বীর বিক্রম জুম্মা মিয়া
জুম্মা মিয়া, বীর বিক্রম (১৯১৬-১৯৭১) হাবিলদার ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর জন্ম ১৯১৬ সালে সিলেট জেলার অন্তর্গত গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ গ্রামে। তাঁর পিতা শেখ ওসমান আলী এবং মাতা সকিনা বিবি।
জুম্মা মিয়া ইপিআর বাহিনীতে হাবিলদার পদে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে তাঁর কর্মস্থল ছিল কুমিল্লায়। ৭১-এর ২৫শে মার্চ বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ২৬শে মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ৯ই মে তিনি কুমিল্লার বিবির বাজারে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এক পর্যায়ে যুদ্ধরত অবস্থায় এ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন ও আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক হাবিলদার জুম্মা মিয়া ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন। তিনি ৪ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম আম্বিয়া খাতুন। [হারুন রশীদ] জুরাছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি) রাঙ্গামাটি সদর থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। এখানে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌকা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এটি বরকল থানার একটি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮০ সালে এটি থানা এবং ১৯৮৩ সালে উপজেলার মর্যাদা লাভ করে। ৬০৬.০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলার উত্তরে বরকল, দক্ষিণে বিলাইছড়ি, পশ্চিমে রাঙ্গামাটি সদর এবং পূর্বে ভারতের মিজোরাম অবস্থিত।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সারাদেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন পার্বত্য জেলার এ স্থানটিতে তার কোনো উত্তাপ ছিল না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এ এলাকার লোকসংখ্যাও ছিল খুবই কম। বাঙালির সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও এ উপজেলায় যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনার কথা স্থানীয় জনসাধারণ চিন্তা করেনি। ফলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্যও তাদের কোনো চিন্তা- ভাবনা ছিল না। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল এ উপজেলা দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনসাধারণ তাঁদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে।
জুলাই-আগস্টের দিকে এ-পথ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর সদস্যরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ভারতীয় সৈন্যরাও কয়েকদফা আসা-যাওয়া করে। স্থানীয় লোকজন তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। এখানে তখন একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল পানছড়ি ভুবনজয় প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি মাত্র হাইস্কুল ছিল ভুবনজয় উচ্চ বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ধল কুমার চাকমা। তিনি উচ্চ বিদ্যালয়েরও দায়িত্ব পালন করতেন। ষাটের দশকে তিনি পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর কর্মচারী ছিলেন।
সে কারণে তিনি উর্দু ভাষা ভালই বুঝতেন এবং বলতে পারতেন। তিনি হিন্দি ভাষাও জানতেন। তাই
ভারতীয় সৈন্যরা এখানে এলে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন। আবার পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন উপজেলা দখলে নেয়, তখনো তিনি তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষা করতেন। তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কর্মচারী ছিলেন বলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে বিশ্বাস করত। ফলে এলাকার লোকজন যাতে আক্রান্ত না হয় সেজন্য তিনি পাকিস্তানি শিবিরের অফিসারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাখতেন। তিনি স স্থানীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমন্বয় করে এটি করতেন। যেহেতু জুরাছড়ি উপজেলার কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, সেহেতু এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে রাঙ্গামাটি জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলী। তিনি সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহের জন্য রাঙ্গামাটি নিয়ে যান। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা খোঁজ-খবর রাখতেন, তাঁরা হলেন— ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও হেডম্যান দয়ামন চাকমা, অরিন্দম দেওয়ান, পূর্ণমোহন হেডম্যান, ধল কুমার চাকমা প্রমুখ। রাঙ্গামাটির জেলাপ্রশাসক এইচ টি ইমাম ও মহকুমা প্রশাসক এম আবদুল আলীসহ সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় ধল কুমার চাকমা তাঁদের সহযোগিতা করেন।
জুলাইয়ের শেষদিকে কমান্ডার মেজর বেলালের নেতৃত্বে ২০- ২৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য তাদের কিছু সংখ্যক দোসর নিয়ে জুরাছড়ি উপজেলায় প্রবেশ করে। মেজর বেলাল হেডম্যান ও চেয়ারম্যান দয়ামন চাকমা ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধল কুমার চাকমার সঙ্গে আলাপ এবং উপজেলার সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সেদিন চলে যায়। এর কিছুদিন পর আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তারা জুরাছড়ি উপজেলা দখলে নেয় এবং যক্ষাবাজারের প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর বাজারের অপর পাশে হ্রদতীরবর্তী লেবার পাড়ায় আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প স্থাপন করার পর তারা চলাচলের সুবিধার্থে দেড় মাইল রাস্তা পাকা করে। পাকিস্তানি সৈন্য, পুলিশ, মিজো বাহিনী ও রাজাকার মিলে আড়াইশোর মতো লোক ছিল এ তিনটি ক্যাম্পে।
জুরাছড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা ধল কুমার চাকমার সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ রাখত এবং তাঁর পরামর্শ নিত। স্থানীয় লোকজনদের ওপর যাতে নির্যাতন না হয়, সেদিকে তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থানীয় লোকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করত। যারা যেতে চাইত না, তারা ধল কুমারের সহায়তায় রক্ষা পেত।
ধল কুমার চাকমার ভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ছটপটিঘাট মৌজার রমলেন্দ চাকমা, রাইছড়ির প্রফুল্ল চাকমা, কুনেন্দু চাকমাসহ এলাকার ২০-২৫ জন রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তবে এরা স্থানীয় সাধারণ লোকজনের ওপর তেমন অত্যাচার-নির্যাতন করেনি। কখনো কোনো রাজাকার সাধারণ লোকজনের ওপর অত্যাচার করতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে উল্লিখিত চেয়ারম্যান ও প্রধান শিক্ষক কমান্ডারকে বুঝিয়ে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করতেন।
ধল কুমার চাকমাসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কারণে পাকেসেনা ও রাজাকাররা জুরাছড়ি উপজেলায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো দুষ্কর্ম করতে পারেনি। তবে পাকসেনারা স্থানীয় লোকজনদের গরু, ছাগল ও মুরগি নিয়ে যেত, কখনো সামান্য মূল্য দিত। এছাড়া রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাল ও ফল-মূলও নিয়ে যেত। নিরাপত্তার কারণে অনেক সময় যুবতি মেয়েদের জঙ্গলে কুঁড়েঘর তৈরি করে সেখানে রাখতে হয়েছে। পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনী-র মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে হেডম্যান রশিদ রঞ্জন চাকমাসহ স্থানীয়রা উপজেলার অধিকাংশ যুবতি মেয়েদের লুলংছড়ি মৌজায় নিয়ে যান।
উপজেলার হেডম্যানদের কৌশলী অবস্থানের কারণে এখানে নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে আজাবর চাকমা নামে একজন স্থানীয় পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধা উভয় পক্ষের সোর্স হিসেবে কাজ করত। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কথা এক পর্যায়ে জানতে পেরে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে নির্যাতন শেষে হত্যা করে। তার বাসা ছিল উপজেলার সীমান্তবর্তী আইমাছড়া এলাকায়৷
নভেম্বর মাসের শেষদিকে আইমাছড়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষ বরকলে যুদ্ধ করতে- করতে জুরাছড়ির দিকে এগিয়ে আসে। এ-যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বেশ কয়েকজন তিব্বতি সৈন্য শহীদ হন।
ভারতের বগাখালিতে মিত্রবাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল। নভেম্বরের শেষের দিক থেকে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত এ ঘাঁটির সৈন্যদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। কখনো পাকিস্তানিরা মিত্রবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়ত, আবার কখনো মিত্রবাহিনী পাকিস্তানিদের লক্ষ করে গুলি ছুড়ত। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই উভয় পক্ষের গুলি বিনিময় চলত। এতে নিহত পাকসেনাদের অনেকের লাশ পানিতে ভেসে যেতে দেখা যায়। অপরদিকে মিত্রবাহিনীর প্রায় শতাধিক তিব্বতি সৈন্য শহীদ হন। ডিসেম্বর মাসে যক্ষাবাজারে পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়।
অবশেষে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী ১২ই ডিসেম্বর বনযোগিছড়া হয়ে পালিয়ে যায় এবং উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধল কুমার চাকমা স্থানীয় রাজাকার বিজারন চাকমা, রমলেন্দ চাকমা, পেগু চাকমা ও শিবুসহ কয়েকজনকে বরকল থানা ও রাঙ্গামাটিতে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করান। এছাড়া যুদ্ধের পর তিনি হানাদারদের পরিত্যক্ত অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে বরকল থানায় জমা দেন। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড