। আবু ওসমান চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ তাঁদের পৌঁছে দেন। ৫ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমেদ পুনরায় ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে জীবননগর সীমান্তে আসেন। আবু ওসমান চৌধুরী সেখানে যান এবং তাঁদের মধ্যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ ও যুদ্ধের অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা হয়।
বিষয়খালীর প্রতিরোধযুদ্ধে পাকবাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে চুয়াডাঙ্গার পতন হয়। তখন জীবননগরের মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। এ-সময় এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ জীবননগর সংগ্রাম কমিটির পরিচালক আফসার মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি জীবননগর সংগ্রাম কমিটি ও দলীয় লোকজন নিয়ে ভারতে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
১৩ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার পতনের পর এদিন পাকবাহিনী জীবননগরে অনুপ্রবেশ করে। ১৬ই এপ্রিলের মধ্যে তারা জীবননগরসহ জেলার সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। জীবননগর উপজেলায় তারা জীবননগর থানা, পাথিলা, হাসাদহ, আন্দুলবাড়িয়া ইত্যাদি স্থানে শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ব্যাংকারসমূহে তাদের শক্ত অবস্থান ছিল। জীবননগর থানা শান্তি কমিটির সভাপতি হয় প্রথমে ডা. কাজী সামসুজ্জোহা (পিতা দবির উদ্দীন, জীবননগর) এবং পরে হাবিবুর রহমান (পিতা নুর মোহাম্মদ, গঙ্গাদাসপুর)। শান্তি কমিটির অন্য নেতা ছিল আবুল হোসেন মণ্ডল (সিংহনগর)। আবুল হোসেন মণ্ডল এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল। স্বাধীনতা উত্তরকালে এ তিনজন দালাল আইনে গ্রেফতার হয় এবং পরে ছাড়া পায়। স্বাধীনতাবিরোধী অন্যদের মধ্যে ছিল— সামসুদ্দিন (সন্তোষপুর), ফজর আলী (মনোহরপুর), খলিলুর রহমান (খয়েরহুদা), তোয়াক্কেল (গয়েশপুর), জাফর (ধোপাখালী), আব্দুল বারী কামার (নতুনপাড়া), ইস্রাফিল (জীবননগর), শুকুর মৌলভী (বাড়ান্দী কুমুরপাড়া), ইছাহাক (পূর্ব বাড়ান্দী), আলীকদর (পূর্ব বাড়ান্দী), আহাদ আলী (পূর্ব বাড়ান্দী), শাহাজান আলী (পূর্ব বাড়ান্দী) প্রমুখ। রায়পুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল হারেজ মিয়া (বালিহুদা) এবং ইউনিয়নের কুখ্যাত রাজাকার ছিল গহর আলী (গ্রাম বালিহুদা)।
আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়ন রাজাকার কমান্ডার ছিল শেখ আতাউল ইসলাম (আন্দুলবাড়িয়া)। রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল- বিদ্যাধরপুরের মন্টু, খয়েরহুদার ডা. খলিলুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, শহীদুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, উথলীর মিলন মিয়া, নিলু মিয়া, আন্দুলবাড়িয়ার মহি মির্জা, হাসাদহের ফকির বিশ্বাস। শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার ছিল— জাফর আলী মিয়া (ধোপাখালী), আবুল হোসেন (সিমনগর), শেখ মতিয়ার রহমান (বিদ্যাধরপুর), মুন্সি বদর উদ্দীন (নারানপুর), মেহের আলী মিয়া (মিনাজপুর), দরবেশ আলী খা (নিধিকুণ্ডু), বগা মোল্লা (আন্দুলবাড়িয়া), ফরিদ উদ্দীন দর্জি (দৌলতগঞ্জ) প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার বারী কামারের কান কেটে দেন। জীবননগরের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দরবেশ আলী, কাদের মাস্টার, মেসের আলী (থানা সার্কেল অফিসার, জীবননগর), ডা. খলিলুর রহমান (খয়েরহুদা), এম এন খান (দৌলতগঞ্জ), তোফাজ্জেল হোসেন (খয়েরহুদা) প্রমুখ স্বাধীনতাবিরোধী প্রচারণা চালায়। জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে এডভোকেট ইউনুস আলী এমপিএ ভারতে যাওয়ার জন্য তাঁকে সংবাদ দেন। দত্তনগর ফার্ম থেকে একটি গাড়ি এসে তাঁকে পরিবারের সদস্য ও মালপত্রসহ নিয়ে যাওয়ার কথা থাকা আতিকুজ্জামান একদিন অপেক্ষা করেন। ঠিক ঐদিন কিছু অবাঙালি বিহারি ও মুসলিম লীগের সদস্য এসে আতিকুজ্জামানকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদিন তারা আফসার মিয়ার পরিবারবর্গ ও আওয়ামী লীগের লোকজনকে খুঁজতে থাকে। তারা আফসার মিয়ার হার্ডওয়ারের দোকান ও তাহের মিয়ার মুদি দোকানসহ অনেকের দোকান ও বাড়িঘর লুট করে।
ভারতের কৃষ্ণগঞ্জে স্থাপিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বামপন্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভাসানী ন্যাপ নেতা আব্দুর রাজ্জাক (গ্রাম কয়া) ভারত থেকে দেশের অভ্যন্তরে জীবননগর এলাকায় আসেন। দেশে আসার পর তিনি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। এ ব্যাপারে দালালরা সহযোগিতা করে। তাঁকে রাজাকার কদম রসুল (গ্রাম কয়া) ও জামায়াতে ইসলামী-র কিয়াম উদ্দীন (কয়া), ইছাহক (পিতা সমির উদ্দীন, মনোহরপুর) ধরিয়ে দেয়। জীবননগর থানা পাকবাহিনীর ক্যাম্পে তাঁর ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করা হয়। পরে পাকসেনারা থানার উত্তর পাশে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে।
মে মাসে মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা খুলনা ও দর্শনা থেকে বিহারিদের নিয়ে এসে জীবননগরের আওয়ামী লীগ নেতা আফসার আলী মিয়ার দোকানসহ ১৫-২০টি দোকান লুটপাট করে। এদিন তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা নফর আলী (পিতা নবু শেখ, জীবননগর বাসস্ট্যান্ড পাড়া)-র সহোদর জাফর আলীর দোকানও লুট করে। তারপর তারা জাফর আলী ও আরো তিনজনকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে তেঁতলিয়া বিলের ধারে জবাই করে হত্যা করে। এ ঘটনা তেঁতুলিয়া বিল গণহত্যা নামে পরিচিত।
জুন মাসে পাকসেনারা সংঘবদ্ধ হয়ে হরিহরনগর গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা চালায়। তারা খাঁ পাড়ার ৪০টি বাড়ি সম্পূর্ণ রূপে পুড়িয়ে দেয়। এদিন তারা ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। হরিহরনগর গণহত্যায় নিহতদের ৮ জন ছিলেন হরিহরনগর গ্রামের এবং অন্যজন মেদিনীপুরের। পাকসেনারা প্রায়ই খুলনা থেকে ট্রেনে বিহারি ও রাজাকারদের নিয়ে দর্শনা, উথলি, সাবদালপুর, আনছার বাড়ী, কোটচাঁদপুর, বারবাজার প্রভৃতি স্টেশনে নেমে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালাত। আগস্ট মাসে উথলি স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে লুটেরারা সেনেরহুদা গ্রামে লুটতরাজ চালায়, একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং ৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
আগস্ট মাসে বেনাগাড়ীর মাঠে দত্তনগরের পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। যাওয়ার সময় তাঁরা একটি গুলির বাক্স ফেলে যান। পরের দিন ঐ বাক্সের খোঁজে হরিহরনগরের জেকের আলী ও একজন ইপিআর মুক্তিযোদ্ধা এলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা পাকসেনাদের হাতে তাঁরা ধরা পড়েন। এ মাসে পাকসেনারা হরিহরনগরের কাবিলসহ আরো ৫ জনকে আটক করে। সবাইকে গ্রামের মাতব্বার মণ্ডলের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। তারা একে-একে সবাইকে জবাই করে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযাযী প্রথমে সব থেকে শক্তিশালী কাবিলকে ৩-৪ জনে ধরে ঠেলতে-ঠেলতে রাস্তার খাদের দিকে নিয়ে যায়। এক ঘাতক সৈন্য ছুরি দিয়ে গলা কেটে কাবিলকে হত্যা করে। এ নারকীয়তা দেখে ঘরে আটক অন্যরা পালিয়ে জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো বিশেষ করে মানিকপুর ও রাজাপুর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। এসব গ্রামের লোকজন শরণার্থী হয়ে ভারতে কিংবা দেশের অন্যত্র আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মানিকপুরের আজিজুল হক (পিতা ফটিক মল্লিক) ও রাজাপুরের নূর মোহাম্মদ (পিতা আকুব্বার মণ্ডল) বাকা ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। এ অবস্থায় সেপ্টেম্বর মাসে মাধবখালীর রাজাকাররা আজিজুল হক ও নূর মোহাম্মদকে হত্যা করে।
৪ঠা নভেম্বর ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার মুক্তিযোদ্ধা সানাউর রহমান হুশোরখালী যুদ্ধের সময় পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে তারা জীবননগর থানার হাসাদহ ক্যাম্পে নিয়ে আসে। এখানে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এক সময় পাকসেনারা বড় পাত্রে ফুটন্ত পানিতে ফেলে তাঁকে হত্যা করে।
রাজাপুর গ্রামের ভূটি মণ্ডল (পিতা হাতেম মণ্ডল) গ্রামের মাঠে গরু চরানো অবস্থায় দত্তনগর ফার্ম থেকে আসা টহলরত পাকসেনাদের সামনে পড়ে। পাকসেনারা তার পালের বড় ষাঁড়টি নিয়ে যাওয়ার সময় ভূটি মণ্ডল কাকুতি- মিনতি করে বাধার সৃষ্টি করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকসেনারা বেওনেট চার্জ করে ভূটি মণ্ডলকে হত্যা করে।
পাবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে দালালদের মাধ্যমে আটক নারীদের পাশবিক নির্যাতন করা হতো। নারীলিপ্সু পাকিস্তানি অফিসার মুনসুর ও অন্যদের হাতে অসংখ্য নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। দত্তনগর, হাসাদহ, জীবননগর, আন্দুলবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত স্থান ও বাংকারসমূহে মেয়েদের শাড়ি, পরিধেয় অন্যান্য বস্ত্র, ভাঙা চুড়ি, চুলের ফিতা ও চুলের গোছা পাওয়া যায়। থানার ৪টি ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহ এবং নিশ্চিতপুর, গঙ্গাদাসপুর, মাধবখালী, হরিহরনগর, চ্যাংখালী, বেনিপুর ইত্যাদি গ্রামের অনেক নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। জীবননগর থানার উত্তর পাশের দোপালো জায়গায় একটি গণকবর রয়েছে।
১৫ই মে মুক্তিযোদ্ধারা দর্শনার দুই মাইল উত্তরে অবস্থিত দুধপাতিলা রেলব্রিজ মাইনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এ-সময় লোকনাথ পুরের রাজাকার ওদুদ গাড়োয়ান ও তার সহযোগীরা বাশার ও বাবলু নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনাদের হাতে ধরিয়ে দেয়।
২১শে মে জীবনগরের উত্তরে শিয়ালমারি পশু হাটের কাছে পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা এন্টিট্যাংক মাইন পুতে রাখেন। মাইনে আঘাত লেগে পাকসেনা বহনকারী একটি বেসমারিক ট্রাক উল্টে যায় এবং ট্রাকে থাকা সকল পাকসেনার মৃত্যু হয়। পরের দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এলে পাকসেনাদের একটি জিপ উল্টে যায়। এন্টিট্যাংক মাইন পোঁতায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা মহব্বত হোসেন (ফুলবাড়ী), আতাউল (কামালপুর, দৌলতপুর, কুষ্টিয়া), মসলেম (খুদিখালি, আলমডাঙ্গা), আব্দুস শুকুর বাঙালী (কুলচারা) প্রমুখ।
জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধারা হরিহরনগরের কলম মণ্ডল ও মহসিন বিশ্বাসের কাঁঠাল বাগানে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী করটিয়ার মাঠে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংকার তৈরি করছিলেন, তখন পাকসেনারা করটিয়া ব্রিজে পজিশন নিয়ে তাঁদের ওপর এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ার করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছিয়ে প্রথমে নিরাপদ স্থানে এবং পরে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ভেতরে যান।
১৪ই জুলাই বানপুর ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুসুমপুর, রাজাপুর ও মাধুখালী বিওপি-র পাকসেনাদের পরপর কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করেন। এসব বিওপি দখল করে মুক্তিযোদ্ধারা টিন খুলে নিয়ে বানপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেন।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বানপুর ক্যাম্পের কাছে সীমান্ত এলাকায় জিপ নিয়ে পাকসেনারা টহলরত ছিল। বিএসএফ ক্যাম্পের মাধ্যমে এ সংবাদ পেয়ে সুবেদার মহরম ওস্তাদ (মেহেরপুর)-এর নেতৃত্বে ১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা অতিসন্তর্পণে পজিশন নিয়ে পাকসেনাদের লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। তারাও পাল্টা গুলি বর্ষণ করে। তীব্র যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আহত তিন পাকসেনাকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলসহ আটক করা হয়। এরপর আটককৃত পাকসেনাসহ হানাদারদের ফেলে যাওয়া জিপ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বানপুর ক্যাম্পে ফিরে যান।
১৮ই জুলাই জীবননগর থানার পাথিলা-দত্তনগর খামারে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। সাময়িকভাবে দত্তনগর মুক্ত হয়। এদিন ফেরার পথে, গেরিলারা একটি কালভার্ট উড়িয়ে দিয়ে পাকসৈন্যদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়।
৭ই আগস্ট সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান (পরবর্তীকালে জেনারেল ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান)-এর নেতৃত্বাধীন একটি গেরিলা দলের সঙ্গে জীবননগরের ধোপাখালী সীমান্তে পাকসেনাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধের সহ-অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার রফিক। যুদ্ধে উভয় পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দীন (দৌলৎগঞ্জ, জীবননগর), রেজু, কাশেম, রেজাউল করিম আলো, দর্শনার সামাদ, আক্তার (সামাদ ও আক্তার দুই সহোদর) এবং আরো অনেকে অংশ নেন। ধোপাখালী যুদ্ধ-এ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দুজন আহত হন।
৯ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পাথিলা-দত্তনগর খামার ঘেরাও করেন। এখানে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। ১৮ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ধোপাখালী সীমান্ত ফাঁড়িতে আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস শুকুর বাঙালী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে জীবননগর বেলেরদাড়ীতে পাকসেনাদের যুদ্ধ হয়। ১৩ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ছাব্দালপুর রেল স্টেশনের উত্তরে শাহাপুর নামক স্থানে রেললাইনে মাইন স্থাপন করেন। মাইন বিস্ফোরিত হলে পাকসেনা বহনকারী ট্রেন উল্টে যায় এবং একটি রেলব্রিজ ধ্বংস হয়। এ অপারেশনে আব্দুর রহমান, আব্দুস সামাদ শাহ্, আক্কাস, আবুল, আজহারুল ইসলাম রেজু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। ৫ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হাসাদহ ও কোটচাদপুরের মধ্যবর্তী স্থানে ২০০ মিটার তার কেটে পাকবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
১২ই নভেম্বর ধোপাখালী সীমান্তে ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মোস্তাফিজুর রহমান পেটে গুলিবিদ্ধ হন। অপর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম (পিতা সৈয়দ আলী মণ্ডল, পরানপুর, দামুড়হুদা থানা) হাতে গুলিবিদ্ধ হন। নায়েক মহব্বত ও আজাহারুল ইসলাম রেজু (ধোপাখালী) আহত ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানকে কাঁধে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। পরে তাঁকে কৃষ্ণনগর পাঠানো হয়। এ-যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।
১৪ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আন্দুলবাড়িয়া পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করেন। আন্দুলবাড়িয়া পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণে ১২ জন অবাঙালি পুলিশ নিহত হয়।
জীবননগর এলাকার পাকসেনাদের ত্রাস ছিলেন বানপুর একশন ক্যাম্পের কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা মহরম ওস্তাদ। তিনি, তানজীর ও দর্শনার মুবারক পাড়ার নুর হাকিমসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্রলিং করে পাকসেনাদের বাংকারে রেকি করছিলেন। ক্রলিংরত মহরম ওস্তাদকে বাংকারের মধ্য থেকে দুজন পাকসেনা দেখে ফেলে। তারা তাঁকে ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। হঠাৎ ঐ দুই পাকসেনাকে দেখে মহরম ওস্তাদ চমকে ওঠেন এবং ফিরে আসার চেষ্টা করেন। এ অবস্থায় পাকসেনারা তাঁকে ধরে টানাটানি শুরু করে। তখন মুক্তিযোদ্ধা তানজীর ও নুর হাকিম দ্রুত বেওনেট চার্জ করে দুই পাকসেনাকে হত্যা করেন। এরপর পাকিস্তানিদের অস্ত্র নিয়ে দ্রুত তাঁরা ভারত সীমান্তের মধ্যে ঢুকে পড়েন। ২রা ডিসেম্বর সংঘটিত হয় সুটিয়া যুদ্ধ। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়।
৪ঠা ডিসেম্বর জীবননগর সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়। এদিন ডাকবাংলো চত্বরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। হাবিবুর রসুলকে প্রশাসনের প্রধান ও মজিবর রহমানকে থানা ইনচার্জ করে বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়।
জীবননগরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুর রাজ্জাক (গ্রাম কয়া; ভাসানী ন্যাপ নেতা), কালাচাঁদ (পিতা পাচু মণ্ডল, মনোহরপুর), বদর উদ্দীন (পিতা শাহাদত, উথলি), আব্দুর রহমান (পিতা মহম্মদ মণ্ডল, আন্দুলবাড়িয়া; ভারত থেকে আসার পথে পাকসেনাদের হাতে শহীদ), রহমতউল্লাহ (পিতা মকছেদ আলী, কর্চাডাঙ্গা; শিকারপুর একশন ক্যাম্প থেকে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানাধীন এলাকায় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ), আতিয়ার রহমান (জীবননগর থানা মুক্ত হওয়ার কয়েকদিন পর ৮ই ডিসেম্বর কাশিনাথপুর গ্রামে মাইন উদ্ধারকালে বিস্ফোরণে শহীদ), আতিকুজ্জামান (রাজাপুর, থানা শিবচর, জেলা মাদারীপুর; যুদ্ধকালে জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন; তিনি জীবননগর থানার বেশকিছু সংখ্যক কনস্টেবল নিয়ে বাংলাদেশেরর পক্ষে আনুগত্য স্বীকার করেন এবং কুষ্টিয়া ও বিষয়খালী প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন; ১৬ই এপ্রিল স্বাধীনতাবিরোধী কিছু বিহারি ও স্থানীয় মুসলিম লীগ কর্মীর হাতে শহীদ), গিয়াস উদ্দীন (পিতা ইব্রাহিম খান, ধোপাখালী, ইপিআর সদস্য; প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় ১ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ সমরে শহীদ) এবং খোরশেদ আলম (পিতা আব্দুস সোবহান, আন্দুলবাড়িয়া; আনসার বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং পাকা গ্রামের মাঠে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)।
৭ই আগস্ট ধোপাখালী যুদ্ধে শহীদ ৫ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুর, আব্দুর রশিদ, আব্দুল বাকের, সিদ্দিক আলী ও আব্দুল আজিজ এবং ১৯শে জুলাই রাজাপুর যুদ্ধে শহীদ নায়েক আব্দুল মালেকের লাশ মানিকপুর কবরস্থান থেকে তুলে মাধবখালী-ধোপাখালীতে এনে এখানে ৬ শহীদ স্মরণে একটি স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর শহীদ আতিকুজ্জামান (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জীবননগর থানা)-এর স্মরণে জীবননগর থানা মোড়ে স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১- ২০০৬) তা বিলুপ্ত হয়। আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পুত্র শেখ কামালের নামে একটি ক্লাবের নাম রাখা হয়েছে নিশ্চিন্তপুর শেখ কামাল ক্রীড়া সংঘ। [কোরবান আলী মণ্ডল ও আব্দুর রহমান ধূনা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড