স্থানীয় মুক্তিবাহিনী জিয়া বাহিনী (সুন্দরবন অঞ্চল)
জিয়া বাহিনী (সুন্দরবন অঞ্চল) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমেদ (মেজর জিয়া)।
সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯নং সেক্টরাধীন ছিল। ৭১-এর আগস্ট মাসের শুরুতে এটি সাব-সেক্টর হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু স্বীকৃতি প্রাপ্তির পূর্বেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্থ গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার জিয়াউদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হলে সুন্দরবন সাব-সেক্টরের মর্যাদা লাভ করে। বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও সাতক্ষীরার একাংশ নিয়ে সুন্দরবন সাব-সেক্টর গঠিত হয়। জিয়াউদ্দিন আহমেদ হন এর কমান্ডার। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরের দিন ২৭শে মার্চ বিকেল থেকে জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে পিরোজপুর সরকারি স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ-সময় থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত পিরোজপুরের বিভিন্ন থানা ও বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে অস্থায়ী ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল দুঃসাহসী জিয়া বাহিনী। এরপর জুন মাসের ১ম সপ্তাহে সুন্দরবনে মাইঠা ক্যাম্প ও আড়াইবাঁকি ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে জিয়া বাহিনী স্থায়ী ঠিকানা ও পরিচিতি লাভ করে। জিয়া বাহিনী ও সুন্দরবন সাব-সেক্টরের অধীনে ১৫০০০-১৬০০০ মুক্তিযোদ্ধা (নিয়মিত আর্মি ব্যাটালিয়ন ও অনিয়মিত বাহিনী) ছিল। তেঁতুলবাড়িয়া নদীর তীরে সুন্দরবন সাব-সেক্টরের হেডকোয়ার্টস গড়ে তোলা হয়। সেনাবাহিনীর নিয়মানুসারে পরিচালিত এ বাহিনীতে মোট ১২টি প্রশাসনিক বিভাগ ও বিশেষ গেরিলা বাহিনী ছিল, যেমন- টাইগার কোম্পানি, ব্রেভো কোম্পানি ইত্যাদি। চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য একটি মেডিকেল টিম ছিল। তেঁতুলবাড়িয়া হেডকোয়ার্টার্স, তাম্বুলবুনিয়া স্টুডেন্ট ক্যাম্প, হয়লাতলা ও কলমতেজিতে ছিল এ সুন্দরবন বাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির। এ বাহিনীর বিশেষ-বিশেষ ক্যাম্প এবং কমান্ডাররা হলেন: কলমতেজি ক্যাম্প- স ম কবির আহমেদ মধু, নারী মুক্তিযোদদ্ধা ক্যাম্প- নাছিমা বেগম, নাংলী ক্যাম্প- মফিজুল হক, তাম্বুলবুনিয়া পশ্চিমবঙ্গ গেরিলা ক্যাম্প- সুবেদার আ. গাফফার, হয়লাতলা ক্যাম্প- মো. আফজাল হোসেন, বৈদ্যমারি মুজিব বাহিনী ক্যাম্প- ডা. মোসলেম উদ্দিন এবং কালিবাড়ি ক্যাম্প- নূর মোহাম্মদ। ২৬শে মার্চ জনতা পিরোজপুর ট্রেজারি লুট করে অস্ত্র নিয়ে যায়। তা থেকে জিয়া বাহিনী বেশকিছু অস্ত্র পায়। এছাড়া বিভিন্ন থানা আক্রমণ এবং রাজাকার ও শত্রুবাহিনীর কাছ থেকেও তাঁরা অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে প্রাথমিক প্রয়োজন মেটান। সাব-সেক্টর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর জিয়া বাহিনী বাংলাদেশ সরকার-এর কাছ থেকে বেশকিছু উন্নত অস্ত্ৰ পায়।
জিয়া বাহিনী পিরোজপুর বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলসহ সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এসব এলাকার জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় মানুষের পূর্ণ সহযোগিতায় জিয়া বাহিনীর খাদ্য ও অর্থ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়। এ বাহিনী অনেকগুলো যুদ্ধ, অপারেশন ও অভিযানে অংশ নেয়। তার মধ্যে মোড়েলগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ (১৩ই জুলাই), ধানসাগর খালমুখে সম্মুখ যুদ্ধ, ফুলহাতা, পানগুচি নদীতে রাজাকার বাহিনীর লঞ্চ আক্রমণ, মোড়েলগঞ্জে রাজাকারদের বিরুদ্ধে অভিযান (১৬ই আগস্ট), বগী পাঞ্জাবি গানবোট প্রতিরোধযুদ্ধ (২৫শে আগস্ট), রাজাপুর ভোলা নদীর পূর্ব পাড়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ, তুষখালী অপারেশন, বড় মাছুয়ায় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মঠবাড়িয়া-আমড়াগাছিয়া-বেতমোর যুদ্ধ, শরণখোলা হানাদার বাহিনীর গানবোট প্রতিরোধ, শৌলা নদীপথে পাকবাহিনীর গানবোট আক্রমণ, শেলা নদীতে পাকবাহিনীর স্টিমার আক্রমণ (সেপ্টম্বর), বগী ঘাঁটিতে হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ (২১শে অক্টোবর), পাঞ্জাবি গানবোটে হামলা (১০ই নভেম্বর), শাপলেজা বাজার অপারেশন (৫ই ডিসেম্বর), হিরণ পয়েন্ট-মর্জাদ-মংলাবন্দর অভিযান, কাউখালী উপজেলায় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশন ও মঠবাড়িয়া উপজেলা অভিযান উল্লেখযোগ্য। ৮ই ডিসেম্বর জিয়া বাহিনীর হাতে পিরোজপুর শত্রুমুক্ত হয়। [মনিরুজ্জামান শাহীন ও মিথুন সাহা]
তথ্যসূত্র: মেজর জিয়াউদ্দিন (অব.), মুক্তিযুদ্ধের সেই উন্মাতাল দিনগুলো, ঢাকা ১৯৯৩; মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর জব্বার, একাত্তরের সুন্দরবন, ঢাকা, ২০১৮
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৪র্থ খণ্ড